আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ চিঠি তোমার জন্য , প্রিয়তা

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে ... প্রিয়তা , তোমার কাছে কখনো ভাবিনি লিখব , এই ই-মেইলের যুগে আবার লেখালেখি কিসের ...... মুঠোফেনে একটা মেসেজ পাঠাবার সময় নেই কারো , আবার লেখালেখি । কিন্তু , একান্ত বাধ্য হয়ে তোমার কাছে লিখতে হচ্ছে । তোমার ঠিকানা জানা নেই । জানা নেই ই-মেইল আইডি অথবা মোবাইলের সংখ্যাগুলো । জানা নেই , তুমি ফেসবুকে , টুইটারে বা হালের গুগল প্লাসে কোন একাউন্ট করে ফেলেছ কিনা ।

তাই এখানে লিখছি । প্রতিদিন , কত হাজার হাজার মানুষ চোখ রাখে সামহোয়্যারে , কত হাজার হাজার প্লাসে , মন্তব্যে , সমালোচনায় মুখর হয় পৃষ্ঠাগুলি । তারই ফাঁকে যদি কখনো তোমার চোখে পড়ে যায় , তোমাকে লেখা আমার এই চিঠি - এ আশায় লিখছি । তোমার সাথে প্রথমবার দেখা হবার কথা মনে আছে ? লাইব্রেরীতে আড্ডা দিচ্ছিলাম চুটিয়ে , হঠাৎ সামনে দেখি বিশাল কালো একজোড়া চোখ .... তোমার । " আস্তে কথা বলুন , আমরা পড়ছি " তৈরি উত্তর এসে গিয়েছিলো ঠোঁটের ডগায় , কিন্তু তোমার চোখের দিকে চেয়ে ঠোঁট পেরোবার সাহস পায়নি তখন ।

কখনোই পায়নি এরপরে , যতবার চেয়েছি ঐ চোখজোড়ার দিকে - হারিয়ে ফেলেছি । কখনো কথা , কখনো অক্ষমতা , কখনোবা নিজেকে । আমি তখন ধূমসে সিগারেট টানি , মেগাডেথ আর আয়রন মেইডেন ছাড়া কোন গানকে গান মনে হয় না , মাক্স আর লেনিনকে নিজের পিতার চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি , সারারাত তাস পেটাই , মাঝে মাঝে চায়ের আড্ডায় মেনিমুখো বন্ধুদের দাঁত খিঁচিয়ে মারতে এগিয়ে যাই । তোমার মনে আছে , প্রিয়তা ? এই রূক্ষচূল , বাউন্ডুলেকে কি অবাক মমতায় তুমি ভালোবেসেছিলে ? আমি ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলাম না , আমার পোড় খাওয়া , সেকেলে পরিবার আমাকে সংগ্রাম শিখিয়েছে , ভালোবাসা নয় । তবুও আমি জানি না কখন নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম তোমার সাথে ।

কখন এই সংগ্রামের দিনগুলিতে তোমার হাতকে নিজের হাতের মতো মনে হতে লাগল । একদিন সকল রূপকথার গল্পের মত আমাদের দিন শেষ হয়ে গেল । কার্জন হলের আলো আঁধারির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল ; হয়তো আবার কখনো আসব ফিরে - হয়তো মানুষ নয় ........ না , প্রিয়তা । মানুষ আর কখনোই হয়ে ওঠা হয়নি আমার । অমানুষের মত ছুটে গেছি অফিস থেকে অফিসে ।

যেই পুঁজিবাদ আমার অজন্ম শত্রু ছিলো , যেই আমলাতণ্ত্রকে ঘৃণা করে গেছি আজীবন , তাদের দরজাগুলোতে বিকিয়ে দিলাম আমার আত্নসম্মানবোধ । "ভাত দে হারামজাদা , নাহলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো " - কথাগুলি ভীষণ সত্যি মনে হয়েছিলো সেইদিন । রাতে মেসে ফিরে ঘুম হতো না , বাসার চিঠিগুলো একসময় পড়া বন্ধ করে দিলাম । বিড়ি খাওয়া শুরু করলাম । সারাদিন কাটত রাস্তার পাশের দু'টাকার রুটি আর হোটেলের লোহাগন্ধী পানি খেয়ে ।

তোমার সাথে দেখা হত প্রতি বৃহস্পতিবার । প্রতিবার তুমি একটু করে শুকিয়ে যেতে , একটু করে কম কথা বলতে । তোমার অপূর্ব চোখদুটো নিচে জমা কালি আমায় বলে দিত , আমার ভালোবাসার মানুষটি অনেকদিন ঘুমুতে পারেনি ঠিকমতো । তবু্ও সেই কালিপড়া চোখের নিচেই ছিলো আমার ভালোবাসা । আমার সারা সপ্তাহের ক্লান্তি আর অপমানের আশ্রয়স্থল ।

আমি আমার সব অনুযোগগুলি শোনাতাম তোমায় । সস্তা পার্কের নোংরা বেঞ্চে বসে তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে । আহ্ ! প্র্রিয়তা । যদি আর একবার কখনো ফিরে পেতাম সেই দিনগুলি । কোথায় যেন একটা চাকরি জুটে গেল তোমার ।

আমার আনন্দ দেখে কে ? নিজেকে মনে হল বিশ্বজয়ী , তোমার সাফল্যে , প্রিয়তা , আমার প্রিয়তা , আমাদের কষ্টের দিনগুলি কি শেষের দিকে ? প্রশ্নটির উত্তর জানা ছিলো না আমার । জানা ছিলো না ভবিষ্যতের কথা । ভাবতেও ইচ্ছা করত না কখনো । আমার শুধু জানা ছিলো , তুমি আছো । আমার চারপাশ জুড়ে , মেঘের মত , আমায় ঘিরে ।

মাস শেষে আমার বারণ সত্ত্বেও পকেটে টাকা গুঁজে দিতে তুমি । সেই টাকাগুলি না হলে , হয়তো আমি সেদিন না খেয়ে মারা যেতাম , বিনা চিকিৎসায় ; হয়তো সেই ভালো ছিলো । কয়েক বন্ধু মিলে ব্যবসা শুরু করলাম । বন্ধুদের নতুন করে চিনলাম , হাতের শেষ টাকাগুলো জলে গেল । একদিন রাস্তায় রাখা রড পায়ে গেঁথে গেল , ওষুধ কেনার টাকা ছিলো না ; তুমি খবর পেয়ে ছুটে এলে ।

মনে আছে , প্রিয়তা ? তোমার চোখে জলে ভিজে যাচ্ছিল আমার ক্ষত । আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম হঠাৎ । ভীষণ জ্বর । তুমি চাকরি ফেলে ছুটে এলে আমার কাছে । হয়তো মরে যেতাম সেদিন ।

ভীষণ দোষারোপ করেছি তোমায় বাঁচাবার জন্য , হয়তো মরে যাওয়াটাই ভালো ছিলো আমার জন্য । এরপর একদিন এলে আমার কাছে । মনে আছে সেদিনের কথা , প্রিয়তা ? আমি তো চাইলেও ভুলতে পারিনা । তোমার সাখে আমার শেষ দেখা । সেই শেষ দেখা ।

আমি তখনো পুরোপুরি সুস্থ হইনি , জ্বরটা বেশ ভোগাচ্ছিল । তুমি এলে , হাতে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট । ভেবেছিলাম খাবার এনেছ । কিন্তু , প্যাকেটে দেখি টাকা । অনেকগুলো টাকা ।

আমি অবাক হয়েছিলাম খুব । তুমি কোথায় পেলে এত টাকা ? উত্তরে মৃদু হেসেছিলে তুমি , " ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছি তোমার জন্য । তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো তাড়াতাড়ি , তারপর ব্যাবসা শুরু করো । সব ঠিক হয়ে যাবে , সবকিছু " আমার অন্ধকার ঘরে আমি দেখিনি তোমার চোখের অশ্রু সেদিন । আমি তোমার সবগুলো মিথ্যা সেদিন মুগ্ধ শ্রোতার মত শুনে গেছি শুধু ।

নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্নে পোড়া চোখ চকচক করে উঠেছিলো আনন্দে । যাবার সময় পিছনে ফিরে কি দেখছিলে ওভাবে ? কেন দেখছিলে ? তুমি তো জানতে , সেই দেখাই শেষ ছিলো । অনেকদিন তোমার কোন খোঁজ ছিলো না । আমি সুস্থ হয়েই ব্যবসার কাজে লেগে পড়েছিলাম । এবার একা , আর বুকে কোন এক মানুষের দেয়া ভালোবাসা ।

যখন তোমার কথা মনে পড়ল , ভাবলাম তোমার অসুখ করেনি তো ? ছুটে গেলাম তোমার বাসায় । বাড়িওয়ালা জানাল , গত দুমাস সেই বাসায় আর কেউ থাকে না । ছুটে গেলাম পাড়ার ফার্মেসীতে অজানা আশঙ্কায় । সেখানে আমার টেলিফোন ধরতে তুমি আসতে , কিন্তু তারা্ও জানে না তুমি কোথায় থাকো ? আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম দুশ্চিন্তায় । তোমার সবগুলো বান্ধবীকে খুঁজে বের করলাম , কারও সাথে তোমার যোগাযোগ নেই ।

অখচ দুই সপ্তাহ আগেও তুমি ওদের গল্প করেছ আমার কাছে । সত্যি কি , আমি জানতাম না । আমার জানবার প্রয়োজনও ছিলো না । আমার পৃথিবী ছিলে তুমি , এই চির ভালোবাসাহীনের ভালোবাসা ছিলে তুমি । আমি সেই সময়টা ভুলতে পারিনা কিছুতেই , প্রিয়তা ।

প্রতিদিন সকালে বের হতাম তোমার খোঁজে । ফার্মগেটে , নীলক্ষেত মোড়ে , শাহবাগের জ্যামে - হাজার হাজার মুখের মাঝে খুঁজে ফিরতাম তোমাকে । কখনো কারো চোখ দেখে দৌড়ে যেতাম , হতাশায় মারা যেতে ইচ্ছে করত ভীষণ । আমি কখনো ভাবিনি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এভাবে । হাসপাতালের প্রতিটি বেডে হন্য হয়ে খুঁজতাম তোমায় অজানা আশঙ্কায় ।

মর্গের লাশের মাঝে দেখতাম লোনা চোখে , খুঁজতাম তোমার নাম পুলিশের খাতায় .............. আর এভাবেই তোমাকে খুঁজে পাই একদিন । এক সাব-ইন্সপেক্টর আমার অবস্থা দেখে নোট করে রেখেছিলেন তোমার নাম । একদিন আমাকে ডাকেন তিনি । হন্য হয়ে ছুটে যাই আমি । আমাকে বসতে বলেন তিনি ।

তারপর আমার হাতে তুলে দেন তোমার কিছু ছবি । বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকি আমি । যদি তিনি বলতেন তুমি মারা গিয়েছ , তাতেও এতটা আহত , এতটা হতবাক হতাম না আমি । আমার দেহে কোন প্রাণ ছিলো না , অসাড় হাত থেকে কখন যেন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল তোমার অর্ধনগ্ন ছবিগুলো । তিনমাস আগে , তোমাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিলো এক সস্তা হোটেল থেকে , পতিতাবৃত্তির অভিযোগে ।

সেদিন সেই পুলিশ থানার সস্তা চেয়ারে বসে আমি অনুভব করেছিলাম , কোন চাকরি তুমি করতে আমার খরচ যোগাবার জন্য । আমি বুঝতে পেরেছিলাম , তুমি আমাকে কতখানি ভালোবাসতে । বুঝতে পেরেছিলাম , প্রতিরাতে , আমার মুখের কথা ভেবে তুমি নিজেকে বিলিয়ে দিতে কোন নোংরা পশুর হাতে । পরে জানতে পেরেছি , তোমার সব কথা । তুমি চলে গেছ দূরে , একতাড়া নোটের বিনিময়ে কোন রাক্ষসের হাতে সারাজীবনের মত নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ।

তোমার হাতের সেই নোটের প্যাকেট ....... আমি জানি না , আজ । তুমি কোখায় আছো ? জানিনা , কেমন আছো ? কিন্তু বিশ্বাস করো , প্রিয়তা , আজ অবধি কখনো , কখনো তোমাকে একবারের জন্যও দোষী মনে হয়নি । পাপী মনে হয়নি । নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়েছে তোমার কাছে বারবার । আজ , তোমাকে ভীষণ বলতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তা , আমি এখন্ও তোমায় ভালোবাসি , যতখানি বাসতাম , যতখানি বাসা আমার পক্ষে সম্ভব ; হয়তো তারচেয়েও বেশি ।

যেখানেই থাকো , যদি এই লেখা কখনো তোমার চোখে পড়ে , আমায় ক্ষমা করো । আমায় ক্ষমা করো আমার অক্ষমতার জন্য , আমার দু'হাত সামান্য ছিলো তোমার ভালোবাসার জন্য । যেখানেই থাকো , ভালো থেকো ।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.