তোমার সাথে আমার পরিচয়য় একেবারে ছোটবেলা থেকে। তখন থেকেই আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত রকমের সখ্যতা! আমার স্বপ্নময় মুহূর্তগুলোতে বরাবরই তোমার উপস্থিতি ছিল। তোমার মনে আছে? বেশিরভাগ সময়েই আমাদের মিলন হতো আমাদের বাসার ছাদে। আমি আমার ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে চলে যেতাম শুধু তোমায় আরেকটু ভালো করে পাবার জন্য। অনেক ঝুঁকির ব্যাপার ছিলো সেটা।
আশেপাশের অন্যান্য বাসার থেকে প্রতিবেশীরা ছাদে আমাদের এই বেলেল্লাপানা দেখতো। তারা কি মনে করতো কে জানে? কিন্তু তোমাকে আরও আপন করে পাবার জন্য যে আমি যে কিছুই কেয়ার করতাম না। তোমায় নিয়ে নাচতাম, খেলতাম, অনুভব করতাম একেবারে হৃদয় থেকে!
স্কুল থেকে ফেরার সময় কদাচিৎ আমাদের দেখা হতো। তখন সারা রাস্তাজুড়ে আমি তোমায় নিয়ে মাতামাতি করতাম। আশেপাশের মানুষজনের দিকে হুঁশ থাকতো না।
আমাদের বাসায় তোমাকে নিয়ে খুব একটা আপত্তি ছিল না। সবাই তোমার কথা জানতো। তোমাকে খুব পছন্দও করতো। তোমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাসও ছিল। একবার মনে আছে, তুমি আর আমি আমাদের বাসার ছাদে শুধুই দু’জনে সময় কাটাচ্ছিলাম।
হঠাৎ করে চাচ্চু এসে ঢুকলেন। আমি ভয়ে ছিলাম, না জানি কি বকা দেন। কিন্তু তিনি মোটেও রাগ করলেন না। বরং আমাদের প্রশ্রয়ই যেন দিলেন। মাঝে মাঝে তুমি যখন আসতে তখন আমরা ছাদেই তোমাকে সহ ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম।
নিছক আনন্দের জন্য যে খেলা খেলতাম, সেটা কি তোমাকে ছাড়া কখনও অনুভব করা যেতো, বলো?
হঠাৎ হঠাৎ শুক্রবার দুপুরে অথবা বন্ধের দিনের দুপুরে, রাতে তুমি হাজির হতে। তখন তোমার উপলক্ষ্যে বাসায় বিশেষ খাবার রান্না হতো। আমাদের পারিবারিক আনন্দের একটা অন্যতম উপলক্ষ্য ছিলে তুমি, সবসময়! তোমাকে ভালোবাসতে শিখেছি তো আমি আমার পরিবারের প্রশ্রয়েই, একেবারেই নির্ভয়ে! আমরা কতদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করেছি! আমার বারান্দার ঠিক ওপারেই তোমার বাসা ছিল। আমি গল্প করতে করতে, তোমায় হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইতাম। তুমিও কত দুষ্টু ছিলে আমাকে জড়িয়ে ছুঁতে চাইতে।
এই মুহূর্তগুলো যে এখন চাইলেও পাই না, আর পাবোও না। বারান্দা দিয়ে তোমার হাত ছুঁতে পারার যে শিহরণ সেটা কি অন্য কিছুর সাথে তুলনা করবার মতো বলো?
তোমার সেই রাতের কথা মনে আছে? আমাদের একসাথে কাটানো একমাত্র রাত ছিল সেটা। সেরাতে নীল জোছনা ছিল। প্রতি পঞ্চাশ বছরে একবারই সেটা আসে। আমি মুগ্ধ হয়ে জোছনা দেখছিলাম, ছাদে বসে।
একেবারেই না জানিয়ে হঠাৎ করে রাত ২টার পরে তুমি এলে। সত্যি বলছি, সেরাতে তোমাকে হঠাৎ করে এভাবে পেয়ে আমার কোন ভয় হয়নি। বরং মনে হয়েছে পঞ্চাশ বছরের অনন্য এই রাতে তোমার আমার মিলন অবশ্যম্ভাবী ছিল। তুমি আমার সারা শরীর ছুঁয়ে দিতে এসেছিলে। আর আমি তোমাকে উদ্দামতা নিয়ে অনুভব করেছিলাম।
আমার জীবনের স্মরণীয়তম রাত ছিল সেটি। এখনো আছে! তোমার কক্সবাজারের কথা মনে আছে? আমার জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখা! আমি হোটেল থেকে একা বেরুলাম সমুদ্র দেখব বলে। বের হবার সাথে সাথে আমাকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে তোমার আগমন। তারপর সমুদ্রে আমাদের দুজনের সেকি ঝাপাঝাপি! তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম, আমাদের মিলন অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতি নিজেই যেন আমার অনন্য মুহূর্তগুলোতে তোমায় সঙ্গী করে পাঠায়।
তুমি আমাকে প্রথম রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলে। নিজের মনের অবস্থার কথা, তোমার রূপের বর্ণনা আমি ঠিক যেভাবে মনে করতে চাই, গুরুজী কিভাবে জানি অনেক আগেই তা লিখে গেছেন? তোমার সাথে আমি নাচতাম, "মম চিত্তে নিতি নৃত্যে, তা তা থই থই, তা তা থই থই"। তোমার মনে পড়ে?
মনে পড়ে, তোমার সাথে আমার শেষ দেখার কথা। আমেরিকা আসার আগে প্রচন্ড ব্যস্ত আমি। তখনও জানতাম না সেটিই আমাদের শেষ দেখা।
তাই তোমাকে ঠিকমতো সময় দিতে পারিনি। এখনও প্রচণ্ড আফসোস হয়। তারপর, তারপর গত আড়াইটি বছর ধরে আমি তোমায় ছাড়া আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি হাজির হও। কিন্তু আমার মনে তো দোলা দিয়ে যাও না।
বছরের এই সময়টা এলে বিশেষ করে এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত যখন ফেসবুকে তোমার খবর নিয়মিতই পাই, যখন শুনি তুমি সবাইকে নিজের সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছ, তখন তোমায় বড় অনুভব করি। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অপবিত্র মনে হয়। তখন তোমার ছোঁয়া পেতে খুব ইচ্ছে করে, নিজেকে বিশুদ্ধ করবার জন্য তোমার সাথে জলকেলী করতে ইচ্ছে করে। ও "বৃষ্টি", আমি আবার কবে তোমার দেখা পাবো? তুমি কবে আবার আমায় তোমার পূণ্যজলে সিক্ত করবে? তুমি যে আমার প্রথম প্রেয়সী, একেবারে ছোটবেলা থেকে, আমার প্রতিটি মুহূর্তে!
---
প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্ত হচ্ছে বৃষ্টির সময়টা। প্রকৃতির এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মধ্যে অনেক পাগলামী আছে, অসংখ্য স্মৃতি আছে।
প্রত্যেকটি স্মৃতি আলাদা করে রচনা একটি মহাকাব্যের(?) জন্ম দিতে পারে। তারপরও এই লেখাটি নিখাদই একজন বৃষ্টিপ্রেমীর মনে, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত থেকে দূরে থাকবার যন্ত্রণা থেকে লেখা। বিরক্তির উদ্রেক করলে নিজ গুণে ক্ষমা করবার অনুরোধ রইল। আমি বৃষ্টি ভালোবাসি।
btw, লেখার ঠিক কোন জায়গা থেকে মূল বিষয়টা স্পষ্ট বুঝা যায়, সেটা একটু কষ্ট করে জানালে ভালো হয়।
আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব পরিচয় গোপন রাখতে। কতটা পেরেছি সেটা জানানোর জন্যই সমালোচনার দুয়ার খোলা
--শেখ মিনহাজ হোসেন
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।