ভালোলাগে ভেসে বেড়াতে অন্ধকারের ব্যক্তিগত ছায়ায়.....
‘একসময় এই তিতাসের সব দিক দিয়ে চলত লঞ্চ। ... জেলেদের হাসিখুশি জীবন। তিতাসজুড়ে মাছরাঙা, পানকৌড়ি, গাংচিলের কলরব। বকের ঝাঁক। পাল তোলা নৌকার ভিড় থেকে ধেয়ে আসা মাঝিমাল্লাদের সুরেলা কণ্ঠ।
নদীর পাড় গায়ের বধূদের কলসি কাখে পানি আনার দৃশ্য। ’ কবি জয়দুল হোসেন এভাবেই বর্ণনা করছিলেন তিতাসকে। কিন্তু তিতাসের এই চিত্র আজ অনেকটাই রূপকথার মতো। ২০ বছর আগেও যেন এই চিত্রকে রূপকথা বলার সাহস কেউ পেতাম না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর প্রাণের তিতাস।
খুব কম জেলাবাসীই হয়তো আমাদের মতো ভাগ্যবান যাদের কূল কোল ঘেষে গেছে তিতাসের মতো এমন নদী। মেঘনা নদীকে বলা হয় তিতাসের দহিতা। মেঘনারই একটি শাখা নদী এটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাতলপাড় গ্রাম থেকে তিতাসের সৃষ্টি। সেখান থেকে নাসিরনগর, হরিণবেড়, হরিপুর, শাহবাজপুর হয়ে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আখাউড়ায় গিয়ে মিলিত হয়েছে তিতাস।
উজানিশার থেকে আবার প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে শহরের গোকর্ণ ঘাটের দিকে। গোকর্ণ ঘাট থেকে এর শাখা চলে গেছে নবীনগরে। ওদিক দিয়ে আবার একটি শাখা মিলিত হয়েছে মেঘনা নদীর সঙ্গে। একসময় প্রায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়টি উপজেলার সাতটির মধ্যেই লঞ্চ যাতায়াত ছিল। কিন্তু এখন শুধু মাত্র গোকর্ণ ঘাট থেকে নবীনগরের সঙ্গেই আছে লঞ্চ যোগাযোগ।
আর বর্ষায় ইঞ্জিনের নৌকায় বেশ কিছু জায়গায় যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপিত হয়। তবে নদীতে গিয়ে কদাচিৎও দেখা মেলে না পাল তোলা নৌকার। ইঞ্জিনের নৌকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সে যেন কবেই তার পরাজয় মেনে নিয়েছে।
গোকর্ণ ঘাটের তিতাস পাড়ে গিয়ে দেখা মেলে মালু পাড়ার জেলে সম্প্রদায়ের গৌর বর্মণের সঙ্গে। পেশায় মৎসজীবী।
চেহারায় যেন দুনিয়ার হতাশা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছেন। ’ উত্তরে বললেন, ‘বালা নাই বাবা। আমরা জাল্লা। মাচ দইরা জীবন চালাই।
কিন্তু তিতাসে মাচই নাই জীবন চলব কীভাবে?’
এসবের পরও বর্ষার এ কয়টা দিন সংকীর্ণ হয়ে আসা তিতাসের রূপ দেখলে মন উৎফুল্লতায় ভরে ওঠে। উফ! অসাধারণ। স্কুলজীবনে বন্ধুরা দল বেঁধে তিতাসে যেতাম আর একজনের কাঁধে উঠে আরেকজন লাফিয়ে পড়তাম নদীতে। এ মৌসুমে আপনারাও যদি আসেন তাহলে নিশ্চিত তিতাসকে আলিঙ্গন করতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আর যখন অপরিচিত কাউকে বলি বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া তখন একটা হাসি দিয়ে বলেন, ‘ওহ তিতাস পাড়ের সন্তান।
’ তখন গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। পরক্ষণেই তিতাসের বুকে চড় পড়া, অবৈধ দখলে আস্তে আস্তে দুই পাড় সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, আবর্জনা ও ইঞ্জিনের নৌকার কারণে পানির দূষিত হওয়ার কথা মনে পড়লে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।
অদ্বৈত মল্ল বর্মণ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম-এ সে সময়ই ফুটিয়ে তুলেছিলেন জেলেদের দুঃখ-দুর্দশা। আভাস দিয়েছিলেন আজকের তিতাসের করুণ ছবি। কিন্তু আমরা যেন কবির মতো করে দেখতে পাইনি।
হতে পারিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। কিন্তু আজ তিতাসকে খনন করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে না আনলে যেন আমাদের প্রাণের নদী একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
আজ প্রথম আলোতে ছাপা এই লেখা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।