খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
ঘুমের মতন নীরবে নদী
যায়, বয়ে যায়৷৷
দু'কূলে তার বৃক্ষেরা সব
জেগে আছে;
গৃহস্তের ঘর-বাড়ি
ঘুমিয়ে গেছে,-
শুধু পরান মাঝি বসে আছে
শেষ খেয়ার আশায়৷
যায়, বয়ে যায়৷৷
কে জানে কবে কে নাম রেখেছে
তিতাস তোমার;
যে নামেই ডাকি তোমায়
তুমি কন্যা মেঘনার৷
মোষের মতন কালো সাঁঝ
নামে তীরে;
আবহমান উলুধ্বনি
বাজে ঘরে ঘরে,-
পোহালে রাত ফর্সা ভোর
আসে নদীর নামায়৷
যায়, বয়ে যায়৷৷ ( যে নদীর নাম তিতাস/ উত্সর্গ পত্র- ঋত্বিকমঙ্গল, বাংলা একাডেমী ঢাকা,2001)
খুব একটা বড় নয় পাড়াটা, পনেরো কুড়ি ঘর মানুষের বাস ৷ গ্রামের ভেতরে ছোট্ট আরেক গ্রাম ৷ এই গ্রামে আমার পূর্ব পুরুষের বাস ৷ আমরা থাকি এ'পাড়ায়, গ্রামের ভিতরের আরেক ছোট্ট গ্রামে ৷ গ্রামের ভিতরের সেই গ্রামে এ ঢুকতে প্রথম বাড়িটাই আমাদের ৷ হাতের ডানদিকে এর পরে নজরুল ইসলামেরা থাকে৷ নজরুল ইসলামের বুড়ো মা, বাপ ছোট ভাই তাজুল ইসলাম বোন সেলিনা, চায় না ৷ চার ভিটায় চারটে ঘর৷ নজরুল ইসলাম বিয়ে করে বউ এনেছে চর থেকে, তিতাসের চর৷ বৌ সব সময় এক হাত ঘোমটা টেনে রাখে৷ দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি আর কোমরে বিছা৷ সে শাড়ি পরে গোড়ালির বেশ খানিকটা উপরে ৷ সারাদিন এই ঘর ঐ ঘর করে, একচালায় বসে রাঁধে আর যখন কাজ থাকে না তখন বসে বসে কাঁথায় ফুল তোলে৷ নকশী কাঁথা বানায় বৌ ৷ তার ঐ এক হাত লম্বা মাথার কাপড় তখন কপাল পর্যন্ত উঠে৷ দেখা যায় বৌএর নাকে নোলক গলায় তক্তিছড়া৷ নজরুল ইসলামের এই বৌ আমায় আম্মা বলে ডাকে৷ আমার খুব মজা লাগে৷ আমারে আম্মা ডাকো ক্যান জিজ্ঞেস করলে বৌ মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে, আফনেরে আম্মাই তো কমু, আফনে যে আমাগো সাব বাড়ির মাইয়া! শামসুল নজরুল ইসলাম চাচার ছেলে, ছোট্ট ছেলেটা অসম্ভব দুষ্টু৷ দু দন্ড সে মায়ের কাছে থাকে না, সারাক্ষণই ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক৷ ন্যাংটো ছেলের কোমরে কালো সুতোয় বাঁধা একটা ছোট্ট রূপোর ঘন্টা৷ পুঁচকে শামসুল কোথয় যায় না যায় মা যেন সর্বক্ষণ সেটা জানতে পারে তাই সে ছেলের কোমরে ঘন্টা বেঁধে দিয়েছে৷ ছেলে যেদিকেই যায় ঝুম ঝুম শব্দ হয় সেই ঘন্টা থেকে৷ তাদের বাড়ির ডানপাশ দিয়ে গেছে ছোট্ট খাল৷ সুদিনে সেই খালে জল থাকে না কিন্তু বর্ষার নিথর জল উঠে আসে বাড়ির উঠোন অব্দি৷ বউ ছেলেকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে সে ঐ খালের দিকে যায় কি না৷ তার সজাগ কান সর্বদাই ছেলের কোমরের ঐ ঘন্টায়৷
নজরুল ইসলাম আমাদের বাড়িতে বছর বান্ধা মুনিষের কাজ করে৷ সারাদিনে তিন চার বার ঘুরে ঘুরে নজরুল ইসলামদের বাড়িতে যাই, নজরুল ইসলামদের বাড়ির দাদা মুসা লস্কর , সবাই যাকে মুসা পাগলা বলে ডাকে৷ কেন যে সবাই দাদাকে পাগলা বলে! দাদা তো কাওকে বকে না, কারোর সাথে ঝগড়া করে না দাদা সারাদিনই শুয়ে বসে গান করে,
বাড়ি বাড়ি কর তোমরা
এই বাড়ি তো বাড়ি নয়
আসল বাড়ি গোরস্থানে
একবার যেন স্মরণ হয়৷
দাদি সারাদিনই তার ঘরের ভিতরেই থাকে৷ সারাদিন হাতে একটা সেলাই নিয়া থাকে, কোন সময় একটা কাঁথা তো কোন সময় ছেঁড়া কোন জামা ৷ আমি গেলে সসম্মানে পিড়া এগিয়ে দেয় বসার জন্যে ৷ আমি চুপ করে বসে থাকি দাদিদের ঘরে ৷ ওদের ঘরে কোন খাট-পালঙ নাই, ঘরের চারপাশে দড়ি টানানো আছে তাতে জামা কাপড় ঝোলে আর ঘরের কোনায় গুটিয়ে রাখা থাকে মাদুর, আর কিছু কাঁথা বালিশ ৷ কিছু কাঠের পিড়ি আছে নিজেও ওতেই বসে অর কেউ গেলে তাকেও পিড়ি পেতে দেয় বসার জন্যে ৷ দাদির ঘরের কোনায় ভাঙা কলসিতে খড়ের উপর বসে আছে এক মুর্গী ৷ যে ডিমে তা দিচ্ছে, দাদি বলেছে দুই সপ্তা হইয়া গ্যাসে আর এক সপ্তা গেলেই বাচ্চা লইয়া উঠব এই খুপাওয়ালা লাল মুর্গী ৷ তেরখানা ডিম নিয়ে বসেছে এবার এই লাল মুর্গী, দাদি খুব চিন্তায় আছে, কোন ডিম নষ্ট হয়ে যায় কি না সেই দুশ্চিন্তা ৷ প্রতিবারই নাকি দু-একটা ডিম নষ্ট হয়, ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বেরোতে থাকে তখনও মুর্গী ডিমের উপরেই বসে থাকে, একটা একটা করে বাচ্চা সারাদিন ধরে বেরোয় ৷ কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে এক আধটা কলসির বাইরে নিচে পড়ে গেলে দাদি গিয়ে তাকে আবার কলসিতে তুলে দেয় ৷ অর ঐ খোঁপাওয়ালা লাল মুর্গী তখন গরর গরর করতে থাকে, দাদি মুর্গিকেই বকে দ্যায়, ঐ চুপ কর! আন্ডা লইয়া তো বইয়া রইসস, ছানা যে নিচে পইড়া গ্যাসে খবর আসে নি? ওম না পাইয়া যদি মইরা যায় ছানা?? বকুনি খেয়েও মুর্গী চুপ করে না৷ গরর গরর করতেই থাকে৷ খানিক পর পরই দাদি এসে মুর্গীর ডানা ধরে তুলে দেখে, ক'টা ছানা বেরুলো ৷ সবকটা ডিম না ফোটা অব্দি দাদির শান্তি নেই ৷ দাদির ঘরে কোনায় এরকম আরও তিনখানা ভাঙা মাটির কলসি রাখা আছে, তাতে মুর্গীরা এসে ডিম পেড়ে রেখে যায় ৷ দাদি ঐ ডিম কাওকে খেতে দেয় না আর বিক্রীও করে না ৷ সে বাচ্চা ফোটাবে ঐ ডিম দিয়ে৷ ডিমে সে নিজেও হাত দেয় না আর অন্য কাওকেও ছুঁতেও দেয় না, ডিমে হাত দিলে কিংবা ছুঁলে 'ওম' ভেঙে যায়, তখন সেই ডিমে আর বাচ্চা ফুটবে না৷ ৷ ঐ ভাঙা কলসিগুলো সে ঢেকে রাখে কুলো দিয়ে ,মুর্গীর আসার সময় হলে কুলো সরিয়ে দেয় অর নিজে দোর আগলে বসে থাক কোন সময় দাদি কিসসা শোনায়৷ লস্কর বাড়ির কিসসা ৷ এই পাড়ার কিসসা ৷ গাঁওয়ের ভিতরের ছোড আরেক গাঁওয়ের কিসসা ৷
নজরুল ইসলামদের বাড়ির তিন চারটে বাড়ি পরেই কবরস্থান৷ জয়গাটাকে সবাই 'দখিন পাড়' বলে৷ এসামুদ্দিন মিঞার পুকুরের দক্ষিণ পারে ঐ কবরস্থান৷ বেশ চওড়া এক জায়গা সেটা ৷ বাঁশের ঝাড়ে ছেয়ে আছে গোটা কবরস্থান ৷ দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে সেদিকে যেতে ৷ এসামুদ্দিন মিঞা মাষ্টার ছিলেন গ্রামের হাইস্কুলের ৷ বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে তিনি নাকি ছাত্র যোগাড় করতেন ৷ কেউ একদিন স্কুলে না গেলে সন্ধ্যেবেলায় তিনি তার বাড়ি পৌঁছে যেতেন, কেন সে স্কুলে গেল না খোঁজ নিতে ৷ এই পাড়ায় মেয়েদের নাকি স্কুলে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না, বলেন এসামুদ্দিন মাষ্টারের স্ত্রী, আমি যাকে বড়মা বলি ৷ তিনি বলেন,এই পাড়ায় আজ মেয়েরা স্কুলে যায়, স্কুল পাশ কইরা টাউনের কলেজে যায়, কেউ কেউ আবার গ্রামেরই স্কুলের মাষ্টারনি হয় সব তোর বড়বাপের লাইগা ৷ তোর বড় বাপে যদি মাইয়াগো স্কুলে পাঠানোর লাইগা চেষ্টা না করত, নিজে বাড়ি বাড়ি ঘুইরা মাইয়াগোরে ধইরা ধইরা ইশকুলে না পাঠাইতো তয় আইজও এই পাড়ার সব মাইয়া অশিক্ষিত মুর্খ থাকতো!
আমি এসামুদ্দিন মাষ্টারকে কোনদিন চোখে দেখিনি, তিনি মারা গেছেন বহু বছর আগে, কত বছর সেটাও বলতে পারেন না বড়মা ৷ ভুলে ভুলে যান৷ সাদা শাড়ি গিট দিয়ে কোমরে বেঁধে পরে থাকেন৷ গায়ে ব্লাউজও নেই৷ গেটে বাতে কাবু হয়ে বেশির ভাগ সময়েই মাটির মেঝেতে খড়ের উপর পাতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুরনো দিনের গল্প করেন৷ ব্যাথা কম থাকলে ঢেকিতে ধান বানেন ৷ শোলার বেড়ার বাইরে থেকেই শোনা যায় ধেকিতে ধান বানার শব্দ ৷ আমি বুঝতে পারি বড়মার আজকে ব্যাথাটা কম ৷ এপাড়ায় চালকল নেই, ধান ভাঙাতে হলে নিয়ে যেতে হবে বাজারে ৷ আর বাজার বেশ দূরে, তার উপরে কখন সেই চালকলে কারেন্ট থাকবে সে কেউ জানে না ৷ রহিম আলি তাই ধান নিয়ে যেতে চায় না বাজারে ৷ বলে এই কয়ডা চাল তো ভাঙাইবেন, তার লেইগ্যা অত দূরে যামু আর ফিরত আমু কারেন্ট না থাকলে তার থেইক্যা বরং ঢেকিত কয়ডা পাড় দিয়া বাইন্যা ফেলাইন ধানডা! আমি দিয়া দিমু নে ঢেকিত পাড়৷ কিন্তু ঢেকিতে পাড় দেওয়ার জন্যে রহিম আলিকে খুঁজে পাওয়া যায় না ৷ তাই বড়মা ঠুক ঠুক ধান বানেন (ধান ভেঙে চাল করা) সকাল থেকে ৷ ধান বানা হলে সেই চালে ভাত রাঁধবে নুরুন্নাহার ৷ নুরুন্নাহার বড়মার মেয়ে ৷ একবার সে পাগল হয়ে গিয়েছিল তাই তাকে আর শ্বশুরবাড়িতে নেয় না ৷ নুরুন্নাহার ফুফু তাই বাপের বাড়িতেই থাকে ৷ বড়মা বলে নুরুন্নাহার ফুফু এখন নাকি আর পাগল নয় শুধু মাঝে মাঝে একটু মাথার গন্ডগোল হয় ৷ তখন সে কাওকে চিনতে পারে না, নিজের মাকেও নয়, সারাদিন শুধু লাভলি লাভলি বলে চীত্কার করে কাঁদে ৷ লাভলি নুরুন্নাহার ফুফুর মেয়ে ৷ শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পাগল বলে বৌকে বাপের বাড়ি ফেরত পাঠিয়েছে কিন্তু ছোট্ট লাভলিকে তারা দেয়নি ৷ বড়মা বলে, মেয়ে কাছে থাকলে নাকি নুরুন্নাহার ফুফুর মাথাও খারাপ হত না৷ লাভলিকে তোমরা লইয়া আসো না ক্যান বড়মা? বড়মা বলে, তারা দিব কিয়ের লাইগ্যা? আমার পুড়া কপাল, মাইয়াডার মাথায় দোষ পড়লো, নইলে সোনার সংসার আসিল নুরুন্নাহারের ৷ সোনার সংসার কাকে বলে ভেবে না পেয়ে আমি চুপ করে থাকি ৷
বড়মার দুই ছেলেই শহরে থাকে৷ রফিক কাকা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরী করে আর শফিক কাকা কলেজে পড়ে ৷ আমি বড়মাকে বলি, তুমি শহরে চইলা যাও না ক্যান কাকাগো কাছে? বড়মা বলে, রফিকের বেতন যে বড় কম, শফিকের কলেজের পড়া, বাসা খরচ এর পরে আমরা যদি যাই তো সংসার ক্যামনে চলব? বাড়িত থাকলে তো রহিম আলিরে দিয়া ক্ষেতের কাম করাই তো বছর ভরা চাল কিনা লাগে না খালি আনাজ-তরকারি কিনা, তাও বেদনা কম থাকলে আমি নিজে মাচা বাইন্ধ্যা শিম, লাউ, কুমড়ার গাছ তুইলা দেই ৷ বেশির ভাগ দিনেই মাচার লাউ, কুমড়ো রান্না করে নুরুন্নাহার ফুফু ৷ মাঝে মাঝে নুরুন্নাহার ফুফু পুকুর থেকে তুলে আনে কলমি শাক, কোনদিন বা পুকুরের ঢাল থেকে বেছে বেছে তুলে হাইসা শাক ৷ যেদিন তার মাথা গরম হয় সেদিন সে সারাদিন কাঁদে মেয়ের জন্যে ৷ সেদিন আর রান্না হয় না বড়মার ৷
পুকুরের ঠিক দক্ষিণপারে কবরস্থানের গায়ে গায়ে সখিনাদের বাড়ি ৷ সখিনা মইজুদ্দিন লস্করের মেয়ে৷ মাইজুদ্দিন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠায়নি, পাকা চুল আর মুখভর্তি পাকা দাড়ির হাসন আলিকে ঘরজামাই করে বাড়িতে এনে রেখেছে৷ হাসন আলি জন খাটে ৷ ফসল বোনার সময় সে রোজ কাজ পায়, আবার ধান কাটার সময়েও তার কাজ থকে, কিন্তু বছরের বেশ অনেকটা সময় হাসন আলি বেকার থাকে ৷ তখন সে বাড়ির উঠোনে বসে ফুড়ুত্ ফুড়ুত্ হুকো টানে৷ মইজুদ্দিন বুড়ো সারাদিন উঠোনে বসে বাঁশ চেঁচে চেঁচে বেত বানায়৷ সখিনা সেই বেতে চাটাই বোনে, গোলা বানায় ৷ ধানের গোলা ৷ সখিনা যাকে বলে 'টাইল'৷ সখিনার বানানো এই টাইল বেশি বড় নয়, মাঝারি আকারের সব টাইল৷ হাসন আলি সেই চাটাই, টাইল নিয়ে সপ্তায় দু'দিন দূরের হাটে যায়৷ একদিন চান্দুরা তো আরেকদিন জলসত্বর ৷ সি এন্ড বি'র বড় সড়ক ধরে গেলে গ্রামের ডানদিকে জলসত্বর আর বাঁদিকে চান্দুরা ৷ সপ্তাহে দু দিন করে ওখানে বড় হাট বসে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে, কেউ বিক্রী কিরতে তো কেউ কিনতে ৷ বুড়ো হাসন আলি বাঁশের ভারার দুদিকে সখিনার বোনা ধানের গোলা, চাটাই বিক্রী কিরতে নিয়ে যায় ৷ সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে সেদিন সে, কারন তাকে তো হাটে হেঁটেই পৌছুতে হবে, ঐ গোলা সমেত কোন গাড়ি তাকে তুলবে না, কাঁধে ঝোলানো ধানের গোলা নিয়ে দুলতে দুলতে হাঁটে বুড়ো হাসন আলি ৷ সখিনাদের বাড়িতে কোন বেড়া বা আড়াল নেই ৷ বাড়ির পেছনে কবরস্থানের বাঁশের ঝাড় শুরু হয়েছে সখিনার ঘরের ঠিক পেছন থেকে৷ দু'খানা খড়ের ঘর, একটাতে থাকে বুড়ো মইজুদ্দিন আর অন্যটাতে সখিনা ৷ মইজুদ্দিনকে ভয় পায় না এমন ছেলে-পুলে এপাড়ায় অন্তত নেই ৷ কবরস্থানের ওপারের পূবপাড়ায় যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা মইজুদ্দিনের উঠোনের উপর দিয়েই৷ উত্তরগাঁওয়ের প্রাথমিক স্কুল কবরস্থান পেরিয়ে পূবহাটিতে ৷ এই পাড়ার সব ছেলে-মেয়েরাই স্কুলে যায় সখিনাদের বাড়ির উপর দিয়ে ৷ মইজুদ্দিন বেশির ভাগ সময়েই চুপ করে থাকে কিন্তু যখনই কোন ছেলে-মেয়ে তার তোলা বেতের উপরে পা রাখে তখনই সে তাদের হাতের ঐ কাটারি নিয়েই তাড়া করে, ঘরের ভিতর থেকে সখিনা চেঁচায়, বাপজান ও বাপজান, এইবার ক্ষ্যামা দ্যাও না! আর কত চেল্লাই বা ঐ পুলাপানেগো লগে? মইজুদ্দিন গজগজ করতে করতে আবার বাঁশ চেঁচে বেত তুলতে বসে৷ আমি ভেবে পাই না, যে মইজুদ্দিনের সাথে কেউ কথা পর্যন্ত বলে না ভয়ে, সেই মইজুদ্দিননকে সখিনা কি রকম বকুনি দেয় আর মইজুদ্দিনও মেয়ের বকুনি খেয়ে চুপ করে যায়, শান্ত হয়ে বসে কাজ করতে ৷
সখিনা ছাগল পোষে ৷ ছোট দুটো বাচ্চা সহ একটা ছাগল৷ সখিনা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ঐ ছাগল তিনটে বাঁধা থাকে তার একচালা রান্নাঘরের পাশে৷ আর সুযোগ পেলেই সে তার ছাগল এনে আমাদের পুকুর পারে ছেড়ে দিয়ে যায়৷ ছাগলগুলো ইচ্ছে মতন ছোট গাছগুলোকে মুড়িয়ে দেয়, বড়কাকা কতবার রাগ করেছে সখিনার পরে৷ বারণ করেছে ছাগল যেন পুকুরপারে না ছাড়ে, সখিনা চুপ করে শোনে আর ছাগল নিয়ে চলে যায় কিন্তু পরদিনই আবার ছাগল ছেড়ে দিয়ে যায় পুকুরপারে৷ বড়কাকা বলে রেখেছে এবারে যেন ছাগল এনে বাড়িতে বেঁধে রাখা হয় অর সখিনা ছাগল চাইতে এলে যেন না দেওয়া হয় ৷ আমি মনের আনন্দে পরদিন ছাগল ধরে এনে উঠোনের ছোট আমগাছে বেঁধে রাখলাম ৷ কিন্ত কাকা বাড়ি আসার আগেই কখন যে সখিনা এসে ছাগল ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে টেরটিও পাই নি ৷
(চলবে)
শারদীয়া মৈত্রেয়ী ২০০৬ -তে প্রকাশিত
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।