খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
ইসমাইল লস্করের মেয়ে রওশন আরা পালিয়ে গেল বাড়ি থেকে ৷ একদিন সকাল বেলায় তাকে আর কেউ খুঁজে পেল না ৷ মেয়েদের গলার কান্নার আওয়াজে ওবাড়িতে গিয়ে দেখা গেল চম্পা চুপ করে বসে আছে চৌকির উপরে আর তার মা বিলাপ করে কাঁদছে আর বলছে মেয়ে এভাবে চুনকালি দিল সবার মুখে! ইসমাইল লস্কর ঝগড়া ভুলে এসে আমাদের বাংলা ঘরের বারান্দার বেঞ্চে এসে বসে রইল৷ দাদাজি তাকে বললেন, কি করবা মিঞা অহন আর? খোঁজ কর মাইয়া কই গ্যাসে, শাদি বিয়া হইসে না কি এমনিই আছে, খোঁজ পাইলে আইন্যা মান সম্মানের সাথে বিয়া দিয়া বিদায় কর৷ আর কিসু করনের নাই অহন ৷
সখিনার আবার ছেলে হল৷ হাসন আলি মরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই সখিনা আবার বিয়ে করে৷ পূবপাড়ার কাশেমকে৷ যার সাথে সখিনার বহু বছরের "পিরীত' ৷ এবারেও সে শ্বশুর বাড়ি যায় না ৷ তবে এবার আর তার স্বামী ঘর জামাই হয় না ৷ সে তার নিজের বাড়ি আর মইজুদ্দিনের বাড়ি দু বাড়িতেই থাকে ৷ তার নিজের বাড়িতেও তার একটা বউ আছে৷ মইজুদ্দিন এখন আর উঠোনে বসে বাঁশ চেঁছে বেত তোলে না ৷ বেশির ভাগ সময়েই নিজের ঘরের সামনে হুকো হাতে ঝুম মেরে বসে থাকে৷ সখিনা ঠেলে তুললে উঠে গিয়ে স্নান করে, খায় আবার এসে ঝুম মেরে বসে৷ কারও সাথে কথা বলে না ৷ এখন আর ওদের উঠোনের উপর দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় ছেলের দল ভয় পায় না, মইজুদ্দিন যে ওদের আর হাঁক দেয় না ৷
আমাদের বাড়িতে বিয়ে ৷ ছোটফুফুর৷ দাদাজি হজ্বে যাবেন তার আগেই ছোটফুফুর বিয়ে সেরে রেখে যেতে চান৷ দাদি গাছ কাটিয়ে লাকড়ি করাচ্ছেন নজু চাচাকে দিয়ে৷ পাড়ার মেয়ে বৌ রা ঢেকিতে মশলা গুড়ো করছে সারাদিন ধরে৷ গামলা ভর্তি ধনে,জিরে পুকুরের জলে ধুয়ে এনে রোদে শুকানো হয়েছে পাটি পেতে, ঝাল ঝাল লাল লংকা রোদে শুকিয়ে মুচমুচে করা হয়েছে যাতে করে গুড়ো ভাল হয়, মিহি হয়৷ ঢেকিতে লংকা গুড়ো করার সময় নাকে মুখে কাপড় বেঁধে নেয় যারা গুড়ো করে তা সত্বেও হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো চলতেই থাকে৷ বড় ফুফু মেজ ফুফুরা সব তাদের শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে৷ ছোটফুফু সারাদিন উত্তরের ঘরে মাথায় ঘোমটা টেনে বসে থাকে, ঘরে কেউ এলে মাথার ঘোমটা আরও টেনে দেয়৷ কাকিমা এসে বলে, কি গো, তুমি যে অ্যাত্তো বড় ঘোমটা বাপের বাড়িতেই দিসো তো জামাইর বাড়ি গিয়া কি করবা? অহন বহুত সময় আছে, ঘাড় ব্যাঁকা হইয়া যাইব ঘোমটা দিয়া বইয়া থাকতে থাকতে! অহন সোজা হও আর এট্টু ঘুইরা ফিরা বেড়াও! ছোট ফুফু আরও ঝুঁকে বসে৷ রাতে ছোটফুফু আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুই দেখছস তারে? আমি বলি, হ, দেখছি, সুন্দর না! ছোটফুফু আর কিছু বলে না৷
সতীর শীতল শব বহুদিন কোলে লয়ে যেন অকপট
উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে; চন্দ্রশেখরের মত তার জট
উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদে আজ পুনরাগমনে; ( জীবনানন্দ দাশ)
লাল নীল সবুজ হলুদ কাগজের ফুল কেটে কেটে সব দেওয়ালে লাগানো হল, দরজায় জানালায় ঝুলছে ঐ একই কাগজের কাটা ঝালর, রঙীন কাগজের শেকল বানিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হল সারা বাড়িতে৷ সবকটা ঘরের মেঝেতে আল্পনা আঁকল কাকিমা৷ আজকে ছোটফুফুর গায়ে হলুদ৷ সারা বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন৷ কাকিমা বসে হলুদ বাটছে শিলে, এই হলুদ ছোটফুফুকে মাখানো হবে৷ পাশেই গোল হয়ে বসে মেয়েরা সব বিয়ের গীত গাইছে ৷
তুমি পান বাটো, হলদি বাটো তুমি ক্ষীরা বাটো রে ৷৷
মেথি বাটো মেন্দী বাটো তুমি শুন্দা বাটো রে ৷৷
হাঁটু পানিত নাইম্যা কইন্যায় হাঁটু মান করে রে ৷৷
পূর্ণিমার চাঁন নামলো পানিত, দেখো নয়ন মেইল্যা রে ৷৷
কোমর পানিত নাইম্যা কইন্যায় কোমর মান করে রে ৷৷
পূর্ণিমার চাঁন নামলো পানিত দেখো নয়ন মেইল্যারে ৷৷
তুমি পান বাটো, হলদি বাটো তুমি ক্ষীরা বাটো রে ৷৷
ওদের মধ্যে আছে মেজফুফু৷ এক হাতে নিজের বা ঁকান চেপে রেখেছে আর ডাঁন হাত দিয়ে ধরে রেখেছে পাশে বসে গীত গাইতে থাকা জমজম ফুফুর গলা৷ একই ভাবে জমজম ফুফুও নিজের বা ঁহাতে কান চেপে রেখে ডাঁন হাতে জড়িয়ে রেখেছে তার পাশের জনের গলা৷ উঠোনে কলাগাছ কেটে এনে বিয়ের গোসলের "মাওরা' সাজানো হয়েছে৷ চারকোনায় চারটে কলাগাছ পুঁতে ঘিরে দেওয়া হয়েছে রঙীন কাপড়ে, কলাগাছে জড়ানো হয়েছে লাল নীল সবুজ কাগজের শেকল আর ছোট ছোট তেকোনা করে কাটা কাগজ৷ সেই মাওরার ভেতরে আছে ছোট্ট চৌকি, সেটাও কাগজ আর আল্পনায় সাজানো৷ সেখানে বসিয়ে ছোটফুফুর গায়ে হলুদ মাখানো হবে আর তারপরে বিয়ের গোসল৷ লালপাড় হলুদ শাড়ি বুকের উপরে গিঁট দিয়ে পেঁচিয়ে পরা৷ হাতে৷ গলায়৷৷ কানে মাথায় হলুদ গাঁদা আর লাল গোলাপ দিয়ে বানানো গয়না পরা ছোটফুফুকে ছোটকাকা কোলে করে সেই মাওরার ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিল সাজানো চৌকির উপরে৷ প্রথমে দাদি তারপরে মা, কাকিমা আর তারপরে ফুফুরা সব একে একে ছোটফুফুর মুখে হাতে পায়ে খানিকটা করে হলুদ মাখিয়ে দিল, হাতে হলুদ নিয়ে প্রথমে সেই হলুদ নিজের কপালে ছুঁইয়ে তারপরে সেই হলুদ কনের মুখে হাতে পায়ে মাখিয়ে দিল সবাই৷ আমিও এক খাবলা হলুদ নিয়ে আগে নিজের কপালে ছুঁইয়ে নিলাম যেমন করে দাদি আর অন্য সকলে করেছে, আর তারপরে ছোটফুফুকে মাখিয়ে দিলাম সেই হলুদ ৷ মাওরার বাইরে গোল হয়ে বসে পাড়ার মেয়ে বউরা তখনো গাইছে বিয়ের গীত৷ সাথে আছে মেজফুফু আর তার সই জমজম ফুফু ৷
তোল তোল পালকি তোল রে, আমি যামু তোমার দেশে ৷৷
তোমার দেশে গেলে রে আমি পানি কোথায় পাব রে??
আমার বাপের আছে জোড়াদীঘি হে আমি পানি সেথায় পাব ৷৷
তোল তোল পালকী তোল রে আমি যাব তোমার দেশে রে ৷৷
তোমার দেশে গেলে আমি খানা কোথায় পাব রে??
আমার বাপের আছে জোড়া হোটেল আমি খানা সেথায় খাব রে ৷৷
তোল তোল পালকী তোল রে আমি যাব তোমার দেশে রে ৷৷
-5-
তাঁকে ডেকে এনে এখন এই শীতের শেষ রাতে
হাল্কা অন্ধকারের পোষকে মুখোমুখি বসিয়ে রেখে
আমার সবিনয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে ইচ্ছা করছে৷
আচ্ছা বলুন তো: আপনার কাছ থেকে জীবন বেশি
গ্রহণ করেছে, না আপনি? কনফিউজ করে থাকলে
আমি ব্যাপারটা স্পষ্ট করছি- এই ধরুন আপনি সারা
জীবন আত্মা খরচ করে, দৈহিক শ্রম দিয়ে যে বাসনা
নির্মাণ করে পেছনে ফেলে ছলে গিয়েছিলেন- তার কতটুকু
আপনি ফেরত্ পেয়েছেন, আদৌ পেয়েছেন কি?
আপনি নতুন বাড়ির কতটুকু কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন?
( ঋত্বিক ঘটক শ্রদ্ধাস্পদেষু/ফিউরি খন্দকার; চিত্রালী 20 ফেব্রুয়ারী, 1976)
দাদাজি হজ্বে চলে গেলেন ৷ আমরা সবাই ঢাকায় গেলাম দাদাজিকে প্লেনে তুলে দিতে৷ চল্লিশ দিনের জন্যে দাদাজি যাচ্ছেন তাই আত্মীয় স্বজন যে যেখানে আছে সবাই এসে দেখা করে গেল দাদাজির সাথে৷ ঢাকায় যাওয়ার আগের দিন সবাইকে দাওয়াৎ করে খাওয়ানো হল৷ আমাদের পাড়ার সবাই এসেছিলো সেই দাওয়াৎএ৷ বাংলা উঠানে শামিয়ানা টাঙিয়ে পুরুষদের বসার ব্যবস্থা আর ভিতর বাড়ির উঠানে মেয়েদের৷ পাড়ার লোক ছাড়াও এল গ্রামের লোক, প্রতি বাড়ি থেকে দুজনকে আসতে বলে এসেছিল বড়কাকা৷ আর ছিল গরীব ভিখিরিরা৷ বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে দাদাজি বড় মৌলভি সাহেবের ক্কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নীরব প্রার্থনা করে গেলেন, আমাদের বাড়ির সব পুরুষেরা আর যারা এসেছিল বিদায় দিতে তাঁরাও যোগ দিলেন সেই প্রার্থনায়৷ বাড়ির সব মেয়েদের সাথে আমিও জানলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই প্রার্থনা৷ আর তারপর সবাই মিলে খাল পার করে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল দাদাজিকে৷ দাদাজি এখন এক সপ্তাহ থাকবেন ঢাকার হাজী ক্যাম্পে, তারপরে প্লেন ধরে যাবেন হজ্বে ৷ এই ক্যাম্পে সারা দেশ থেকে হজ্জ্বযাত্রীরা এসে জমায়েত হন, নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় করেন ৷
ঘুমের মতন নীরবে নদী
যায়, বয়ে যায়৷ ৷
এবাড়িতে প্রতিবছর মহররমে খিচুড়ি রাঁধা হয় বড় বড় সব হাড়িতে৷ রান্নাঘরে প্রচন্ড দ্রুততায় কাজ করে চলেছে আহাদালির মা বুবু, হাসিনার মা বুবু ও তার মেয়ে হাসিনা৷ তিনমুখো চুলোয় রান্না হচ্ছে একসাথে তিন হাড়ি খিচুড়ি, কাকিমা ঘুরে গেল রান্নাঘর৷ বাইরে সে মুর্গী কাটার তদারকি করছে৷ এবছর মহররমে স্পেশাল থাকছে খিচুড়ির সাথে ভুনা মুর্গীর গোশত৷ আজ আমাদের বাংলা উঠোনের শেষ মাথায় পুকুরের পুবপার ঘেঁষে স্থাপন করা হবে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর ৷ দাদাজি বলেন, "নেও' গাড়া হবে৷ রেজিষ্টি অফিসে গিয়ে দাদাজি বাংলা উঠোনের আর্ধেকটা ওয়াকফ করে দিয়েছেন৷ এই উঠোনে আর কারো কোন অধিকার থাকল না৷ এখানে মসজিদ হবে, আজ সেই মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হবে ৷ বাড়িভর্তি লোকজন ৷ মসজিদের "নেও' গাড়া হবে বলে দাওয়াত্ পেয়ে সবাই এসেছে ৷ আমিও এসেছি শ্বশুরবাড়ি থেকে ৷ বড়কাকা গিয়ে বলে এসেছিলেন আমার শ্বশুরবাড়িতে, শাশুড়ি আসতে পারেননি, আমি আর আমার স্বামী এসেছি৷ প্রতি বছরই এবাড়িতে মহররমের দিনে খিচুড়ি রান্না হয় বড় বড় সব হাড়িতে, সেদিন বাড়িতে সবার অবারিত দ্বার৷ পাড়া-পড়শী, ফকির-মিসকিন,বাড়ির লোক, সবাই একই খাবার খায়,খিচুড়ি৷ ছোলার ডাল, আলু আর ক্ষেতের আলোচাল দিয়ে রান্না খিচুড়ি৷ দাদি উপর থেকে নামান তুলে রাখা ডজন ডজন মেলামাইনের বাসন৷ নজুচাচা সেগুলো বড় প্লাষ্টিকের গামলায় করে নিয়ে যায় পুকুরে৷ ধুয়ে নিয়ে চলে যাবে সোজা বাংলা উঠোনে৷ সেখানেই খাওয়ানো হবে ফকির মিসকিন আর অতিথিদের৷ একই রকম সব থালায় একই খাবার খাবে সবাই আজকের দিনে৷ আজ স্পেশাল মেনু হিসেবে মুর্গী আছে৷ দাদাজী সাদা কাজ করা পাআবী আর ছোট ছোট চেকের লুঙ্গি পরে বসে আছেন বাংলা ঘরের বারান্দায় তার হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারটিতে৷ সামনে ওঠোনে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, সেখানে আছে বাজারের ডেকরেটারের দোকান থেকে আনা কয়েক ডজন প্লাষ্টিকের চেয়ার৷ অতিথিরা আসছেন, দাদাজীর সাথে এসে কথা বলে গিয়ে বসছেন সামনে পেতে রাখা সব চেয়ারে৷ আমি মাঝে মাঝেই দাদির ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বাংলা উঠোনের দিকে দেখছি৷ চোখে পড়ছে বসে থাকা অতিথিরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছেন, নজু চাচা ব্যস-সমস্ত হয়ে একবার বাংলা উঠোন তো আরেকবার ভেতর বাড়ি করছে৷ দাদাজী মুখে এক উজ্জ্বল হাসি নিয়ে তার পুরনো কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে বসে বসেই তদারক করছেন সবকিছু৷ রাজমিস্ত্রী বুড়ো করিম আর আলি হোসেন৷ খানিক পরেই জুম্মার নামাজ আর তারপরে দাদাজী নিজের হাতে রাখবেন মসজিদের প্রথম ইটটি৷ দেবেন একমুঠো বালি আর এক হাতা মাখানো সিমেন্ট৷ দাদাজী তার স্বপ্নের মসজিদের আজ "নেউ' গাড়বেন ৷
দু'কূলে তার বৃক্ষেরা সব
জেগে আছে;
গৃহস্তের ঘর-বাড়ি
ঘুমিয়ে গেছে,-
শুধু পরান মাঝি বসে আছে
শেষ খেয়ার আশায় ৷
যায়, বয়ে যায়৷৷
জলেখাবিবির বাগে এখন আর মেলা বসে না৷ জলেখা বিবির মৃত্যুর পর তার ছেলে মেয়েরা সম্পত্তি ভাগাভাগি করার সময় এই বাগ নিয়ে সমস্যা হয়, কে পাবে এই বাগ৷ কেউই দাবী ছাড়তে রাজী না হওয়াতে বাগ বিক্রী কিরে দেওয়াই সাব্যস্ত হয় ৷ সেই বাগ কিনে নিয়ে সেখানে এক নতুন মাদ্রাসা শুরু করে বাবা ও বড়কাকা৷ অল্প খানিকটা জায়গায় একখানা টিনের ঘর তুলে এবছরই সেখানে চালু হয় এক লোয়ার মাদ্রাসা ৷ প্রথম বছরে তাতে ছাত্র হয়েছে বত্রিশজন, এদের প্রয়োজনীয় খাতা পেন্সিল বই দেওয়া হয় মাদ্রাসার তরফ থেকে৷ সামনের বছর এরা যখন পাশ করে দ্বিতীয় শ্রেনীতে যাবে ততদিনে তোলা হবে আরেকটি ঘর আর ভর্তি নেওয়া হবে নতুন ছাত্র প্রথম শ্রেনীতে৷ সেই মাদ্রাসার শিক্ষক এসেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে ৷ তিনি এবাড়িতেই থাকেন, খান আর মাদ্রাসায় পড়ান ৷ মাঝেই মাঝেই বড়কাকা ঐ বাচ্চাগুলোর জন্যে চকোলেট নিয়ে হাজি হন মাদ্রাসায়, ঘুরে ফিরে কথা বলেন ছোট ছোট ছেলেগুলির সাথে ৷ কেউ বা নালিশ জানায়, হুজুরে খালি মারে, বেত দিয়া! কাকা মাদ্রাসার শিক্ষককে, নিষেধ করেন ওদের বেত দিয়ে না মারতে ৷
কে জানে কবে কে নাম রেখেছে
তিতাস তোমার;
যে নামেই ডাকি তোমায়
তুমি কন্যা মেঘনার৷
বিজলীবাতি এসেছে শাহবাজপুরে ৷ তবে আমাদের তিতাসের জলবিদ্যুত্ কারখানা "ওয়াব্দা'র বিজলী নয়৷ বিজলী এসেছে দূরের শাহজীরবাজার পল্লী বিদ্যুত্ কারখানা থেকে৷ সেটি নাকি অনেক বড় আর সেই পল্লীবিদ্যুত্ কারখানার বিজলী পৌঁছে গেছে আশে পাশের সমস্ত গ্রামে এমনকি সেই মেদীর হাওর পর্যন্ত যত গ্রাম আছে তার সবকটিতেই৷ ফলে আমাদের তিতাসের এই জলবিদ্যুত্ কারখানা ওয়াব্দা এখন আর কোন কাজে লাগছে না ৷ কিছু লোক এখনও আছে সেখানে, যারা দেখাশোনা করে এই এলাকার বিদ্যুত্ পরিষেবা ৷ গ্রামের কোথায় ঝড়ে খুঁটি ওল্টালো, কোথায় তার ছিঁড়ল৷ মাঝে মাঝে লোকজন দূর থেকে গাড়ি করে আসে ওয়াব্দায় পিকনিক করতে৷ তিতাসের পুরনো ব্রীজ ভেঙে নতুন ব্রীজ হয়েছে ৷ এ ব্রীজ আরও বড়, আরও চওড়া৷ নতুন ব্রীজের উপর থেকে এখন ওয়াব্দাকে দেখলে মনে হয় যেন ছাড়া (পোড়ো) বাড়ি৷ সেই বাগান নেই,ঝা চকচকে সেই বিল্ডিং পুরনো হয়ে হয়েছে জরাজীর্ন, দেখাশোনার অভাবে ৷
ঘুমের মতন নীরবে নদী
যায়, বয়ে যায়৷৷
একতলা পাকাবাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে এক গোলাকার থাম৷ বেশ উঁচু সেই থামের মাথায় জালি দিয়ে ঘেরা দুখানা মাইক৷ মসজিদের মাইক৷ পাঁচবেলা আজান দেয় শামসুল, নজুচাচার ছেলে৷ উত্তরগাঁওয়ের নতুন প্রাইমারী স্কুলে সে পড়ায়৷ নিয়ম করে মসজিদে এসে পাঁচবেলা আজান দেয় শামসুল৷ সুমধুর সেই আজানের ধ্বনি সেই মাইকের ভেতর দিয়ে চলে যায় অনেকটা দূর অব্দি৷ মসজিদের একপাশে ছোট্ট এক ঘর, যাতে থাকেন মসজিদের ইমাম, জসিম হুজুর৷ পাশ করে মাদ্রাসা থেকে বেরুনোর পরেও জসিম হুজুর এবাড়ি থেকে চলে যায়নি৷ মসজিদের ইমাম হিসেবে তাকে চাকরী দিয়ে এবাড়িতেই রেখে দিয়েছেন দাদাজী৷ আছে অরেকটি ছেলে, রফিক৷ যে এবাড়িতে থেকে বাজারের হাই মাদ্রাসায় পড়ে, তার তিনবেলা খাওয়া দাওয়া এবাড়িতেই৷ জসিম হুজুর সকাল বেলায় মসজিদের গ্রীল দিয়ে ঘেরা বারান্দায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আরবী পড়ায়৷ এর জন্যে জসিম হুজুর আলাদা মাইনে পান৷ জসিম হুজুর মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি গেলে তখন রফিক মুন্সি নামাজ পড়ায়৷
মোষের মতন কালো সাঁঝ
নামে তীরে;
আবহমান উলুধ্বনি
বাজে ঘরে ঘরে,-
পোহালে রাত ফর্সা ভোর
আসে নদীর নামায়৷
যায়, বয়ে যায়৷৷
আমাদের বাড়িতে মসজিদ হওয়ার পর থেকে বিয়ে শাদীতে কিংবা কোন অনুষ্ঠানে জোরে গান বাজনা করতে দেন না দাদাজী, মসজিদ থেকে শোনা যায় বলে৷ বাড়ির মেয়েরা তবু দাদিকে পটিয়ে গীতের আসর বসায়, দাদি বলে, বেশি জোরে সুর তুলিস না, মসজিদ থেইক্যা যেমুন না হুনা যায়! গোল হয়ে বসে এখনও গীত গায় মেয়ে বউরা, কিন্তু সে যেন বড় ভয়ে ভয়ে৷ বড় মৌলভী সাহেবের এই বাড়িতে একটা ধর্মীয় আবহ বরাবরই ছিল কিন্তু এখন যেন সেটা বড় বেশি বেশি চেপে বসছে মানুষের উপরে৷ সামনের বাড়ির নজরুল ইসলামের ছোট ভাই কালা বিয়ে করে সংসারী হয়েছে ৷ করাত কলে চাকরী নিয়ে সে চলে গেছে শহরে৷ তার বাবা মুসা পাগলার ভাঙা বেড়ার ঘর ফেলে দিয়ে সেখানে দেওয়ালের উপর টিনের চাল দিয়ে তোলা নতুন ঘরে থাকে তার বৌ৷ সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে বাড়ি এলেও এখন সে বাড়িতে আর মুর্শিদি গান হয় না৷ আমাদের খালের উপর পাকা পুলে ছেলে ছোকরাদের আড্ডা বসে বিকেলে ৷ ছোট্ট পুলের রেলিংএ বসে ছেলের দল মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনা ছোলাভাজা, বাদামভাজা খায় ৷ কেউ কেউ এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে ধরায় একটা ক্যাপষ্টেন, তরপর সেটা হাতে হাতে ঘোরে৷ কেউ দেখে ফেলার আগেই উড়ে যায় ধোঁয়া৷ বড় পুল হয়েছে মোড়াহাটির সামনে ৷ এখন আর কোন বুড়ো মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় না, কখন কোন দয়ালু মাঝি পার করে দেবে এই খালটুকু৷ মোড়ে, যেখানে এই বড় মৌলভি পাড়ার রাস্তা আর মোড়াহাটির রাস্তা এসে এক জায়গায় মিশেছে সেখানে হয়েছে এক ছোট্ট বাজার, মৌলবীবাজার৷ মোস্তাক ডাক্তারের চেম্বার কাম ডিসপেন্সারি সহ এই বাজারে পাওয়া যায় প্
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।