আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিতাস কোন নদীর নাম নয় - ২য় পর্ব

খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।

-2- আমাদের বাড়ির সামনে যে ছোট খাল আছে সেটাই গড়িয়ে গড়িয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে বয়ে গিয়ে পড়েছে তিতাসে ৷ তিতাস অব্দি যেতে যেতে কোথাও সেই খাল খুবই সরু হয়েছে কোথাও বা হয়েছে বেশ চওড়া ৷ বড় মৌলভি পাড়া যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে ফসলের মাঠ৷ এই মাঠ বহুদূরে গিয়ে শেষ হয়েছে মেদীর হাওরে ৷ "মেদী' এক বিশাল হাওর ৷ শুকনো মরশুমে সেটা আদিগন্ত এক ফসলের মাঠ কিন্তু বর্ষায় কোথাও মাটির চিহ্নটুকুও থাকে না ৷ শুধু জল অর জল ৷ সেখানে কোন গ্রাম নেই, কোন মানুষের বাস নেই ৷ শীতকালে সেখানে প্রচুর পাখি আসে, নানা জাতের হাঁস আর পাখি৷ কোথাও হাঁটু তো কোথাও কোমর কোথাও বা বুক অব্দি জলে থাকে প্রচুর মাছ৷ হাঁসেরা সেই জলে ভেসে বেড়ায়, আকাশ থেকে গোত্তা খেয়ে জলে নেমে আসে ধবল বক, মাছের সন্ধানে ৷ ঐ সময়টায় আশে পাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসে সেই হাঁস,পাখি শিকার করতে৷ নিশুতি রাত কেঁপে ওঠে গুলির শব্দে৷ ছপ ছপ শব্দ হয় জলের উপর বৈঠার ৷ নৌকো এগোয় সেদিকে, গুলি খেয়ে যেখানে ধনেশ কিংবা বালিহাঁসটা পড়ল ৷ হাওর অব্দি যেতে যেতে পড়ে ছোট ছোট গ্রাম, কুসনি, বুড্ডা, মলাইশ৷ আর পড়ে ছোট ছোট বাথান৷ বর্ষায় এই গোটা মাঠ ডুবে যায় ৷ সামনের ঐ ছোট খাল তখন এক ছোট নদী হয়ে যায় ৷ মাটির সড়ক থেকে খাল পেরিয়ে এই পাড়ায় আসতে নৌকো লাগে তখন ৷ ছোট ছোট কোষা নৌকো দাঁড়িয়ে থাকে লম্বা বাঁশে দড়ি বেঁধে ৷ পশ্চিমের ঐ মোড়াহাটিতে যেতেও নৌকাই ভরসা৷ সেই কবে থেকে শুনছি পুল হবে৷সি এন্ড বি ধারে দিঘীর পাড়ে যেতে যেরকম পুল আছে আমাদের এখানেও হবে সেরকম পুল৷ ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এর ইলেকশনের জন্যে ভোট চাইতে এসে দখিনগাঁওএর খালেদ ও বলে গেছে আর ইউনুস জোতদারেও বলে গেছে, এবারের ইলেকশনে পাশ করে সবার আগে নাকি আমাদের এই পুল বানিয়ে দেবে৷ আমাদের এই খালেও হবে আর মোড়াহাটির সামনেও হবে৷ দাদাজিকে তাঁরা দুজনেই আলাদা আলাদা সময়ে দলবলসহ এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে গেছে আর বলে গেছে দাদাজি যেন এপাড়ার মানুষকে বলে দেন তাদের ভোটটা তাঁকেই দিতে! দাদাজি বলেছেন, যাও মিঞা, কাম কর গিয়া, দ্যাশের মানুষের লাইগা কাম করলে হেরা নিজেরাই তোমারে ভোট দিব, আমার কইয়া দেওন লাগত না কাওরে! দুজনকেই একই কথা বলে বিদায় করেছেন ৷ আমাদের পাড়ার সামনের এই সরু খাল মোড়াহাটির সামনে গিয়ে বেশ চওড়া হয়ে চলে গেছে মাঠের পাশ দিয়ে কুসনির দিকে৷ মোড়াহাটির লোকেরা বাঁশের সাঁকো বানিয়ে রেখেছে ঐ খালের উপর ৷ লম্বা একটা বাঁশ নিচে থাকে আর একটা থাকে কোমরসমান উচ্চতায়, দুপাশে আড়া আড়ি বাধা থাকে আরও দুটো করে বাঁশ যাতে করে সাঁকোর ব্যালেন্স ঠিক থাকে, নিচের বাঁশে পা রেখে কোমরের কাছের বাঁশে হাত দিয়ে ধরে ব্যালেন্স করে করে পেরিয়ে যাওয়া ৷ খাল যেখানে বেশি চওড়া সেখানে একটার গায়ে আরেকটা বাঁশ বেধে সাঁকো লম্বা করা হয় ৷ ছেলেপুলেরা ঐ সাঁকো দিয়েই খাল পার করে কিন্তু বুড়োরা তা পারে না৷ তাদের জন্যে নৌকৈ সম্বল ৷ কিন্তু পারের কড়ি খুব বেশি না হলেও কম নয় আর ওদের অনেকের জন্যেই ঐ সামান্য পারের কড়ি দেওয়াতাও সম্ভব হয় না৷ এপারে দাঁড়িয়ে মাঝিকে অনুরোধ করে, ও বাপজান, দ্যাও না আমারে পার কইরা, তোমারে আল্লায় দিব! কেউ পার করে আল্লায় দেবে এটা মেনে নিয়ে, কেউ আবার ঠাট্টা তামাশাও করে, বলে, যাও যাও, গিয়া আল্লারে কও, পরে না দিয়া অহনই দিতে! বুড়ো মানুষটি তখন পরের নৌকার মাঝির কাছে গিয়ে একই অনুরোধ জানায় আর পারের কড়ি উপরওয়ালা পরে কখনও দিয়ে দেবেন এই আশ্বাস দেয় ৷ মোড়াহাটির এই সাঁকোটা একটা মজার জিনিস ৷ আমাদের এপাড়া, পাশের নেতুলহাটি, ওপাশের মুন্সিবাড়ি আর সামনের মোড়াহাটির সমস্ত ছেলে-মেয়েরা ঐ বাঁশের সাঁকো থেকে জলে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ে, স্নান করে দাঁপাদাঁপি করে ৷ ঘন্টার পর ঘন্টা তারা ঐ খালের জলে স্নান করে, ডুব সাঁতার দেয়, জলের খেলা খেলে, ছোঁয়া ছুঁয়ি ৷ সাঁতরে গিয়ে একজনকে ছুঁয়ে দিলে সে চোর৷ আর সেই চোরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সবাই ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে৷ চোর আসছে দেখলে সে ডুবসাঁতার দেয় ছড়া কেটে, এগুলো কি? মলাই! পানির তলে পলাই! চোর বেচারা কখনো সাঁতরে গিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কখনও বা ডুব সাঁতার দিয়ে৷ যাকে ছুঁয়ে দিল সে আবার চোর ৷ আমরা, এই মৌলভি বাড়িরে পোলা-পানেরা ওখানে যেতে পারি না৷ আমাদের দৌড় এই বাঁধানো পুকুর অব্দি, এখানেই আমাদের স্নান, সাঁতার, ডুবসাঁতার আর ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা ৷৷৷ এগুলো কি? মলাই পানির তলে পলাই! কিন্তু পুকুরের জলে স্নান করে কি মন ভরে? সামনের ঐ ডুবে যাওয়া মাঠ আর নদী হয়ে ওঠা খাল যে ডাকে হাতছানি দিয়ে, আয় ৷৷ আয় ৷৷ কিন্তু যেতে পারি না ৷ দাদি কিংবা বড়কাকা দেখে ফেললে হয়ে যাবে৷ কাকা তো শাসিয়ে রেখেছে, যদি ঐ খালের জলে পা ও ডুবিয়েছি তো পুকুরে স্নান করাও বন্ধ! আচ্ছা বড়কাকাটা কোথাও চলে যায় না কেন? কিন্তু বড়কাকা কোথাও যায় না আর ঠিক স্নানের সময়টাতেই তার পুকুরের চারধার ঘুরে ঘুরে দেখার প্রয়োজন পড়ে, খালের পানি কতটা বাড়ল?? পুকুরের পাড় ভাঙছে কি?? কাঁঠালগাছটার গোড়ায় কি পানি চলে আসছে?? সেবার তো তেঁতুলগাছটা মরেই গেল! এই গ্রামের যত ছেলে আছে তারা বিকেল হলেই তিতাসের ব্রীজে গিয়ে আড্ডা দেয় ৷ বাজার থেকে বাদামভাজা, ছোলাভাজা ঠোঙায় করে নিয়ে যায় আর রেলিংএ বসে খায় ৷ কেউ কেউ যায় গুরুজনেদের লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে৷ আমার খুব ইচ্ছে করে ঐ ব্রীজে যেতে, অমনি করে ঐ রেলিংএ বসে বাদামভাজা ছোলাভাজা খেতে ৷ কিন্তু আমি যে মেয়ে! আমার তাই ব্রীজে যাওয়া বারন ৷ আর তিতাস ও তো গ্রামের ঠিক বাইরে দিয়েই গেছে ৷ কেন রে তিতাস! তুই কি আরেকটু ভেতর দিয়ে যেতে পারতিস না? তাহলে তো আমি চুপটি করেই ঘুরে আসতে পারতাম কাওকে কিচ্ছুটি না বলে! কিন্তু গ্রাম পেরিয়ে ওখানে গিয়ে আবার ফিরে আসতে যে সময় লাগবে তাতে তো পাড়াসুদ্ধু হই চই ফেলে দেবে দাদি আর বড়কাকা মিলে! যেন আমি হারিয়েই গেছি! এখানে কি ছেলেধরা আছে যে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে? কিন্তু দাদি আর বড়কাকাকে কে বোঝাবে? মাঝে মাঝে শোনা যায় বটে যে গ্রামে ছেলেধরা এসেছে, কখনও অমুকদের বাড়ির ছেলে হারিয়েছে তো কখনও তমুকদের বাড়ির, কিন্তু সেসব মেলার সময় হয় ৷ আর কাকিমা বলে, ছেলেধরা ফরা কিসসু নয়, মেলায় যাœআদলের সাথে ছেলে নিজেই পালিয়েছে ৷ যাœআদলের সাথে পালালে ইশকুলেও যেতে হয় না আর ক্ষেতের কাজও করতে হয় না ৷ দাদি বলে, এও একধরনের ছেলেধরাই তো৷ গ্রামের ছেলেদের যাœআর পার্ট করতে দেওয়ার নাম করে তাদেরকে ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া, আর যে ছেলেটি যাচ্ছে সে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে এও তো যাœআদলের লোকেদের জানা ৷ এবারে যেমন আহাদালির মা বুবুর ছোটছেলে পালাল বাড়ি থেকে ৷ মেলা শেষ হওয়া অব্দি সে রোজ মেলায় যেত, যাœআর একই পালা সে রোজ দেখত আর বাড়ি এলেই তার মায়ের সাথে রোজ ঝগড়া হত, ক্ষেতের কাজে না গিয়ে ছেলে সারাদিন মেলায় পড়ে থাকে বলে৷ মেলা যেদিন শেষ সেদিন ছেলে আর বাড়ি ফিরল না ৷ আহাদালির মা বুবু সারাদিন ছোটাছুটি করে সারা গাঁ খুঁজল, সন্ধ্যেবেলায় আমাদের বাংলা উঠোনের মাটিতে পড়ে বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল এই বলে, আমার পোলারে আইন্যা দ্যাও, আমার পোলারে আইন্যা দ্যাও ৷ আমাদের এই গ্রামের নাম শাহবাজপুর ৷ এক ফকিরের নামে গ্রামের নাম৷ ফকির শাহবাজ শাহ নাকি আটশ বছর আগে এই গ্রামে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ৷ তার আস্তানা ছিল তিতাসের পারে, সেই ফকির শাহবাজ শাহর নামে এই গ্রামের নাম শাহবাজপুর ৷ আমাদের পাড়ার নাম বড় মৌলভিপাড়া ৷ বড় মৌলভি সাহেব নামেই সবাই চিনতো তাকে, তার নামেই এই পাড়ার নাম বড় মৌলভি পাড়া ৷ এই পাড়ার নাম লস্কর পাড়াও হতে পারতো কারন মৌলভি বাড়ির চারপাশে যারা আছেন বেশির ভাগই সব লস্কর আর লস্কর বাড়ির লোক ৷ দু-চার ঘর আছে যারা খেটে খায়, পুরুষেরা অন্যের ক্ষেতে আর মহিলারা বাড়িতে ৷ যখন মৌলভি সাহেব এখানে আসেন তখন লস্কর বাড়ির নাকি খুব জমজমাট অবস্থা ছিল ৷ সে দুশো বছর আগের কথা ৷ ঢাকার ফরিদবাগ থেকে এসেছিলেন তিনি ৷ ঘুরতে ঘুরতে শাহবাজপুরে এসে স্থির করেন যে এখানেই থেকে যাবেন ৷ যে জায়গাটি তিনি পছন্দ করেন থাকবেন বলে সেটি গ্রামের উত্তর ভাগ৷ উত্তর গাঁও নামেই পরিচিতি ৷ খালপাড়ের জায়গাটি তিনি কিনে নেন লস্করদের কাছ থেকে ৷ জায়্গাটা খালি পড়েই ছিল ঝোপ-ঝাড় আর গাছ পালাতে জঙ্গল হয়েছিল ৷ লস্করেরা জমিটি মৌলভি সাহেবকে দান করতেই চেয়েছিল পূণ্যও হবে আর এই জঙ্গল আবাদও হবে মানুষের উপস্থিতিতে এই ভেবে ৷ মৌলভি সাহেব জমিটি দান না নিয়ে কিনে নেন আর সেখানে জঙ্গল সাফ করে বসত শুরু করেন ৷ বসত শুরু করার কিছুদিন পরে তিনি লস্কর বাড়িরই মেয়েকে বিয়ে করেন ৷ এই মৌলভি সাহেব আমার দাদাজীর দাদাজী ৷ (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.