খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
3-
সুখ কি এখন শুকপাখি যে
পালিয়ে যাবে শিকল ছিঁড়ে?
বুকের খাঁচায় সুখের বাসা
সামনে সবুজ স্বপ্ন হয়ে ক্ষেতের ফসল
অন্ধকারের সঙ্গে এখন পা কষে আলো জ্বালা
অশ্রু নদীর পারে যেন
স্বপ্ন দেখার নৌকো বাঁধা ৷ ( শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
তিতাসের চরে বসেছে জলবিদ্যুত্এর কারখানা ৷ ওয়াব্দা ৷ কি সুন্দর সব টাওয়ার বানিয়েছে অর কি সুন্দর ঐ লাল ইটের বাড়ি ৷ যার ভিতরে বসেছে সব মেশিন, সব না কি বিদেশ থেকে আনা৷ এখান থেকে নাকি বিদ্যুত্ বানাবে আর গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলবে বিজলী বাতি৷ কিন্তু কবে?? এখানে তো বিকেল হলেই ঘরে ঘরে হ্যারিকেন সাফ করে মেয়ে বউরা ৷ ন্যাতা দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে কাঁচের চিমনি, তেল ভরে লন্ঠনে৷ হাত দিয়ে ছিঁড়ে নেয় জ্বলে যাওয়া সলতের মুখ ৷ কবে ঐ ওয়াব্দাতে বিজলী বানানো শুরু হবে আর কবে আমাদের এই গ্রামে আলো জ্বলবে কে জানে! কাকাও কিছু বলতে পারে না, বলে, কাম তো হইত্যাসে, দেখা যাক কবে বাত্তি জ্বলে এই শাহবাজপুরে৷ তিতাসের পার ঘেষে সব ইটখোলা বসেছে ৷ তিতাসের মাটির ইট নাক খুব ভালো হয়, দাদাজি বলেছে ৷ ব্রীজের উপর বসে ছেলে ছোকরারা সব ইটখোলর দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ ওয়াব্দার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ বাদামের খোলা ভেঙে ভেঙে ফ্যালে তিতাসের জলে ৷ আমি বেশির ভাগ সময়েই আসা যাওয়ার পথে তিতাসকে দেখি, গাড়ির ভিতর থেকে ৷ কখনও ঐ ব্রীজের উপরে দাঁড়াইনি, ওখানে দাঁড়িয়ে বাদামভাজা খাই নি ৷ ওয়াব্দাকেও আমি দেখি এই ব্রীজের উপর থেকে, চলন্ত গাড়ির ভিতর থেকে ৷ আমার বড় ইচ্ছা করে, নৌকায় চড়ে তিতাসের ঐ চরে গিয়ে ওয়াব্দার ভিতরে যেতে, ঐ টাওয়ারের মাথায় চড়তে৷ যেখানে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রীরা সব কাজ করে ৷ কিন্তু আমি যে মেয়ে! আমার তাই তিতাসের পারে যাওয়ার অনুমতি নেই ৷ ওয়াব্দাতে যাওয়ার অনুমতি নেই ৷ এই তো কিছুদিন আগেই ওয়াব্দাতে সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে ৷ পুরো গ্রামের লোক সব শ্যুটিং দেখতে গেছে ওয়াব্দাতে ৷ ব্রীজের উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদামভাজা খেতে খেতে শ্যুটিং দেখেছে গ্রামের সব ছেলে ছোকরারা ৷ দল বেঁধে মেয়ে বউরাও সব গেছে শ্যুটিং দেখতে৷ কিন্তু আমি যেতে পারিনি ৷ আমি যে বড় মৌলভি বাড়ির মেয়ে! আমার যে মানায় না রাস্তায় দঁড়িয়ে শ্যুটিং দেখার, ব্রীজের রেলিংএ বসে বাদামভাজা খাওয়া ৷
দখিণগাঁও এর সাজ্জাদ চাচাদের বাড়িতে এবছর সব সিনেমার নায়ক নায়িকারা এসে উঠেছে ৷ ববিতা, রোজি সামাদ, আনোয়ার হোসেন ৷ পুরো গ্রামে ঘুরে ঘুরে ওরা শ্যুটিং করছে৷ যেখানে কাজ হচ্ছে সেখানেই নাকি সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি ৷ পুরো গাঁ ভেঙে পড়ে সেই শ্যুটিং দেখতে৷ এই যে বড় কাকিমা, যাকে কি না আমি অ্যাত্তো ভালবাসি, সে কি না আমার সাথে অ্যাত্তো বড় বিশ্বাসঘাতকটা করলো? রাতের খাবার টেবিলে দিয়ে চুপ করে মা, কাকিমা আর বড়কাকা তিনজনে মিলে সাজ্জাদ চাচাদের বাড়ি গিয়ে ববিতা,রোজি সামাদদেরকে দেখে এসেছে! আর আমাকে একটি বারও বলেনি!! শুনে অব্দি আমার কান্না আর থামে না ৷ কাকিমা বলে, কাঁদিস না, কাকাকে দিয়ে পাঠাবো তোকে আজ ৷ কিন্তু ঠিক সেদিনকেই কাকা কি একটা কাজে চলে গেল শহরে! রোজ বিকেলের রান্না রাঁধতে এসে আহাদ আলির মা বুবু গল্প করে, সে দুপুরে কাজ সেরে গিয়ে শ্যুটিং দেখে এসেছে ৷ আমি বলি, অ বুবু, আমারে লইয়া যাও না! আহাদ আঅলির মা বুবু বলে, মাইয়ো গো! আফনেরে লাইয়া গেলে আমারে আর এই বাড়িত ঢুকতে দিব নি? থাক আম্মা, আফনের যাওন লাগব না, হেরা তো শুনসি আফনেগো পুস্কুনি তে আইয়া সিনেমা বানাইব! ওমা! সত্যি তো! পরদিন সক্কাল থেকে আমাদের পুকুর লোকে লোকারণ্য ৷ লাইন দিয়ে কতগুলো গাড়ি এসে দাঁড়ালো খালপাড়ে আর তার থেকে একে একে লোকজন নেমে শুকনো খাল হেঁটে পেরিয়ে সব এসে থামলো আমাদেরই পুকুরপাড়ে! আর ঐ পুতুল পুতুল দেখতে মেয়ে দুটো! ওমা! এ যে ববিতা! ছোট ফুফু গিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে এল ৷ ববিতা তো কথাই বলে না! রাঙানো ঠোঁটে শুধু একটুখানি হাসে ৷ সারাদিন ধরে পুকুরে শ্যুটি ংহল৷ ববিতা স্নান করছে পুকুরে, তারই ফোটো তুলল ইয়া বড় এক ক্যামেরা দিয়ে ৷ আর ববিতা, যে কি না সাঁতারও জানে না ৷ সে এইটুকু জলে বারবার গিয়ে এমন ভাব করছে যেন সাঁতার কাটছে! ঐ নাকি শ্যুটি! ংধ্যাত্৷ সারাটা দিনই মাটি হল আমার ৷
- ছাওয়ালের বাপ কোন হানে আছে দিদি?
- জানি না ৷
- বলি মইরা তো যায় নাই?
- জানি না ৷
- আমি কই বিয়া তো একডা হইছিল দিদি?
- জানি না ৷
- পোড়া কপাল কই এই ছাওয়লডা আইছে একটা বিয়া অইয়াতো?
- জানি না ৷
- খালি জানি না জানি না জানি না৷ তুমি দিদি কিছুই জান না ৷
( তিতাস একটি নদীর নাম/ চিত্রনাট্য- ঋত্বিক কুমার ঘটক)
আমাদের বাড়িতে সখিনাকে ঢুকতে বারন করে দিল দাদি ৷ সন্ধ্যেবেলায় আহাদালির মা বুবু রাঁধতে এসে গল্প করলো, সখিনার প্যাট হইসে গো আম্মা ৷ হের লাইগাই তো আফনের দাদি সখিনারে আফনেগো বাড়িত আইতে মানা করসে৷ আমি জিজ্ঞেস করি আহাদালির মা বুবু কে, পেট হইলে কি হয় বুবু? বুবু বলে, আস্তে কন আম্মা, আফনের দাদি হুনলে আমারেও আর বাড়িত ঢুকতে দিব না ৷ সখিনায় কুকাম করসে, হের লাইগা সখিনার পেট হইসে ৷ অহন সখিনারে একঘইরা কইরা দিব হগ্গলে মিল্যা ৷ হাইন্জা বেলায় বিচার হইব সখিনার, পঞ্চায়েত বইব ৷ বুবু আরও বলল, সখিনা পিরীত করে পুবহাটির কাশেমের লগে, আইজকা নতুন না, বহুতদিনের পিরীত, হাসন আলি, মইজুŸনি হগ্গলে হগ্গলতা ( সবাই সবকিছু) জানে, কিন্তু কেউ কিসু কয় না, কইলেই কি সখিনায় হুনব, যে দজ্জাল মাইয়া ৷ আগের তিনডা পোলাপানও ঐ কাশেইম্যার ৷ সব জাইন্যাও হাসন আলি চুপ কইরা থাহে, হের তো যাওনের জায়গা নাই ৷ কই যাইব? বাড়ি ঘর নাই দেইখাই তো ঘরজামাই হইয়া আইসিল, তয় এইবার হাতে নাতে ধরা পড়সে সখিনা, হের বাপ আর মরদে কিসু না কইলেও পাড়ার মাইনসে ছাড়ত না ৷ আমি রাতে পেরে কাকিমাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অ কাকিআম্মা, সখিনারে বলে একঘইরা কইরা দিব? একঘইরা কি জিনিস গো? কাকিমা খুব রেগে গিয়ে বলল, কেডায় কইসে তোরে এইগুলি? আমি বললাম, আহাদালির মা বুবু কইতেসিলো তো রাঁধতে আইসিল যখন, সখিনায় বলে কুকাম করসে হের লাইগা হেরে একঘইরা কইরা দিব হগ্গলে মিল্যা, কাকিমা আরও রেগে গিয়ে বললো, আহদালির মায় অত কথা তোর কাছে কিয়ের লাইগ্যা যে কয় আল্লায় জানে,কাইল সকালে আইলে জিগামু হেরে, পুলাপানের লগে অত কতা অত কেচ্ছা কিয়ের! তারপর আমাকে দিল বকুনি,তুই ঘুমা এখন, অত কথায় কান দেওনের দরকারটা কি তোর? এবার কাকার পালা ৷ কাকাকে বললো, তোমার ঐ পঞ্চায়েতে যাওন লাগতো না ৷ খাইয়া লইয়া ঘুমাও গিয়া!
মুন্সিবাড়ির লিয়াকতের মায়ের একটা ফলের বাগান আছে ৷ সেই বাগানে ন্যাশপাতি, কমলা, জাম্বুরা ( বাতাবী লেবু ), কামরাঙা , তুতফল আর পেয়ারার গাছ গোটা বাগান জুড়ে ৷ লিয়াকতের মা দাদি এক অদ্ভুত বাংলায় কথা বলে, দাদি কলিকাতার মেয়ে ৷ মুসা লস্কর এই দাদিকে বিয়ে করে কলিকাতা থেকে নিয়ে গেসল ৷ তো দাদি কলিকাতার শুদ্ধ বাংলা আর আমাদের দেশের ভাষা মিলিয়ে এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে৷ আমরা, পোলাপানেরা বহু চেষ্টা করেও দাদিকে নকল করতে পারি না, দাদি হেসে কুটিপাটি হয় আমাদের সেই চেষ্টা দেখে৷ নিজের ছেলে-পুলে নাই৷ দেওরের ছেলেকে নিজের ছেলে বলে মানুষ করেছে ৷ সেই ছেলে শহরে থেকে কলেজে পড়ে৷ বাড়ি আগলে থাকে দুই বুড়ো-বুড়ি ৷ দাদি নানা রকম আচার বানায় আর সেগুলো কাঁচের বৈয়ামে ভরে প্রায় দিনই উঠোনে শুকোতে দেয় ৷ জলপাইয়ের আচার, বড়ই ( কুল) এর আচার, তেঁতুল এর আচার, আমের আচার ৷ আমার সবচাইতে ভাল লাগে দাদির কুলের আচার ৷ বৈয়ামভর্তি তেলের মধ্যে লাল লাল কুল ৷ বড়ই এর ফাঁকে ফাঁকে রশুনের কোয়া আর শুকনো লংকা ও দেখা যায় ৷ দাদির কাছে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই তার গাছের ঐ ডাঁসা ডাঁসা পেয়ারা কিন্তু আচার আর কামরাঙাও কম লোভনীয় নয় ৷ যখন পেয়ারা বা কামরাঙা থাকে না তখন মহানন্দে সেই আচার খাই ৷ মুসা দাদা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুরে ঘুরে গাছের চারা যোগাড় করে আর দিনের অর্ধেক সময় ঐ বাগানেই কাটায় ৷ আমি আর চায়না দুপুরবেলাতে গিয়ে হাজির হই যখন দাদি পানের বাটা নিয়ে শীতল পাটিতে বসে পান খায় আর হাতপাখা ঘোরায় ৷ আমাকে দেখেই মুসা দাদা বলে ওঠে, আইসো বুবু? আইয়ো! তোমার দাদির কাছে বইয়া একটু পাঙ্খার বাতাস খাও৷ আমি খানিকক্ষণ বসে দাদাকে বলি, দাদা বাগানে যাই? দাদা বলে শবরি ( পেয়ারা) খাইবা তো? যাও! দাদার এই পেয়েরা গাছগুলো বাগানের ধার ধরে লাগানো, গাছগুলো খুব একটা উঁচু নয় আর বেশ ডাল পালা ছড়ানো ৷ তাতে ফলে আছে আমার মুঠিতে আঁটে না এমন সব পেয়ারা ৷ কিছু একদম কাঁচা, কিছু ডাঁসা আর কিছু পাকা ৷ আমি ভালবাসি ডাঁসাগুলো আর চায়নার আবার কাঁচা পছন্দ ৷ দাদার আবার শর্ত আছে, গাছে বসে পেয়ারা খাওয়া চলবে না, তাতে করে নাকি পেয়ারাতে পোকা হয়, কাজেই গাছ থেকে যত খুশি পেয়ারা পাড়ো আপত্তি নেই কিন্তু খেতে হবে নেমে এসে ৷ ফ্রকের কোঁচড়ে পেয়ারা নিয়ে হজইর হই দাদির কাছে, কোঁচড়ের সাইজ দেখে দাদি আন্দাজ করে কত পেয়ারা পাড়া হল, বলে অ বুবু, তোমার তো প্যাডে (পেটে )বেদনা হইব অ্যাত্তো শবরি খাইবা তো! আমি দাদিকে আশ্বাস দি, কিসসু হইবো না দাদি, আমি তো রোজ খাই!
ফেরার পথে উঁকি দিই জামশেদ পাগলার বাড়িতে৷ জামশেদ ইসমাইল লস্করের ছেলে, ছোটবেলা থেকেই পাগল হয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়, চম্পা বলে এখন নাকি সে হাইকোর্টের মাজারে ভিক্ষা করে৷ চম্পা জামশেদ পাগলার ছোট বোন ৷ আমাদের বাড়ির সাথে ঝগড়া ওদের বাড়ির, জমি নিয়ে৷ ওরা আমাদের বসতবাড়ির বেশ খানিকটা জমি দখল করে রেখেছে রাতারাতি সেখানে টিনের ঘর তুলে নিয়ে৷ বড়কাকার সাথে ঝগড়া হওয়াতে বড়কাকা মাধবপুর থানায় গিয়ে মামলা করে দিয়েছে ইসমাইল লস্করের নামে ৷ সেই থেকে ওদের বাড়ির কেউ আমাদের বাড়ি আসে না ৷ দাওয়াত্ দিলেও আসে না ৷ কিন্তু চম্পা আমার বন্ধু ৷ মুন্সিবাড়িতে ঘুরতে গেলে ওর সাথেই তো যাই , মুন্সিবাড়ির পুকুরে স্নান করার ইচ্ছে হলেও চম্পাই সঙ্গী হয়৷ চম্পার বড় বোন রওশন আরা ছোট ফুফুর বন্ধু, দুজনে লুকিয়ে গল্প করে, গল্পের বই আদান প্রদান করে, শরত্চন্দ্র, নীহারন গুপ্ত ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়ের বই৷ সেগুলো আবার আমিই দিয়ে আসি কিংবা নিয়ে আসি ৷ রওশন ফ্ফুর কাছে আছে রিক্শাওয়ালা, মইষাল বন্ধু, অমর প্রেম জাতীয় বই ৷ সেগুলো সে আমার হাতে দেয় না, নিজেই ছোটফুফুকে দেয় বিকেলবেলা যখন ছোটফুফু পাশের আহমদ দাদাদের বাড়িতে আসে কিংবা পুকুরপাড়ে যায়৷ একবার দুজনে লুকিয়ে একটা বই পড়ছিলো যে বইটা রওশন ফুফু তার শাড়ির আঁচলের তলায় করে নিয়ে এসেছিলো ৷ সেদিন আমিও ছোটফুফুর সাথে বসেছিলাম আহমদ দাদাদের উঠোনে, রওশন ফুফু এসে বললো, এই সামি, যা চম্পার চম্পা লগে ঘুইরা আয় গিয়া! রওশন ফুফুর হাব ভাবে বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা গোপন ব্যপার আছে যা সে আমার সামনে বলতে চায় না ৷ আমি বললাম না, আমি আইজকা তোমাগো লগে থাকুম! ছোটফুফু তখন বললো আচ্ছা থাক তবে ওদিক ফিরে বোস আমি তোর মাথার উকুন বেছে দিই! আমার মাথায় যদিও উকুন আছে কিন্তু ছোটফুফু কক্ষণো সেটা বেছে দেয় না! আমি চুপ করে ওদিক ঘুরে বসে পড়লাম ছোটফুফুর কথামত৷ রওশন ফুফু ফিসফিস করে বলল এই দ্যাখ! আঁচলের তলা থেকে একটা বই বার করে নিজেই পাতা উল্টে উল্টে দেখাতে লাগলো! সাথে সাথেই ছোটফুফু বললো, রোশনি, আমি যাই বাড়িত, আইজকা আর বইতাম না! আমাকে নিয়ে ছোটফুফু উঠে চলে এল ওখান থেকে৷ কি হয়েছে, ওখান থেকে উঠে পালিয়ে এল কেন, বারবার ছোটফুফুকে জিজ্ঞেস করলেও সে কিছুই বললো না আমাকে ৷
চম্পা খুব ভয় করে ওর আব্বাকে, ইসমাইল লস্কর যদিও আমাকে দেখলে কিছু বলে না কিন্তু তবু চম্পা বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় ৷ এই চম্পাদের বাড়িতে একটা তালগাহ আছে বেশ উঁচু গাছ ৷
তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে ৷
এই গাছের তাল কেউ খায় না খুব তেতো বলে, ধপাস করে তাল পড়েছে শুনেও কেউ দৌড়ায় না তাল কুড়োবে বলে ৷ মাঝে মাঝে গাছ থেকে ডাল ছেঁটে নিচে ফেলে রতন,চম্পার বড় ভাই ৷ সেই ডাল থেকে অনেকেই পাতা কেটে নিয়ে যায় পাখা বুনবে বলে ৷ রওশন ফুফু খুব ভাল পাখা বোনে ওদের গাছের শুকনো পাতা দিয়ে ৷ পাতা থেকে বেত তুলে নিয়ে ( সরু বেতের আকারে কেটে নেওয়া পাতা) বিভিন্ন রঙে চুবিয়ে নানা ডিজাইন বানায় সে পাঁখায় ৷ ফুল, লতা,পাতা মাছের ছবি ৷ বেশ অনেক কটা পাঁখা বোনা হয়ে গেলে পাশের বাড়ির আহমদ দাদা সেই পাঁখাকে গোল করে কেটে সরু বাঁশের বেত দিয়ে বাঁধিয়ে দেয় পাঁখা আর ডাঁটি লাগিয়ে দেয়, যাকে আহমদ দাদা বলে "চাকানো"৷ সেই পাখা লোকে বাড়ি এসে কিনে নিয়ে যায় একসঙ্গে ছ'টা আট'টা ৷ এই হাতে বোনা পাখাগুলো বাজারে পাওয়া যায় না ৷ এই পাড়ায়, গ্রামে কে কে পাখা বোনে সেটা ব্যপারীরা জানে ৷ তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাখা সংগ্রহ করে আর তারপর কাছে, দূরের সব বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে সেই পাখা বিক্রী করে ৷ রওশন আরার হাতের বোনা পাখার বেশ চাহিদা ব্যাপারীদের কাছে৷ রওশন ফুফু বিভিন্ন রঙীন কাপড়ের ঝালর কুচি দিয়ে দিয়ে লাগায় বাধানো পাখার বাইরের দিকে৷ পাখার ভেতরে আঁকে ফুল, লতা-পাতা পাখি ৷ বড় বড় ফোঁড়ে রঙিন সুতোয় নিজের নাম লিখে একটা পাখা সে উপহার দিয়েছে ছোটফুফুকে ৷
একদিন সকালবেলা হঠাত্ ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল মুসা পাগলার বাড়ির সামনে রাজমিস্ত্রী এসেছে ৷ মুসা পাগলার ছোটছেলে কালা রাতে স্বপ্ন দেখেছে ওদের বাড়িতে এক পীর'এর কবর আছে আর সেই পীর স্বপ্নে কালাকে আদেশ দিয়েছেন তার কবর যেন বাঁধিয়ে দেওয়া হয়! আমরা সবাই দেখলাম আমাদের বাড়ির বাংলা উঠোনে ( বার বাড়ির উঠোন) যেভাবে বড় মৌলভি সাহেব আর তাঁর বিবিসাহেবের কবর বাঁধানো আছে ঠিক তেমনি করেই ওদের বাড়িতেও কবর বাঁধানো হচ্ছে খেজুর গাছ কেটে দিয়ে ৷ খেজুর গাছ নাকি কবরের উপরে ছিল, স্বপ্নে কালা এরকমই দেখেছে কাজেই সক্কাল সক্কাল উঠেই কেটে ফেলল সে নিজেই ঐ খেজুরের গাছ আর তারপর মিস্ত্রী নিয়ে এসে ইট গেঁথে দাঁড় করিয়ে দিল বাঁধানো কবরের ধাঁচে৷ ওদিকে তার বাবা মুসা পাগলা সমানে ছেলে উপরে চেঁচামেচি করে যাচ্ছে, ছেলেকে অভিসম্পাত করছে এই বলে, তুই রাইতে গাঞ্জা খাইয়া ঘুমাইসত আর সক্কাল সক্কাল উইঠ্যাই ফলন্ত খেজুর গাছ কাইট্যা বাড়ির ভিতরে মাজার বানাইত্যাসত৷ অত মিছা কতা আল্লায় সইত না রে কাইল্যা৷ করিস না বাপ আমার, ছাইড়া দে ৷৷ এই বাড়িত কোন কবর নাই, কোন মাজার নাই, কি কারণে তুই এমুন করতাসত? কিন্তু তার ছেলে কোন কথা শুনছে না সে একমনে তার কাজ করেই যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শুধু চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে এবাড়ির কবরের মত হচ্ছে কি না ৷ আমাদের বাড়ির সবাই চুপ করে দেখছিল, দাদাজি সবাইকে ধমকে দিল, কেন এরকম কাজ কম্মো ফেলে দিয়ে সবাই তামাশা দেখছে? সবাই যার যার কাজে চলে গেল ৷ দাঁড়িয়ে গেল চায়নাদের বাড়িতে মাজার ৷ প্রায় রাতেই সেখানে সাধু সন্ন্যাসী পীর ফকির আসে আর গাঁজা ভাং খেয়ে সবাই মুর্শিদি গান গায় ৷
কাছে নেও না দেখা দেও না
আর কতকাল থাকি দূরে ৷৷
মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে ৷৷
ময়াজালে বন্দী হয়ে আর কতকাল থাকিব ৷৷
মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নিব
আশা করি আলো পাব ডুবে যাই অন্ধকারে
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধন হে
কেমনে চিনিব তোমারে ৷৷
আমাদের আটচালা টিনের বাংলা ঘরের বারন্দায় দাঁড়িয়ে যখন জায়গির মুন্সি আজান দেয় নামাজের তখন সামনের মুসা পাগলার বাড়িতে তার ছোটছেলে কালা দলবল নিয়ে মুর্শিদি গান করে ৷
শুনলে কথা মনের ব্যথা
দূর হইয়া যায় চিরতরে
মুর্শিদ রূপে জানো তারে ৷৷
এইবার নিরাকারে আপনে আহা
আকারে মানুষ করে কাবা ৷
স্বরূপেতে রূপ মিশাইয়া
জীবের মূর্তি ধারণ করে ৷
মুর্শিদ রূপে জানো তারে ৷৷
(চলবে)
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।