আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি পেনাল্টি শট এবং মীরসরাই।

কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন। আমি স্ট্রাইকার থেকে সরাসরি গোলকিপার হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত।

৮ নম্বর জার্সি পড়া একজন গোলকিপিং-এর দায়িত্ব পালন করছে। এই খেলাটা নিয়ে আমাদের কিছু স্বপ্ন বিদ্যমান। এই প্রথম জার্সি পড়ে খেলছি। জার্সি বানানোর সময় ১২ জনের সবার জার্সি নম্বরই ১০ হওয়ার মত অবস্থা। ম্যারাডোনার জার্সি নম্বর দশ আমরাও কেউ ম্যারাডোনার থেকে কম হতে চাইনা আমাদেরও চাই জার্সি নম্বর ১০।

গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখনকার ঘটনা। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে তখন আবু বক্কর সিদ্দীকির একনায়ক তন্ত্র কায়েম আছে। আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন। টিফিনের সামান্য ভাগ না দিলে বোর্ডে নাম উঠে যাবে- মার খেতে হবে। ক্লাস টিচার ফজলুল হক স্যার।

তিনি আমাদের আদর করতেন কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের বলতেন বাচ্চা শুয়োর। আর প্রচুর পরিমানে মারতেন। আবু বক্করকেই একবার ২১ বেত খেতে হয়েছিল। ৭ টা বেত খেয়েছিল কিন্তু ঘটনার গভীরতা বোঝাতে অতিরঞ্জিত করে ২১টা বলা হচ্ছেনা। আসলেই ২১ টা মেরেছিল।

প্রশংগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আবার ফিরে আসি। ফুটবল নিয়ে কাহিনী। প্রভাতী শাখা (মরনিং শিফট)-এর 'ক' সেকশন আর 'খ' সেকশনের খেলা। কত স্বপ্ন ছিল স্ট্রাইকার হয়ে গোল দিব স্বপ্নের সাথে বাস্তবের ফারাকের কারন- আমাদের নিয়মিত গোলকিপার জাকির হোসেন কোন কারনে গোলকিপিং করতে পারছেনা। পরবর্তিতে ক্লাসেই প্রাকৃতিক কর্মকান্ড করে ফেলার কারনে যে একবার আলোচনার শিরোনাম এবং একধিকবার গনপঁচানির পরিনাম হয়েছিল।

আমাদের দলটাকে বেশ শক্তিশালী বলা যায়। এত ছোট বয়সের ফুটবলে পজিশনের ব্যাপার থাকেনা, দেখা যায় যার ডিফেন্সে থাকার কথা সে উপরে চলে গিয়েছে - ডানের জন বামে বামের জন ডানে, খালি একমাত্র ৮ নম্বর জার্সি ধারনকারী গোলকিপারের কিছু করার নাই। পুরা খেলায় একটা বল হয়ত এসেছিল আমার কাছে। যেটা খুব সহজেই ধরা যেত কিন্তু আমি বল ধরার পর একটা ডাইভ দিলাম। সাধারনত গোলকিপাররা ডাইভ দিয়ে বল ধরে থাকে আমার সময় ব্যাতিক্রম হওয়ার কারন একটু দেখানো যে আমি গয়কোচিয়া (১৯৯০ সালের আর্জেন্টিনার গোলকিপার।

সেবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিল এই গোলকিপার। ইটালী আর যুগোস্লাভিয়ার সাথে টাই-ব্রেকার ঠেকিয়ে দেন। )। আমাদের কথিত রাইটব্যাক আবরার আর পাভেল। পাভেল অনেক চাপাচাপি করে ৭ নম্বর জার্সি নিয়েছে।

তার ফুটবল খেলা ভাল। সে সবাইকে কাটাতে পারে। ১০ জনকে কাটানোর পর গোলকিপারকে কাটিয়েও বলটাকে বাইরে কিক মারছে। আমাদের স্ট্রাইকারের নাম মিতুল আমরা তাকে ডাকি লেদু। লেদুর সমস্যা হল এত বড় গোল-পোস্ট থাকা সত্ত্বেও সে গোলকিপারকে দেখে তার গায়েই মারছে।

তাকে বুঝানোই যাচ্ছেনা এটা ফুটবল- বুম্ব-বাস্টিং না। আবরার একা তেমন সামলাতে পারছেনা। আমাদের মিডফিল্ডে ইকবাল খুব পরিশ্রম করে খেলছে আর উপল বলটাকে গোল দেওয়ার থেকে অনেক উপরে দিয়ে মারাটাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ভাল কথা খেলায় কিন্তু রেফারী আছে। তিনি হলেন খ শাখার ক্লাস টিচার নবী স্যার।

তার এক হাতে বাঁশি আরেকহাতে বেত। কোন লাল-কার্ড হলুদ কার্ডের সিস্টেম নেই তবে ফাউল করলে বেতের বাড়ির ব্যবস্থা আছে। ফুটবল ইতিহাসে এমন রেফারী পাওয়া বিরল। সব জায়গায় রেফারীরা মার খায় এখানে খেলোয়াররা খাচ্ছে। এরমধ্যে আমার আম্মা এসেছেন খেলা দেখতে।

সকালে অনেক বড় বড় কথা বলে এসেছি আমি স্ট্রাইকার - এখন একটাই ভরসা আম্মা হয়ত গোলকিপার আর স্ট্রাইকারের পার্থক্য নাও বুঝতে পারেন। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ। ডান হাতে বেত নিইয়ে বাম হাতে বাঁশি ধরে নবী স্যার জানিয়ে দিলেন এখন টাই-ব্রেকার। টাই-ব্রেকারের আগে আগে কোথেকে জাকির চলে আসায় এখন সে গোল-কিপার। খ শাখারা আপত্তি জানালেও নবী স্যার কানে তুললেননা।

আর জাকির বদলী খেলোয়ারনা। সে ছিল ডিফেন্সে। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ফুটবল মাঠ- ক্লাস ফাইভের ছেলেদের তুলনায় বড়ই বলতে হবে। টাইব্রেকারের প্রথম ৫ শট শেষে ফলাফল ৫-৫। এখন সাডেন ডেথ- বাংলা করলে হয় - হটাৎ মরণ।

খ শাখার কালা মিশু শট নিতে আসল এবং তার শটে রাগবী আর ফুটবলের গোলবারে কোন পার্থক্য থাকলনা। দিগন্ত রেখার উপর দিয়ে বলটি চলে গেল। আমি তখন মন খারাপ করে এক কোনায় বসে আছি। না স্ট্রাইকার থাকতে পারলাম- না টাই-ব্রেকারের সময় গোলকিপার। শেষ শটটা জাকির নিবে এমনি ঠিক ছিল হটাৎ ইকবাল বলল - জিকোকে দে।

আবু বক্করের মন গলেনায় তারপরেও কিছু সমর্থন মিল। স্বৈরাচার আবুবক্কর এসে জানিয়ে দিল গোল দিতে না পারলে দেশে থেকে বিতারিত করা হবে। স্পটে বল বসালাম। নবী স্যার বাঁশি দিবেন তারপর শট মারতে হবে। বাঁশি বাজল।

ডান দিকে বারের এমন এঙ্গেল দিয়ে বলটা গেল যে আমার অনেক বন্ধুদের ধারনা গয়কোচিয়ার পক্ষেও এটা ঠেকান কঠিন ছিল। আমাদের আনন্দ আর আটকায় কে। মেডেল নিলাম। কাপ নিলাম। আজ আনন্দ আর আনন্দ।

আজ ঈদ। মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পুরা মাঠ চক্কর দিলাম। কত বয়স আমাদের? ১০-১১। এই বয়সে মনে হয়না এর থেকে আর আনন্দের ব্যাপার আছে।

আমি যখনি স্কুলের কথা মনে করি- অনেক গুলা ঘটনা ছাপিয়ে মাঝে মাঝেই আমার এই পেনাল্টি শটটার কথাই মনে পড়ে। অঙ্কে হাইয়েস্ট পাওয়া, মাথায় ফ্যান পড়া, এমনকি কর্নার থেকে ডাইরেক্ট গোল দেওয়া, ক্রিকেটে একাই ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়া কোন কিছুর সাথেই এটার তুলনা হয়না। মীর সরাইয়ে যে ৪০ জন মারা গেল তারাও বেশিরভাগ পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র ছিল। তারাও এরকমই এক ফুটবল ম্যাচ জিতে ফিরছিল। তাদের আনন্দও নিশ্চয়ই আমাদেরটার মতই ছিল।

কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর বিয়েতে সেই ফুটবল টিমের অনেকেই হাজির। এদের কেউ এখন আমেরিকায় থাকে, কেউ কানাডায়, কেউ ইংল্যান্ডে। ইকবাল ডাক্তার, দীপ্র ঢাবি এর টিচার। জাকির হোসেন থাকে নিউজিল্যান্ড। আবুবক্কর তো মেয়ের জন্মই দিয়ে ফেলেছে।

একবার খালি ভাবলাম আমাদের জীবন যদি সেখানেই থেমে যেত? মনটা কেমন জানি বিষন্ন হয়ে গেল। আমাদের জয়ে অবশ্য নবী স্যার মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন 'খ' শাখা জিতুক। পরের দিন সেই ক্লাসেই ঢুকেই হুঙ্কার দিলেন টাইব্রেকার মিস করেছে কে? দশবার কানে ধরে উঠবোস। আর হা আর যেন কোনদিন ফুটবলের নাম না শুনি।

তা কি আর হয়!! আমাদের আর ঠেকায় কে?? কোন ভাবেই যেন সামান্য একটা কারনে এভাবে ৪০ জনের জীবন না ঠেকে যায়। মানুষের জীবনের থেকে বড় কিছু আর নাই। যারা এটা জানে তারা সব কিছুই জানে। যারা জানেনা, তারা আসলে কিছুই জানেনা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.