সাংবাদিকতার ছাত্র,আপাতত প্রবাসে আছি। গত এক ঘণ্টা ধরে ইশিতার জন্য অপেক্ষা করছি। বেইলি রোড জায়গাটা অবশ্য অপেক্ষা করার জন্য খারাপ না। প্যারিস যদি প্রেমের নগরী হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের বেইলি রোডও ঢাকার বুকে এক খণ্ড প্যারিস। সকল প্রেমিকপ্রবরদের তীর্থস্থান।
আমি ঢাকার মেয়র হলে বেইলি রোডকে ‘প্রেমের অভয়ারণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করতাম। গত এক ঘণ্টায় আমি এক এলাকার প্রেমাক্রান্ত ছেলে মেয়েদের নিয়ে মোটামুটিভাবে একটা গবেষণা করে ফেলেছি। সবাই একধরনের সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ। শেষকক্ষপথে ইলেকট্রন শেয়ারের মত এরাও একে অন্যের হাত শেয়ার করছে। সবার এমন হাত ধরাধরি করে হাঁটায় অবশ্য নিরীহ পথচারীদের একটু সমস্যা হচ্ছে।
কিন্তু এটা কোনও সমস্যা না। প্রেমের জন্য সাত খুন মাফ।
বিকেল ৫টার মত বাজে। এই এলাকার স্কুল-কলেজগুলো ছুটি হয়েছে একটু আগে। কলেজপড়ুয়া মেয়েরা সব ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরছে।
এই সময়টায় এভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে দাড়িয়ে থাকা মোটেও নিরাপদ না। শুনেছি এই এলাকায় সাদা পোশাকে ডিবির লোকজন ঘোরাফেরা করে। ইভটিজিং এর মামলা দিলে বিপদ! আমি ইশিতাকে ফোন দেই।
-কি রে? কই? আর কতক্ষণ?
-এইতো নামছি। আর পনেরো মিনিটের মত লাগবে।
একটু ওয়েট কর প্লিজ।
-বুইঝো কিন্তু!! আমি পনেরো মিনিটের বেশি আর এক মিনিটও কিন্তু এইখানে নাই।
-আসছিতো! একটু দাড়া না। এমন করিস ক্যান?? (ইশিতা ফোন কেটে দেয়)
এতক্ষণ যারা ভাবছিলেন, আমি ইশিতার ভাগ্যবিরম্বিত প্রেমিক, তাদেরকে একটু ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা করি। আমি যে ইশিতার কী? সেটা আমিও যেমন জানিনা, অন্যরাও জানেনা ইশিতাও জানেনা।
আমি ভাই আর প্রেমিকের মাঝামাঝি একটা নোমান্স ল্যান্ডে অবস্থান করছি। দুই দায়িত্বই খুশি মনে পালন করি। ইশিতা অবশ্য ভাই বানিয়ে ফেলার একটা অপচেষ্টা মাঝেমাঝেই করে। আমি খুব কৌশলী হওয়ায় সেটা আর সফল হয়ে ওঠেনা। আমি এই ইশিতাকে খুবই পছন্দ করি, এটা ইশিতা জানে।
সমস্যা সেখানেই। বল এখন ইশিতার কোর্টে। ইশিতা সমানে গোল দেয়। আমিও নির্বিবাদে গোল খাই। প্রেমে পড়লে যে গোল খেতে হয়, নিয়মটাই এমন!
আজকে অবশ্য অপেক্ষা করছি অন্য কারণে।
আমাদের দুইজনেরই টিউশনি এই দিকে। মাঝে মাঝে টাইমিং মিলে যায়। আমরা একসাথে হলে ফিরি। আমার তিরিশ টাকা রিকশাভাড়া বেঁচে যায়। টাকার অঙ্কে তিরিশ টাকা অনেক।
এই টাকায় পাঁচটা বেনসন সিগরেট পাওয়া যায় কিংবা নীলক্ষেত থেকে হাফ প্লেট তেহারি খাওয়া যায়। যেখানে তিরিশ টাকা বেঁচে যাচ্ছে সেখানে অপেক্ষা কোনো ব্যাপার না।
সারে পাঁচটার দিকে মহীয়সী ইশিতার দেখা মেলে। ঢাকা শহরেরে নিষ্ঠাবান মহিলা গৃহশিক্ষিকাদের লিস্ট বানালে, সেই লিস্ট ইশিতা উপরের দিকে থাকবে। গুনে গুনে টানা তিন ঘণ্টা পড়ানোর মত ধৈর্য সবার থাকে না।
ইশিতার আছে। আমার ছাত্র অবশ্য আমার মতই অদম্য মেধাবী। গত পরীক্ষায় সাত বিষয়ে আট বার ফেল করেছে। একটা পরীক্ষা রিটেক ছিল, অদম্য মেধার পরিচয় দিয়ে আমার ছাত্র সেই বিষয়েও ফেল করেছে। কিন্তু ইশিতার ছাত্রী নাকি ইশিতার মতই লক্ষ্মী।
ক্লাসে প্রতিবারই ফার্স্ট হয়।
দূর থেকে ইশিতাকে দেখি। মেয়ে পানিশূন্যতায় ভুগছে মনে হয়। চোখ-মুখ খুব শুকনো দেখাচ্ছে। আমি ওর জন্য এক প্যাকেট টেস্টি স্যালাইন কিনে ফেলবো কী না, যখন এই জাতীয় একটা সিধান্তহীনতায় পরে গেলাম, তখন দূর থেকেই ও ডাক দেয়।
-দাড়িয়ে দেখছিস কী? রিকশা দেখ।
-রিকশা দেখবো?
-তো????
-খাওয়াবিনা কিছু??
-কি খাবি??
আবারও একবার ধান্ধায় পড়ে গেলাম। কী খাব এইটাতো জানিনা। বলার দরকার মনে হল বললাম। বলে ফেলে নিজের কাছেই খারাপ লাগছে।
এই মেয়ে তিন ঘণ্টা একটানা পড়িয়ে এসেছে। ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যায়, ও কতটা ক্লান্ত। তবুও সে ‘না’ বলবে না। হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমাকে খাওয়াবে এবং নিজেও ভাব নিবে যে, খুব মজা করে খাচ্ছে। আসল ব্যাপারটাতো তা না।
এখন ফাস্টফুডে বসার মত মানসিক বা শারীরিক কোনও অবস্থাতেই ইশিতা নেই। কিন্তু ওই যে, ওর মাঝে আমি একজন ‘মা’ কে দেখি। ‘মা’ রা যেমন না বলেন না, ইশিতাও না ঠিক তেমন, না বলতে কোথায় যেন ওর সমস্যা।
আমি কথা ঘুরিয়ে ফেলি।
-থাক বাদ দে।
আজকে আর না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
-তো?? সমস্যা কি? তোর কি কাজ?
-কাজ আছে অনেক। রাতের শিফটে একটা ডেটিং আছে। রিকশা ডেটিং।
রিকশায় করে ঢাকা শহরের সব চিপায় চাপায় ঘুরাঘুরি করবো।
-খুব জরুরী??
-অবশ্যই খুব জরুরী। আমার কথার দাম আছে। একজনকে কথা দিয়েছি, তার সাথে আজকে আমার “আন্ধার রাতে প্রেম” করার কথা।
-কাকে কথা দিছিস? কি নাম?
আমি তথমত খেয়ে যাই।
মিথ্যা বলার জন্য যথেষ্ট স্মার্ট হতে হয়। আমি মোটেও স্মার্ট না। তবে ইশিতাকে আমি আর সুযোগ দেই না। রিকশায় উঠে বসি। তারপরও ইশিতা কিছুক্ষণ নামানোর জন্য টাল-বাহানা করে।
আমি নামিনা। আমি এক কথার লোক। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে, ও রিকশায় উঠে বসে। রিকশায় ঘুরাঘুরি আমাদের দুজনেরই খুবই পছন্দের। আমরা প্রায় ঘুরি।
ঘুরতে ঘুরতে রাজ্যের গল্প করি। সেসব গল্পগুলোও বড় অদ্ভুত। অধিকাংশ সময় আমিই গল্প করি। ইশিতা শুধু শোনে, আর চুড়ি ভাঙ্গা শব্দে হাসে।
রিকশায় উঠে অনেকক্ষণ দেখি মেয়ে কিছুই বলেনা।
পানিশূন্যতা ওকে মনে হয় হয় ভালই ধরেছে। তখন স্যালাইন না খাইয়ে বিরাট ভুল করেছি। এভাবে একা একা বসে যাওয়া যায়? তারপরও আমি মুখে তালা মেরে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। একটা সময়ে এসে গুনগুনিয়ে গাই-
“ও প্রেমের কবুতর,
এই মনের খোপে বাঁধলে তুমি ভালবাসার ঘর। ।
বাক বাক বাকুম বাক
বাক বাক বাকুম বাক। । ”
আমি এই কয় লাইনই বার বার ঘুরেফিরে গাই। একটা সময় ইশিতা ঘাড় ঘুরায়।
-এইটা কোন ধরনের গান?
-এইটা বংলা ছবির গান।
ছবির নাম ‘প্রেমের কবুতর’।
-গ্রাম বাংলার প্রেমকাহিনী। ইলিয়াস কাঞ্চন আর দিতি অভিনিত। হৃদয়কাঁপানো প্রেমের ছবি।
-তুই বাংলা সিনেমা দেখিস?
-অবশ্যই।
সারাদিনই দেখি। আমার প্রিয় নায়ক ইলিয়ায়স কাঞ্চন। প্রিয় নায়িকা অঞ্জু ঘোষ। আর প্রিয় ছবি হলো-’বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’।
ইশিতা হাসে।
সেই চুড়ি ভাঙ্গা হাসি। আমি হাবার মত ওর দিকে চেয়ে থাকি। আমি আবার গান ধরি-
তোমার এই মিষ্টি হাসি
বড় যে বাংলাদেশী
-এই বদ, এটা আবার কার গান?
-সাকিব খানের। দি কিং খান।
ইশিতা আবারও চার পাশ কাঁপিয়ে হাসে।
দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে আসা এই শহরটায় প্রান ফিরে আসছে বোধহয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।