আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হঠাত ঘাসের ঘ্রাণ

পারুল নিচের দিকে তাকিয়ে একবার হাসলো যেন | শেষ বিকেলের আলো তার মুখের একটি পাশ আলোকিত করে রেখেছে | ভ্রমরকৃষ্ণ চুলে, অস্তাচলের লালিমা জড়ানো | আমি আলতো করে ডাকলাম, পারুল ! পারুল অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিল, -উঁ ! -কি ভাবছ ? -অনেক কিছু | -ভাবনাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে | আমার কাছে কাগজ কলম আছে | বল, আমি লিখে ফেলছি | -উঁহু | হারায়, হারাক | আচ্ছা ! আমাকে একলব্যের গল্পটা আবার বলনা ? -আবার? অনেক বারই তো শুনেছ | -আবার বল. তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগে | আমি বইয়েও পড়েছি ওটা. অতটা ভালো লাগেনি, যতটা.. পারুল থেমে গেল. আমি হেসে বললাম, বল বল ? -না | -কেন? -তোমার অহংকার হবে | -আমার অহংকার এখনো বেশ হচ্ছে | তুমি পারলেনা ঠেকাতে | -তাই বুঝি? তাহলে জেনে নাও, ধরনীতল টানছে তোমায়..| - হা হা হা ! আমি পারুলকে কাছে টেনে নিলাম | হেঁটে হেঁটে একটা বড় বাগানবিলাসের নিচে এসে দাড়ালাম আমরা | অন্য এক অচেনা গাছকে ঘিরে, বেড়ে উঠেছে বাগানবিলাসটা | সবুজ পাতা, ঢেকে গেছে লালচে গোলাপী পাতার আড়ে | ঘাসের ওপর ব্যাগটা রেখে পারুল বসে পড়ল | আর, হাত দুটোকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি | পারুলের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলাম | আবৃতি করলাম- ''রুক্ষ এ হাতে, কোমল তোমার হাত ধরিব জড়ায়ে..'' পারুল ম্লান হাসলো | -পারুল | ভাবনা কি? -ভাবনা কিছু না | রাতের বেলা খুব ভয় হয় | -তাই বুঝি | রাত তো ভয় হবারই সময় | হতে দাও | পারুল হেসে ফেলল | বলল, তোমার ভয় করেনা? আমি বললাম, ভয় কিসের? -সময়ের? খুব খারাপ কোনো সময়ের..? -নাহ | বলে আমি সূর্যের দিকে তাকালাম | পারুল আমার চুলে গভীর স্নেহে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিল | একসময় বলল , এদিকে ফের, বল, কেন তোমার ভয় করেনা | আমি চশমার আড়ালে পারুলের গভীর চোখজোড়ার দিকে তাকালাম. নরম স্বরে বললাম, এইযে এমন সোনার দিন যাচ্ছে, প্রকৃতি একদিন তা কৃষ্ণসময় দিয়ে বদলে দেবে, সমতা করবার জন্যে, এই তো ভয় ? -হুমম | -পারুল | অনেক কষ্টের দিন গেছে বলেই তো এই সোনার দিনগুলো এসেছে | তাই না ? তখন , কোনো একদিন এ অন্ধকার সময় কেটে যাবে, এ স্বপ্ন নিয়ে আমরা বেঁচে ছিলাম | আমরা তো স্রষ্টার প্রাকৃতচক্রের কথা জেনেই গেছি | স্বপ্ন আর দু:স্বপ্ন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ | দুই পিঠেই বিজয় লেখা আছে | জানো না সে কথা ? পারুল চুপ করে রইলো বহুক্ষণ | একসময় মৃদু হেসে বলল, তোমার কথা বিশ্বাস করতে ভালো লাগে | মাঝে মাঝে ভাবি, এত সাহস কোথা হতে পাই ? মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে আমি | রিটায়ার্ড সরকারী অফিসার বাবা, গতমাসে তাঁর বেতনের শেষ টাকা কটা তুলে আনলেন | সেকেন্ড ক্লাস গেজেটেড অফিসার ছিলেন | পেনশন যা পাবেন, তার একটা বড় অংশ ঋণ শোধে আর বাড়ির অবশিষ্ট কিস্তি পরিশোধ করতেই বেরিয়ে যাবে | মা একটা জুনিয়র স্কুলে শিক্ষকতা করে, পরিবারের গায়ে সচ্ছলতার পোশাকটুকু এখনও টিকিয়ে রেখেছেন | বাবা প্রায়ই আমাকে ডেকে বলেন, তোর লেখাপড়ার আর কতদূর | আমি বলি, এইতো বাবা | শেষ হল বলে | বাবা বলেন, সংসারের হাল ধরবি, বাবা-মা কে খাওয়াবি এমন বলছি না | নিজেকে শুধু, নিজের জন্যেই খানিকটা তৈরী কর | বড্ড খামখেয়ালী তুই | আমি চুপ করে শুনি | ছোটবেলায়, ছাত্র হিসেবে নাম কুড়িয়েছিলাম বেশ | স্কুলজীবনে স্যারদের প্রশংসা আর প্রত্যাশা ছাড়া ভিন্ন কথা শুনিনি কখনও | কলেজেও তাই | বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই সব বদলে গেল | অথচ শুদ্ধ থাকবার প্রয়োজন ছিল এখানটাতেই সবচেয়ে বেশি | স্কুল কলেজে যারা কোনদিন পরীক্ষায় নাম্বারে ছুঁতেও পারেনি আমাকে, তাদের অনেকেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছে কদিন বাদে | আর আমি ? কাজের মাঝে, অর্থহীন কবিতাদের জন্ম দিই, যাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য হয় ওয়েস্টপেপার বাস্কেট | সেখানে তারা দলোমলো হয়ে পচতে থাকে | দুএকটা আলোর মুখ দেখে শুধু | বেশির ভাগই থাকে অন্ধকারে | হাত ধরে আদরে সবাইকে আলোতে নিয়ে আসব, সেই উত্সাহটুকু পাইনা | ইচ্ছে হয়, পিছুডাক কে পেছনে ফেলে, চলে যাই আমার ছোট্ট গ্রামের বাড়ি | সেখানে নিভৃতে বসে ভোরবেলা, শুনব যত বুনো পাখির ডাক | বিকেলে, খরস্রোতা মাতামুহুরীর সাথে অস্তাচলের আবীর মাখাবো গায়ে | মাঝরাতে লক্ষীপেঁচার সাথে মাতব কবিতার জলসায় | যে রাতে খুব জোছনা ঝরবে ভুঁয়ে , সেরাতে ; বাঁশঝাড়ের কাছে বসব বাঁশিটা হাতে নিয়ে | হঠাত নেমে গিয়ে স্বচ্ছ পুকুরের জলে, টুক করে ছুঁয়ে দেব চাঁদের ছায়া.. | পারুলের পরিবার থেকে তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আমাতে চলবে না | তার পছন্দের মুল্য দেয়া হবে, তা যেমন ঠিক,আবার আমার মত একটা বাউন্ডুলেকে গ্রহণ করার হবে না, তাও তেমনই ঠিক | আমাকে পারুল বলে , তুমি যেমন আছ তেমনি থেকো | কেউ একজন থাকুক তোমার মত | আমার হাতে, তার হাতের চাপ মৃদু বাড়ে | আমি বুঝতে পারি, পারুল আমাকে ভালবাসে | কিন্তু, মনে এও জানি... -কি ভাবছ ? পারুলের প্রশ্ন । -ভাবছি..অনেককিছুই..| -কাগজ কলম তো আছেই | লিখে ফেল | ভাবনা হারিয়ে যাচ্ছে | -হা হা হা | হারায় হারাক | পারুল খিল খিল করে কিশোরী মেয়ের মত হেসে উঠলো | সাথে হাসলো লালচে আলোয়, একরাশ পিঙ্গল মসৃন চুল |  


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।