ছুড়ে ফেলার ইতিহাস যাদের দীর্ঘ
ফকির ইলিয়াস
==============================
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার মনের কথাটি বলেই ফেলেছেন। বলেছেন তারা ক্ষমতায় গেলেই পনেরতম সংশোধনী ছুড়ে ফেলে দেবেন। পঞ্চদশ সংশোধিত সংবিধানকে আওয়ামী লীগের ইশতেহার আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় গেলে তা ছুড়ে ফেলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, ‘আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধান সংশোধন করে এটিকে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে পরিণত করা হয়েছে। তাই আমরা যেদিনই ক্ষমতায় যাবো, এ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবো।
’ খালেদা জিয়া বলেন, ‘গত আড়াই বছরে সরকার জনগণের ওপরে যে অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন চালিয়েছে সেগুলোর বিচার হতে পারে বলে ভয়ে তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। এ কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। যদি কোনো নির্বাচন হয় সেটি হবে হাসিনা-এরশাদের নির্বাচন। সে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না।
আর বিএনপি অংশ না নিলে ওই নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ’ এটা কে না জানে, খালেদা জিয়ার সামনে এখন খুব বেশি পথ খোলা নেই। না থাকার কারণ হচ্ছে, তার দুই পুত্রের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। এ নিয়ে ‘বিএনপির বুদ্ধিজীবী’ মহলও শঙ্কিত। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সফরে এসে তেমনটিই বলেছেন ঐ চেতনাবাদী আরেক সাংবাদিক শফিক রেহমান।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত, সাংবাদিক-কলামিস্ট শফিক রেহমান নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, এই মুহূর্তে তারেক রহমানকে সামনে এনে আন্দোলন করা ঠিক হবে না। বেগম খালেদা জিয়াকে সামনে রেখেই আন্দোলন করতে হবে। আর সরকারের যে অবস্থান তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন না। জ্যাকসন হাইটসে পালকি পার্টি সেন্টারে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকালে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে শফিক রেহমান আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নিরন্তরভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে চিহ্নিত করতে। অথচ বিএনপি হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক দল।
এর সাথে জামাতের কোনোই সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বেগম খালেদা জিয়াও বিচার পাননি। বিচার পাবো না বলে নিজের পত্রিকা ফিরে পেতে আদালতের দ্বারস্থ হইনি। ’ শফিক রেহমান বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে প্রচারের জন্য তারেক পরিষদ আন্তর্জাতিক কমিটির বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশের অসহনীয় পরিস্থিতির তথ্য জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে হবে। শফিক রেহমান যে মিথ্যা বলছেন, তা না বুঝার কোনো কারণ নেই। কারণ এই দেশে রাজাকার-আলবদর শক্তিকে পুনর্বাসিত করেছে এই বিএনপি। ওদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে জঙ্গিবাদের বীজ বুনেছে।
দেশে একযোগে বোমা হামলার পরও দেশের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ভাবখানা ছিল এমনÑ যেন কিছুই হয়নি!
হ্যাঁ, দেশের মানুষকে, দেশের সংবিধানকে ছুড়ে-ছিঁড়ে ফেলার ইতিহাস সামরিক ব্যরাকধারীদের বেশ দীর্ঘ। তারা সব সময়ই চেয়েছেন সংবিধান হবে তাদের ইচ্ছে পূরণের একান্ত সনদ। ইনডেমনিটি বিল করে জাতির জনক হত্যাকা-কে তামাদি করার চেষ্টাতো তারাই করেছিলেন। খুনিদেরকে বিদেশে পালিয়ে যেতে অথবা পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর যতোগুলো সংশোধনী তারা করেছেন, সবগুলোই করা হয়েছে দেশের মানুষকে বোকা বানানোর জন্য।
তারা বলেছেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরেপেক্ষ নয়। তার পর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস করতে বাধ্য হয়েছেন।
দুই. আমাদের অনেকেরই মনে আছে, সভ্যতা-মানবতার মাথা খেয়ে কিভাবে এই দেশে খুনিদেরকে বাঁচানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। পনেরই আগস্টের নির্মমতম হত্যাকা-ের পর দেশ তখন চরমভাবে অস্থির। তেমনি এক সময়ে সকল সত্য ইতিহাস ধামাচাপা দিতে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খুনিদের ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমান স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খুনিদের সহায়তায় মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন।
অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ ছিল।
প্রথম অংশে বলা হয়েছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় অংশে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়।
সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। পরে তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যেতো।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়িয়েছিল। নানা ধরনের দাম্ভিক উচ্চারণ করেছিল।
খুবই দুঃখের কথা বেগম খালেদা জিয়া ও তার দল ভ্রান্তপথে দেশকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছেন বার বার। এমনকি তার নিজের পরিবারের সদস্যদের বিষয়েও স্বচ্ছ ধারণা দিচ্ছেন না দেশবাসীকে।
এমনি একটি তথ্য আবারো দেখছেন দেশবাসী। মুদ্রাপাচার মামলায় দ-িত আরাফাত রহমান কোকো থাইল্যান্ডে নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত। তিনি বলছেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে এখন রয়েছেন মালয়েশিয়ায়। ১২ জুলাই ২০১১ মঙ্গলবার ঢাকার থাইল্যান্ড দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে থাই রাষ্ট্রদূত তাসানাওয়াদি মিনাশ্যারোয়েন এ কথা বলেন। কোকো থাইল্যান্ডে নেই বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পাওয়া গেলেও এই প্রথম দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মুখ থেকে তা জানা গেলো।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কোকো থাইল্যান্ডে নেই, তিনি আছেন মালয়েশিয়ায়। এ বিষয়ে আপনারা মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ’ ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোকোও গ্রেপ্তার হন। পরে সরকারের নির্বাহী আদেশে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই ছাড়া দেন তিনি। এর একদিন পরই চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড যান তিনি।
এরপর কোকোর বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচার আইনে একটি মামলা হয়। সে মামলায় গত ২৩ জুন তাকে ছয় বছর কারাদ- দেয় আদালত। সেই সঙ্গে তার ১৯ কোটি টাকা জরিমানাও হয়। কোকো থাইল্যান্ড যাওয়ার পর তার মুক্তির মেয়াদ কয়েকদফা বাড়ানো হলেও বর্তমান সরকার গত বছর তা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর কোকোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।
এভাবে বেগম জিয়ার সামনে এখন অনেক প্রতিকূলতা। তিনি বলেছেন, হরতাল নয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। কর্মসূচি শুরু হবে ঈদের পর। দলের আয়োজিত গণঅনশন কর্মসূচির সমাপনী বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আর জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-ধ্বংসের রাজনীতি নয়, হরতাল নয়, মানুষকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মতো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটানো হবে। ’
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কি তিউনিশিয়া, মিসরের মতো অবস্থা বিরাজ করছে? দেশের মানুষ সে বিবেচনা অবশ্যই করবেন।
তবে অবরোধ, ঘেরাও করে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারকে টলানো যায় না। দেশের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানো যায়। ব্যারাকপন্থী রাজনীতিকরা এই দেশে বারবার সংবিধানকে ছুড়ে ফেলেছেন। আর মানুষ আর তা তুলে এনে ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি ও স্বদেশপ্রেমের সাথে লালন করেছে। বেগম জিয়া কী ভাবছেন, তিনি আগামী নির্বাচনেই দুই-তৃতীয়াংশ আসনের মেজরিটি পাবেন? আর সংবিধানকে মনের মতো করে কাঁটাছেড়া করবেন? কোনো দাম্ভিক উচ্চারণই ভালো ফল বয়ে আনে না।
অতীতেও আনেনি। আগামীতেও আনবে না। পারাজিত জঙ্গিবাদী-মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে যারা মাঠ গরম করতে চাইছেন, তারা অতীতকে মনে রাখলেই ভালো করবেন।
১৪ জুলাই, ২০১১
-------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা ।
১৭ জুলাই ২০১১ রোববার
ছবি- মিরো মারিয়ান ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।