আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রস্তাবিত সিভিল সার্ভিস আইন : বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই চাকরি নয়!

জনপ্রশাসনবিষয়ক প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের চাকরি পেতে হলে সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ পর্বও অতিক্রম করতে হবে। বিসিএস ও প্রশিক্ষণ উভয় পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তাঁরা নিয়োগ পাবেন। নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবে সরকার-নিযুক্ত একটি ‘সিলেকশন বোর্ড’। নতুন বিধিব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি চাকরিব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ‘সিভিল সার্ভিস আইন ২০১০’ নামে নতুন একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই আইন নিয়ে এখন বিভিন্ন ক্যাডারের মতামত নেওয়া হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেছেন, নতুন এই আইন রাজনৈতিকীকরণ ও দুর্নীতির পথ সুগম করতে পারে। অন্যদিকে সরকার বলছে, সবার মতামত নিয়েই এটি চূড়ান্ত করা হবে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুসারে, বিসিএসের প্রচলিত কোনো ক্যাডার-ব্যবস্থা থাকবে না। সব ক্যাডারকে কয়েকটি গুচ্ছে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পদোন্নতির জন্য গঠন করা হবে স্বতন্ত্র সরকারি কর্মকমিশন।

এদিকে প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে এরই মধ্যে পুলিশ ক্যাডার আপত্তি তুলেছে। নিয়োগের পদ্ধতি: প্রার্থী বাছাই পরীক্ষার পর সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) মূলত উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের নাম দিয়ে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে। শুধু কারিগরি ও বিশেষায়িত পদের ক্ষেত্রে পদের উল্লেখ করা হবে। অর্থাৎ পিএসসি কোনো ক্যাডার নির্ধারণ করতে পারবে না। কারিগরি ও বিশেষায়িত ছাড়া অন্য সব পদের কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হবে।

নিয়োগ পরীক্ষা এবং তারপর প্রশিক্ষণের ফলের ভিত্তিতে প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সিলেকশন বোর্ড এ নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসি বর্তমানে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করে। তালিকা অনুসারে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারকে সুপারিশ করা হয়। ক্যাডার নির্ধারণের কাজও পিএসসি করে থাকে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তোফায়েল আহমেদ এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, এই আইন কার্যকর হলে চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দ অনুসারে ক্যাডার নির্বাচনের এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বদলে প্রশাসনিক কমিটির হাতে চলে যাবে। একটি বিশেষ সার্ভিসকে সুবিধা দিয়ে আইন করা হলে সেটা কারও জন্য ভালো হবে না। আরও অনেক কিছু এই আইনে সংযোজন করতে হবে। প্রস্তাবিত আইন নিয়ে ১৫ জুন এক সেমিনারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, প্রস্তাবিত আইন কার্যকর হলে জনপ্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ আরও দৃঢ় হবে। একই সঙ্গে প্রশাসন ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়বে।

জনপ্রশাসন (সাবেক সংস্থাপন) মন্ত্রণালয়ের সচিব ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি এখনো পর্যালোচনার পর্যায়ে রয়েছে। কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। সবার মতামতের ভিত্তিতেই এটা করা হবে। কাঠামো: প্রস্তাবিত আইনে সিভিল সার্ভিস যাঁদের নিয়ে গঠিত হবে, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে থাকবেন সরকারের স্থায়ী রাজস্ব খাতের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা, সব ক্যাডারের সদস্য, সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব, মুখ্যসচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদাধিকারবলে এর প্রধান হবেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও এর সদস্য হবেন। গুচ্ছায়ন: প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে মন্ত্রণালয় ও সার্ভিসগুলোর গুচ্ছায়ন করতে পারবে। তবে বিধি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আগের ব্যবস্থা বহাল থাকবে। কর্মকর্তারা প্রেষণে সার্ভিসের এক গুচ্ছ থেকে আরেক গুচ্ছে যেতে পারবেন।

প্রশাসনে স্তর: জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের তিনটি স্তরে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে (সুপিরিয়র) রাখা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের কর্মকর্তাদের। জ্যেষ্ঠ স্তরে (সিনিয়র) আছেন তৃতীয় থেকে নবম—এই সাতটি গ্রেডের কর্মকর্তারা। কনিষ্ঠ স্তরে রাখা হয়েছে দশম থেকে দ্বাদশ গ্রেডের কর্মকর্তাদের। কনিষ্ঠ গ্রেডে নন-গেজেটেড প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে।

সর্বোচ্চ স্তরে ১০ শতাংশ কোটা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। জ্যেষ্ঠ স্তরে ৮০ শতাংশ সরাসরি এবং ২০ শতাংশ কনিষ্ঠ স্তর থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। পদোন্নতির পৃথক কমিশন: প্রস্তাবিত আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, পিএসসি পদোন্নতির পরীক্ষা নেবে। তবে পদোন্নতি-সংক্রান্ত পরীক্ষা পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র কর্ম কমিশন গঠন করা হবে। আবার এর বাইরেও অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে সরকার পরীক্ষা নিতে পারবে।

দুর্নীতি: খসড়া আইনের ২১(২) ধারা মতে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো কর্মকর্তা কোনো ঘটনার সম্মুখীন হলে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া ফৌজদারি বা অন্য কোনো মামলা করা যাবে না। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা যাবে না। এ ব্যাপারে ১৫ জুনের সেমিনারে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রস্তাবিত আইনে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যাপারে সরকারের অনুমতির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা দুর্নীতি রোধের চেষ্টায় ব্যত্যয় ঘটাবে। পুলিশ প্রশাসনের ভিন্ন মত: সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পর্যালোচনার জন্য গত ১৫ মে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত আইজি এ কে এম শহীদুল ইসলাম।

সভা থেকে এই আইনের ব্যাপারে একটি সুপারিশমালা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পুলিশের মতামতে বলা হয়, সিলেকশন বোর্ড কার্যকর হলে অযথা জটিলতার সৃষ্টি হবে। বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ওপর মেধাতালিকা করা হলে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও বোর্ডের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। একাধিক স্তরের কারণে নিয়োগের প্রক্রিয়া অনেক বিলম্বিত হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। সভার ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে পুলিশ ক্যাডারের পক্ষ থেকে মতামত পাঠানো হয়েছে।

এ ছাড়া অনেক ধারা সংশোধনের জন্য মতামত দেওয়া হয়েছে। পুলিশের মতামতে বলা হয়, সচিব স্তরের কর্মকর্তাসহ প্রস্তাবিত অনেককে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ক্যাডার নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। প্রস্তাবিত স্তরের উল্লেখ করে পুলিশ প্রশাসনের সূত্র জানায়, সর্বশেষ স্তরে পুলিশের সার্জেন্ট ও সাব ইন্সপেক্টররা রয়েছেন। নিয়ম অনুসারে ৬৭ শতাংশ সরাসরি ও ৩৩ শতাংশ বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই অংশ কমিয়ে দিলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে।

পুলিশের সুপারিশে আরও বলা হয়, শুধু পদোন্নতির জন্য আলাদা কর্ম কমিশন গঠন করা হলে সরকারি অর্থের অপচয় হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, এই আইন করে কোনো ভালো হবে না। এতে সমস্যা কমার বদলে আরও বেড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, নিয়োগের জন্য যে সিলেকশন বোর্ড করার কথা হয়েছে, সেটা বর্তমান পদ্ধতির তুলনায় মারাত্মক হবে। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির জন্য যে ১০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা আছে, সেটা নিয়ে দুর্নীতি হবে।

ওএসডি বন্ধ করার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থার কথাও এতে বলা নেই। দেশে জনপ্রশাসনে নিয়োগ-পদোন্নতি বিষয়ে কোনো আইন নেই। ১৯৮২ সালে প্রণীত ‘বিসিএস নিয়োগ বিধি’র মাধ্যমে পিএসসি প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ জন্য নতুন আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নীতিগত অনুমোদনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই আইনের খসড়া করে মতামতের জন্য বিভিন্ন ক্যাডারের কাছে পাঠায়।

সাধারণ মানুষের মতামতের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও তা দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই আইনের ব্যাপারে ৮২২টি মতামত এসেছে। সূত্র: Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.