গত ১৯ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রেস ব্রিফিং করেছিলেন। সেখানে সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম আমিও। আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি যে তথ্যটি উপস্থাপন করলেন, তা নিঃসন্দেহে চাঞ্চল্যকর। তিনি সরাসরি বললেন, ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেই নন, ন্যাশনাল কমিটি ফর ইনটেলিজেন্স কো-অর্ডিনেশনের (এনসিআইসি) সমন্বয়ক হিসেবেও তিনি বক্তব্য পেশ করেন এবং বলেন, 'দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য র্যাবকে বিলুপ্ত করার চক্রান্ত চলছে।
এ চক্রান্তের সঙ্গে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক জড়িত। ওই পত্রিকায় ৪০ দিনে র্যাবের বিরুদ্ধে ৪৮টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটির সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে অনেকেরই প্রশ্ন, উনি কি পার্ট অব জঙ্গি? দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে উনার কী লাভ? র্যাবের সফলতায় তিনি কি মনোক্ষুণ্ন? আগেরও কিছু ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্রব রয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত এক জঙ্গি তাদের সঙ্গে ওই সম্পাদকের বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়েছে। সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স তাঁকে চক্রান্তকারী হিসেবেই শনাক্ত করে।
এসব কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে প্রধানমন্ত্রী এখনো তা চান না। '
আমি চমকিত এবং শিহরিত হলাম এই কারণে যে, এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের জন্য কালের কণ্ঠকে চিহ্নিত করা হয়েছে 'হলুদ সংবাদপত্র' হিসেবে এবং সেটা করেছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। সুদীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের যে সম্পাদক সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাঁকে 'হলুদ সম্পাদকের এবং অপসাংবাদিকতার' দায়ে অভিযুক্ত করে সতর্ক করে দেওয়া হলো। আর আজ এই প্রেস ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনেরই যেন প্রতিধ্বনি তোলা হলো।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ল কালের কণ্ঠের সেই প্রতিবেদনের কথা। গত বছর ১০ মে প্রকাশিত সেই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর জবানবন্দির বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, তাঁর ভাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার হোতা জঙ্গি নেতা তাজউদ্দিনের সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁদের বৈঠকও হয়েছে। গোয়েন্দারা যে তাজউদ্দিনকে খুঁজছে, সেটা মতিউর রহমান তাঁকে আগাম জানিয়ে দিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে এসব তথ্য লেখা হয়েছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক উপমন্ত্রী পিন্টুর জবানবন্দির ভিত্তিতে।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে মামলা ঠুকে দেন। সে মামলা বিচারের পর প্রেস কাউন্সিলের দেওয়া রায়ে বলা হয়, কালের কণ্ঠ হলুদ সাংবাদিকতা করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার প্রেস ব্রিফিংয়ে একই অভিযোগের প্রতিধ্বনি ওঠার পর আমার মতো একজন সাধারণ সাংবাদিকের মনে তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এল, তাহলে প্রেস কাউন্সিল কেন কালের কণ্ঠকে হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত করলেন?
অবশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনার সময় অভিযুক্ত পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদকের নাম বলেননি। তবে কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদন, প্রথম আলো সম্পাদকের মামলা এবং প্রেস কাউন্সিলের রায়ের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আমিসহ উপস্থিত সব সাংবাদিকের কাছেই পরিষ্কার হলো যে, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা কোন সম্পাদকের কথা বলেছেন। জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় অভিযুক্ত এই সম্পাদক যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, তা আর কারো বুঝতে বাকি রইল না।
তারিক আহমেদ সিদ্দিক যেহেতু একাধারে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা এবং এনসিআইসির সমন্বয়ক, কাজেই তাঁর মুখ থেকে যখন এ অভিযোগ আসছে, তাই ধরে নিতে আর কোনো দ্বিধা নেই যে, এ অভিযোগের ভিত্তি অনেক দৃঢ়। তিনি নিশ্চিত হয়েই অভিযোগ তুলছেন এবং তাঁর বক্তব্য সরকারেরই বক্তব্য।
যদি তা-ই হয়, তাহলে কেন কালের কণ্ঠকে হলুদ সাংবাদিকতার লেবেল এঁটে দেওয়া হলো? এটা এখন আমাদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেখানেই যাই, মনে পড়ে যায় প্রেস কাউন্সিলের ওই মন খারাপ করা রায়ের কথা। আর কষ্ট হয় এই ভেবে যে, আবেদ খানের মতো একজন জীবনভর সৎ সাংবাদিক-সম্পাদকের কর্মীবাহিনীকে দায় নিতে হলো হলুদ সাংবাদিকতার!
আরো মনে পড়ে, প্রেস কাউন্সিলে ওই মামলা চলার সময় আমাদের পক্ষ থেকে বারবার আবেদন জানানো হয়েছিল, কালের কণ্ঠ যে প্রতিবেদন করেছে, তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে খোঁজ নেওয়া হোক।
নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখা হোক। কিন্তু প্রেস কাউন্সিল কালের কণ্ঠের সে আবেদন আমলে নেননি। সেটা করা হলে আমাদের বিশ্বাস, হলুদ সাংবাদিকতার দায় আমাদের আর বহন করতে হতো না। দুঃসহ মর্মযাতনা থেকে আমরা মুক্তি পেতাম। জানি না, সে সুযোগ এখনো আছে কি না।
প্রেস কাউন্সিল তাঁদের বিচারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন কি না। যদি সুযোগ থাকে, আমাদের আকুল আবেদন থাকবে, প্রেস কাউন্সিল যেন সেটি করে সাংবাদিকতার অভিভাবকের ভূমিকাটি সমুন্নত রাখেন। প্রেস কাউন্সিলের রায়টি উচ্চ আদালতের স্ব-উদ্যোগে পুনর্বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব কি না, সে আবেদনও আমরা জানাচ্ছি।
প্রেস কাউন্সিলের রায়ের পর কালের কণ্ঠের সম্পাদক আবেদ খান গভীর মর্মদহন থেকে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, 'প্রেস কাউন্সিলের এক রায়ে কালের কণ্ঠ ও আমাকে হলুদ সাংবাদিকতার জন্য দায়ী করে সতর্ক করে দেওয়া হয় এবং সমগ্র রায় সাত দিনের মধ্যে প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি দেশে ফিরে এই রায় সম্পর্কে অবগত হই এবং প্রেস কাউন্সিলের রায় অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশের নির্দেশ দিই এবং তা প্রকাশিত হয়।
'আমার মর্মদহন এই কারণে যে, আমার সুদীর্ঘ পেশাগত জীবনে সর্বপ্রথম এবারই আমাকে এ ধরনের একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো। তবে আমি মাননীয় আদালতের এই রায়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছি। '
কালের কণ্ঠের সম্পাদকের এ শ্রদ্ধাবোধ প্রকারান্তরে সুদীর্ঘ সময় ধরে সৎ সাংবাদিকতায় তাঁর একনিষ্ঠতা, পেশাগত দায়িত্ববোধ ও প্রেস কাউন্সিলের প্রতি আস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সম্পাদক আবেদ খান প্রেস কাউন্সিলের রায়কে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি বিনীতভাবে এ কথাও উল্লেখ করেন যে, কালের কণ্ঠের সাংবাদিক কিংবা সাংবাদিকতাকে একটিমাত্র মোকদ্দমার নিক্তিতে বিচার করে হলুদ বা অপসাংবাদিকতার দায় চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত হবে। এই পত্রিকার সব সাংবাদিকই সততার বিচারে পরিপূর্ণভাবে পরীক্ষিত এবং সাংবাদিকতা পেশায় বহুল পরিচিত ও সম্মানিত।
'
আমরা মনে করি, কোনো সত্যই গোপন থাকবে না। কালের বিবর্তনে সত্য প্রকাশ হবেই। প্রেস কাউন্সিল তাঁদের বিচারে কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদনকে অসত্য ও বানোয়াট বলে রায় দিয়েছে। অথচ ওই প্রতিবেদনের তথ্যকে সরকারের দায়িত্বশীল পদ থেকে সমর্থন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক প্রেস ব্রিফিংয়ে আলোচিত সম্পাদক প্রসঙ্গে আরো জানান, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিয়ে আরো তদন্ত হচ্ছে।
গত ২১ মে একই ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপনবিষয়ক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এইচ টি ইমাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, 'একটি পত্রিকার সম্পাদকের জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতি সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন রয়েছে। '
আমাদের বিশ্বাস, সচেতন পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন, ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে। আমরাও চাই ঘটনা সঠিক দিকে গড়াক। প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসুক। মানুষ সব জানুক।
সময়ের বিচার বলে একটা কথা আছে। আমরা সেই বিচারের অপেক্ষায় রইলাম।
আরেকটি বিচারের ভার সময়ের ওপর, পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিতে চাই এবং অন্তত একটি প্রশ্ন জাতির বিবেকের সামনে তুলে ধরতে চাই। সেটা হলো_রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে কালের কণ্ঠ আগেই সংবাদ পরিবেশন করে হলুদ সাংবাদিকতার দায় পেল আর যে সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর পত্রিকা যে দিনের পর দিন এজেন্ডা সাংবাদিকতা করে চলেছে, তার বিচার কে করবেন, কিভাবে করবেন?
সেই অভিযুক্ত সম্পাদক মতিউর রহমানের পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো এ দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায় 'ওয়ান-ইলেভেন' বা 'এক-এগারো'র ঘটনায় যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা রেখেছে, তা কি 'হলুদ সাংবাদিকতা' নয়? আমাদের মতে, এটা হলুদ সাংবাদিকতা তো বটেই, চাইলে 'কালো সাংবাদিকতা'ও বলা যায়। সে সময়কার প্রথম আলোর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এ রকম অসংখ্য নজির।
সেসব লেখা পড়লেই বোঝা যায়, সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়েই সাংবাদিকতা করেছে প্রথম আলো। আর সে এজেন্ডা যে 'কালো এজেন্ডা', সে কথা বলাই বাহুল্য। পাঠকদের জানার সুবিধার জন্য এখানে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। যেমন :
ক্ষমতায় থেকে লুটপাট-দুর্নীতি করে সম্পদ গড়ে তোলা হয়
দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে ঢালাওভাবে মন্তব্য করে ২০০৭ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে_'...ক্ষমতায় থেকে লুটপাট ও দুর্নীতি করে সম্পদ গড়ে তোলা এবং লুটপাট অব্যাহত রাখতে ও সেই সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্য আবার নির্বাচনে জয়ী হতে যেকোনো পথ অবলম্বন_এই কাজটিই তো করেছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এ জন্য দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে তাঁরা অকার্যকর করেছেন।
...এখন রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ পথে চুরি-লুটপাট করে টাকা আয়ের সহজ পথ। এ জন্য তাঁরা বিনিয়োগ করেন, সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদার পোষেন, দল ও দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের টাকা দিয়ে তাঁরা মনোনয়ন কেনাবেচা করেন। '
আমরা সেনাবাহিনীর এই অবস্থানকে স্বাগত জানাই
সেনাবাহিনীর অবস্থানকে সমর্থন করে ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়_'আমরা সেনাবাহিনীর এই অবস্থানকে স্বাগত জানাই। বিগত বছরগুলোতে দেশে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লাগামহীন লুটপাট হয়েছে, দেশবাসী সেই অপকর্মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি ও বিচারের মুখোমুখি দেখতে চায়। রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে এসব অপকর্ম করে গেছেন।
ফলে এ ধরনের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি সব মহল, বিশেষভাবে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। '
জরুরি অবস্থা ঘোষণা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল
২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করতে ও জরুরি অবস্থার অপরিহার্যতা বিষয়ে লেখা হয়_'প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারেনি; বরং সর্বসাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে এই ধারার রাজনীতির চরম দেউলিয়াত্ব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। '
দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে
২০০৭ সালের ১১ জুন 'দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে' শিরোনামে প্রথম আলোতে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে সম্পাদক মতিউর রহমান লেখেন, 'দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে, কী হওয়া উচিত_তা নিয়ে এখন আবার ব্যাপক আলোচনা চলছে। তাঁরা কি রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন?'
'বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বলতে পারি, গত ১৬ বছরে আপনাদের দুজনের ক্ষমতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির অনেক অত্যাচার দেশবাসী নীরবে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে।
দয়া করে আপনারা রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। নতুন নেতৃত্বকে সামনে আসার এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিন। দুর্নীতি আর অপশাসন ছাড়া আপনাদের দেশকে দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। '
তিনি আরো লিখেছেন, 'ভবিষ্যতে নতুন নেতৃত্ব যদি আসে তবে তাদের সামনে থাকবে পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ। কারণ দুই নেত্রী প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশজুড়ে যে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের আখড়া গড়ে তুলেছেন, তা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
এখন সেখান থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা আর সুস্থ ধারা সূচনা করতে দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি তাঁরা এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তা দেশের জন্য ততই মঙ্গলজনক হবে। '
দুই নেত্রীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে
'মাইনাস টু ফর্মুলা'কে আরো উসকে দিতেই প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম 'সম্মানজনক প্রস্থানের সুযোগ থাকা উচিত' শিরোনামে ২০০৭ সালের ১১ জুলাই প্রথম আলোয় এক উপসম্পাদকীয়তে লেখেন_'...এটা কি দুই নেত্রীর জন্য বিশেষ বিবেচনায় একটি আপস ফর্মুলা? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। রাজনীতি, কূটনীতি, জগৎ ও জীবন আসলে পদে পদে আপসের সমাহার মাত্র। কোনো আপস করতে না চাওয়াটা অনিবার্যভাবে ব্যর্থতার পথে নিয়ে যায়।
তিনিই সফল, যিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় সব সম্ভাব্য ও গ্রহণযোগ্য আপসের মাধ্যমে মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। দুই নেত্রীর ব্যাপারে এ রকম একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে। সেটা হতে পারে তাঁদের সম্মানজনক প্রস্থানের সুযোগ খুলে দেওয়া। '
দুই নেত্রীর ভাবমূর্তি আজ কালিমালিপ্ত হয়েছে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর ২০০৭ সালের ১৭ জুলাই প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, "বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী অতীতে সব সময় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় 'নিজেদের লোক'দের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলত এ কারণেই দুই জনপ্রিয় নেত্রীর ভাবমূর্তি আজ এমন কালিমালিপ্ত হয়েছে।
১১ জানুয়ারির সর্বসম্মত পরিবর্তন-পরবর্তী বাংলাদেশে সেই ক্লেদাক্ত ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে তা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। "
পরিবর্তনকে এ দেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে
২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়_'১১ জানুয়ারির পরিবর্তনকে এ দেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। আর তা কেবল জোট সরকারের লুটেরা শাসন থেকে পরিত্রাণের জন্য নয়, তারা শাসনব্যবস্থায় এমন একটি পরিবর্তন আশা করে যা ভবিষ্যতে লুটেরা শাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। '
আমরা ফখরুদ্দীনের সব ভালো কাজে সমর্থন দিয়ে যাব
দেশে জরুরি অবস্থা জারির তিন দিন পর ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি 'ড. ফখরুদ্দীনের কাছে প্রত্যাশা' শিরোনামে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান লেখেন, 'জাতির অত্যন্ত সংকটময় এক মুহূর্তে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এগিয়ে এসেছেন। তাঁকে আমরা স্বাগত জানাই।
... আমরা তাঁকে একজন সৎ, যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে জানি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবেও তাঁর প্রতিটি কাজে আমরা এই দলনিরপেক্ষতা, সততা ও কার্যকর ভূমিকা দেখতে চাই। আমরা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সব শুভ উদ্যোগ ও ভালো কাজে পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়ে যাব। '
জরুরি আইন ঘোষণায় দেশে স্বস্তি ফিরে আসে
এরপর ২১ জানুয়ারি 'উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির এখনই সময়' শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনে মতিউর রহমান লেখেন, 'অত্যন্ত সংকটময় পরিস্থিতি থেকে দেশের বড় রকমের উত্তরণ ঘটেছে। ২২ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সামনে রক্তাক্ত সংঘর্ষের আশঙ্কাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
দেশের দুই প্রধান জোট যে নীতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, তাতে এ নির্বাচন হলে অগি্নসংযোগ, ধ্বংস, হত্যা, নৃশংসতাই ঘটত। এমন এক অবস্থায় জরুরি আইন ঘোষণায় দেশে স্বস্তি ফিরে আসে। ' তিনি আরো লেখেন, 'যতটুকু জানা যায়, দেশে এ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সশস্ত্র বাহিনী, তাদের এ ভূমিকা প্রায় গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধার করেছে। '
দেশ প্রায় অকার্যকর রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে গিয়েছিল
মতিউর রহমান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে বারবার একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ২০০৮ সালের ১০ মে প্রথম আলোতে 'নির্বাচন চাই, ১১ জানুয়ারির আগের অবস্থায় ফিরতে চাই না' শিরোনামে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে মতিউর রহমান লেখেন, 'দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর বিগত তিনটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে দেশের সমগ্র পরিস্থিতি ক্রমশ এক ধ্বংসের পথে চলেছিল।
পরপর বড় দুই দলের দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর দলীয়করণের মধ্য দিয়ে দেশের শাসনব্যবস্থাকে অকেজো করে তুলেছিল। এভাবেই বাংলাদেশ প্রায় একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে গিয়েছিল। '
এর পরই মতিউর রহমান লিখেছেন, 'বাংলাদেশকে প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার মোটামুটি পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছিল চারদলীয় জোট সরকার। যেটুকু বাকি ছিল, তা-ও প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পুতুল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। '
তাঁরা কি আগের মতোই চলবেন?
'মাইনাস টু ফর্মুলা' বাস্তবায়নে অর্থাৎ দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরাতে মতিউর রহমানের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
ওই একই মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, 'দেশের সাধারণ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, দুই নেত্রীর অবস্থান নিয়ে শুধু দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা আলোচনা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনায়ও বিষয়টি উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বলব, দুই নেত্রীর বিচার-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে, কোনো প্রভাব সৃষ্টি গ্রহণযোগ্য হবে না। একই সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান কী হবে, সেটা নিয়ে দলীয় নেতৃত্ব ও তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে কি না, সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিবেচনা করতে পারে। দুই নেত্রী সিকি শতাব্দী ধরে দলীয় নেতৃত্বে আছেন।
তাঁরা কি আগের মতোই চলবেন?'
মতিউর রহমান লেখেন, 'রাজনীতিবিদদের অনেকে এখন উল্টো সুরে কথা বলছেন, যেন দেশে ১১ জানুয়ারির পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন ছিল না, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো ভুল বা বাড়াবাড়ি ছিল না, কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। ভাবখানা এমন যে, দ্রুত একটা নির্বাচন দিয়ে অতীতের ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। '
এ রকম নজির আরো আছে। দেশকে অশুভ শক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া বা দেশে অশুভ শক্তি ডেকে আনার চেষ্টার এজেন্ডা নিয়ে সাংবাদিকতার অনেক নজির পাওয়া যাবে প্রথম আলোর পাতা ওল্টালেই।
এসব 'এজেন্ডা তথা কালো সাংবাদিকতা'র বিচার ও এর বিরুদ্ধে রায় একদিন পাওয়া যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আমরা শুধু সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।