তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা আজ শুক্রবার. নামাজ পড়ে খেলাম। আরও কয়েকজন এসেছিলেন।
একটি বিষয় আমাকে এখানে খুব ভাবায়। এখানে যেসব বাংলাদেশী ইমাম ও মুআজ্জিন চাকরী করছেন, তারা এই কাতারের বিলাসী জীবন পেয়ে নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যত ও শিক্ষা সংস্কৃতির গড়ে ওঠার প্রতি মোটেও যতœশীল নন। কারো কারো ক্ষেত্রে এই উদাসীনতা চরম পর্যায়ের।
পড়ালেখার খবর তো দূরে থাক, গায়ের পোষাক, মুখের ভাষা- সব কিছুতেই তারা ভুলে আছে নিজেদের দায়িত্ব। আমি অবাক হই, কোনো কোনো অনুষ্ঠানে যখন কয়েকজন মিলিত হন, তাদের ছেলেরা তখন নিজেদের ভাব বিনিময় করছে ইংরেজীতে, আর হুজুরদের ছেলেরা আরবীতে। বাংলার কোনো অস্তিত্ব নেই তাদের কথায়। বাংলা বলার যখন এই দূরাবস্থা, পড়তে পারার যে কী করুণ দশা, তা আর বলার নয়। আমি অনেক মাওলানাদের ছেলেদের গায়ে ডিসকো গেঞ্জি, হাতের মোবাইলে সারাক্ষণ ইউটিউব ভিডিও নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি।
মসজিদের ইমাম সাহেবদের সন্তানদের যখন এই অবস্থা, ইংরেজী শিক্ষিতদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ভাবখানা এমন যেন, বাংলাদেশে থাকার কোনো কল্পনাও তাদের সন্তানদের নেই। শুনেছি, অনেক ইমাম মুআজ্জিনের স্ত্রী দিনের অধিকাংশ সময় ইন্ডিয়ান চ্যানেল দেখে কাটিয়ে দেয়। অনিয়ন্ত্রিত খাবার দাবার, ইন্টারনেট আসক্তি এবং নিজেদের সমাজ থেকে দূরাবস্থান তাদেরকে এবং তাদের প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও দায়িত্বশীল সমাজে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলছে। অনুভূতি শক্তি লোপ পাওয়ার যে দৃশ্য এখানে দেখছি তা যদি এভাবে চলতে থাকে তবে ভবিষ্যত ভয়াবহ।
।
কাতারে যত বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, নেপালী, শ্রীলংকান এবং ভারতীয় রয়েছে- এদের সবার পাস্পরিক যোগাযোগের ভাষা উর্দু। অনেকবার এমন হয়েছে, উর্দুতে কথা বলে কাজ শুরু করার পর জানলাম, যার সাথে এতক্ষণ দর কষাকষি করলাম কোনো দোকানে ‘ইয়ে কেতনা হায়’ অথবা ট্যাক্সিতে ‘তুম যায়েগা ভাই উধার’ কিংবা কোনো সেলুনে অথবা পথ চেনার জন্য ভাই ‘ও রাস্তা কিধার হায়?’ সবই উর্দুতে সেরে নেয়ার পর শেষমূহুর্তে জানা হলো- আরে এতো বাংলাদেশী। কিন্তু মুখের উর্দু বকবকানি শুনে বুঝার উপায় নেই, এই উর্দু নিয়ে আমাদের দুজনের দেশ ও জাতি কত রক্ত ও প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন নির্দিষ্ট জায়গায় জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন দেশের লোকজন একত্রিত হয়।
বাংলাদেশীরা যেখানে সমবেত হয়, আড্ডা দেয়, কুশল ও সংবাদ বিনিময় এবং নিজের প্রয়োজনীয় চিড়া মুড়ি কিনে নেয়, ঐ জায়গাটির নাম ন্যাশনাল। এনটিভির খবরে সেদিন দেখানো হল, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট এক লাখ পঁিচশ হাজার বাংলাদেশী এই কাতারে কর্র্মী ভিসায় এসেছেন। এদের অনেকেই শুক্রবার এলেই ন্যাশনালে জমায়েত হয়। পানের পিক আর কাশাকাশির থুতু কফ রাস্তায় আর দেয়ালে পড়ে থাকতে দেখে এটি যে বাংলাদেশীদের খামখেয়ালীপনার ভাংগাচোরা জনপদ, বুঝতে বাকী থাকে না কারোর।
২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে কাতার এখন দিবাস্বপ্ন দেখছে।
কিন্তু এ বিশ্বকাপের উম্মাদনা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে, এ নিয়ে কেউ ভাবছেনা।
তবে কাতার পুরো মধ্যপ্রাচ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কাতারের বর্তমান আমীর শেখ হামাদের ছেলে শেখ ফাহাদ বিন হামাদ নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন তাবলীগের জন্য। এ মহান কাজের গুরুত্ব ও দায়িত্ব উপলব্ধি করে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছেন যুবরাজ হওয়া থেকে, যাবতীয় ভোগ বিলাসিতা আর আমোদ ফূর্তির জগত থেকে।
তার একান্ত ইমাম মাওলানা আলী আহমদ বাংলাদেশের আলেম।
আমাকে তিনি স্নেহ করেন এব্ং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি তার কাছ থেকে শেখ ফাহাদ সম্পর্কে অনেক কিছূ জানতে পারি। ২০১০ সালেও তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে সাধারণ পাসপোর্ট ব্যবহার করে নিতান্ত সাধারণ বেশ ধরে তাবলীগের চিল্লা লাগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ, রাঙামটির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ, বগুড়াসহ কয়েক জেলায়।
বাংলাদেশ সরকার তো দূরের কথা, বাংলাদেশস্থ কাতার দূতাবাসও জানতো না যে তাদের মহামান্য আমীরের ছেলে যে বাংলাদেশের গাঁও গেরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাবলীগের ঝুলি নিয়ে। আরবী, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ ও জার্মানী- এ চারটি ভাষায় দক্ষ এই যুবরাজ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে দারুণ সতর্ক।
কাদাপানিতে হাঁটছেন, নিজের হাতে কাপড় ধুচ্ছেন, রিকশাওয়ালা ও কৃষকদের পাশে বসে দুআ শিখাচ্ছেন, কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই মসজিদে মসজিদে রাত যাপন করছেন, এসব দেখে কে বলবে যে, এই সাধারণ বেশের লোকটি বর্তমান পৃথিবীর তৃতীয় ধনী দেশের আমীরের ছেলে। অথচ নিজের দেশে আগে পিছে কতো নিরাপত্তার আয়োজন তার জন্য। কাতারের বর্তমান আমীর নিজের ছেলের এমন সাদাসিধে চালচলন ও ইসলামের জন্য তার মায়া ও ত্যাগ দেখে আনন্দিত। তিনি বলেছেন, এভাবে পরিচয় গোপন করে আল্লাহর জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারলে তুমি করে যাও। আর তাই কাতারের যে কোন মসজিদে উম্মুক্ত বয়ান ও জামাত থাকা খাওয়া এবং ইজতেমার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন তিনি।
যা অন্যান্য আরব দেশগুলোতে বিরল।
একবার সৌদীআরব কর্তৃপক্ষ এই আমীরকে বলেছিল, তোমার দেশে তাবলীগকে যেভাবে সুযোগ দিচ্ছ, তা বন্ধ কর, নইলে এরা হুমকী হয়ে উঠতে পারে। উত্তরে আমীর তাদেরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমি খুব ভালো করেই জানি, সারা পৃথিবীতে যত দল ও মত আছে, এর মধ্যে নিজের সবকিছু খরচ করে একমাত্র আল্লাহর জন্য শতভাগ নিবেদিত হয়ে দ্বীনের কাজ এরাই করছে। এ নিয়ে আমার মোটেও দুশ্চিন্তা নেই। এ বছর শেখ ফাহাদ যাবেন রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে মানুষ নিজেদের ইসলাম ও পরিচয় ভুলে বসে আছে অন্ধকারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।