আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাতারের ডায়রী (শেষ পর্ব)

কপিরাইট © সংরক্ষিত.. লিখিত অনুমতি ছাড়া প্রকাশ নিষেধ

৯. ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোজেক্টে কাতার আসা, বেশ কয়েকবার তাই এখানকার শিল্প এলাকায় যেতে হলো। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার প্রায় সব শিল্প-কারখানাই তেল-গ্যাস ভিত্তিক। পরিকল্পনা থাকলে কতটা দারুণভাবে সবশিল্পকে একসাথে ইন্টিগ্রেড করা যায়, সে ব্যাপারে কাতারকে আদর্শ ধরা যেতে পারে। দোহা থেকে প্রায় সত্তর-আশি কিলোমিটার দূরে উত্তরাঞ্চলে পুরো একটা শিল্প শহরই গড়ে তোলা হয়েছে, যার নাম ‘রাজ-লাফান ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি’। লিক্যুফায়েড নেচারাল গ্যাস, রিফাইনারি, গ্যাস-টু-লিক্যুইড, ফার্টিলাইজারসহ তেল-গ্যাস ভিত্তিক সব শিল্পই এখানে ঠাই পেয়েছে, শহর থেকে দূরে, সমুদ্রের তীরে আর খনিগুলোর কাছে হয় এমন একটা জায়গায়।

দোহা থেকে রাজ-লাফান যাবার পুরো রাস্তাটাই যেন মরুভূমির বুকে কালো সাপের মত শুয়ে থাকা হাইওয়ে। হাইওয়ের কিছুদূর পর পর রাডার সারভেলান্স সিস্টেম থাকলেও গাড়িগুলোর স্পিডোমিটারের কাটা প্রায়ই দেড়শো কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করে। নিশান পেট্রলে চড়ে বাইরের মরুভুমির আর কতটাই আঁচ করা যায়! তাই রূক্ষতার বদলে সৌন্দর্য্যটাই ধরা পড়লো বেশি। এখানকার মরুভুমি সমতল, একদম বালুকাময় না হয়ে মাটি একটু পাথুরে, রং একটু লালচে। চোখ মেললে দূরে বেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত দেখা যায়।

কিছুক্ষণ পর পর ধু-ধু মরুভুমির মাঝে এখানে ওখানে কিছুটা ঝাপ-ঝাড় আর হয়তো দুয়েকটা বাড়িঘর। আর ভাগ্য খুব ভাল থাকলে কয়েকটা ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো উটও দেখে ফেলতে পারেন। আর সবচেয়ে দারুণ লাগে রাতের বেলা; মরুর বুকে রাতের হাইওয়ে - এক কথায় অসাধারণ। রাজ-লাফান যাবার পথে পড়ে আরেকটা শহর, আল -খোর। এটা যদিও দোহার পর কাতারের অন্যতম একটা শহর, কিন্তু দেখে বাংলাদেশের সাধারণ যে কোনো উপজেলা শহরের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না।

আসলে সবাই এখন দোহামুখী। কারণটা খুব সহজ, দোহা কেন্দ্রিক আধুনিক কাতারের সবকিছুই এখন দোহায়। ১০. হাতে সময় খুব কম আর কাজ খুব বেশি থাকায় এবার আর দোহা কিংবা অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি হলো না। তবে বেশ কয়েকবার যাওয়া হলো কাতার ইউনিভার্সিটি,তাও কাজের ছুতোয়। এর অবস্থান দোহার উত্তর প্রান্তে।

আর্কিটেকচারাল ভিউটা সুন্দর। মিশরীয় এক ভদ্রলোকের ডিজাইনে জ্যামিতিক খাঁজে এমবেডেড আরবীয় ধাঁচের নকশা করা অনতিউচ্চ বিদ্যালয় ভবন- দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ভবন। মেয়েদের ভাগে কোনো পুরুষ শিক্ষার্থীর প্রবেশ একেবারে নিষেধ। মেয়েদেরও ছেলেদের অংশে আসা মানা।

শুধু শিক্ষকরা উভয় অংশে যেতে পারেন বাধা ছাড়াই। কাতারীরা দেরীতে হলেও ইদানীং বোধহয় শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের প্রায় দ্বিগুন দেখে অন্য আরব দেশের তুলনায় নারীশিক্ষার ব্যাপারেও কাতারকে একটু এগিয়ে থাকতে দেখা গেল। আসলে শিক্ষাব্যবস্থায় কাতার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পুরাতনের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত এখানেও উঠছে নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে কোনোটাই বাংলাদেশের মত ভুইফোঁড় কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। সবই হচ্ছে সরকারের 'কাতার ফাউন্ডেশন' নামক সংগঠনের পরিকল্পনায় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে। সম্পূর্ণ আলাদা কায়দায়, অন্য উদ্দেশ্যে। গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি এই ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে হচ্ছে তা হলো বিশ্বের সবচেয়ে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতার ক্যাম্পাস চালু করা। ইতিমধ্যেই এখানে আছে কার্নেগি মেলনের বিজনেস স্কুল, কর্ণেল ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত মেডিক্যাল স্কুল,জর্জটাউনের ফরেন সার্ভিস স্কুল, টেক্সাস এ এন্ড এম-এর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, ভার্জিনিয়া কমনওয়েল্থের স্কুল অব আর্টস।

এই দারুন সব স্কুলগুলোতে কেবল কাতারীরাই পড়তে পারবে, প্রয়োজনে স্কলারশীপসহ। বোঝাই যাচ্ছে,পেট্রোডলারের সদ্ব্যবহারও এরা করতে জানে। দেখছিলাম আর আফসোস হচ্ছিল। আমার দেশেও যদি এমনটা হতো! কত মেধাবী বাঙালী সন্তানের সুযোগ হতো দেশে থেকেই এই স্কুলগুলোতে পড়ার, কমে যেত ব্রেন ড্রেইন। দেশে থেকেই যদি বিশ্বের সবশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের জ্ঞান আহরণ সম্ভব হয় তাহলে আর লাগে কিছু? ১১. বর্ষা-বাদল-বৃক্ষ-বন-বসন্তে বোনা বঙ্গদেশের সন্তান বলেই হয়ত মরুভূমি আর লু হাওয়ার দেশ ততটা টানে না, তবু সব মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতিই হল কাতারে।

যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে দুইবারই গ্রীষ্মকাল হওয়ায় খুব বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠে নাই কাতার ভ্রমণ। এত বেশি হিউমিডির সাথেও এর আগে বোঝাপড়া ছিল না। কিন্তু তারপরও যখন ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসলো, একটু আফসোসের কাটা যে মনের মধ্যে খচখচ করলো না তা নয়। অনেককিছুই তো দেখা হলো না কাতারের। এখানকার প্রাচীন স্থাপত্য, সভ্যতার অবশেষ কিংবা জাদুঘর দেখা হলো না।

হলো না পাম ট্রি আইল্যান্ডে যাওয়া, যদিও মনে হলো ওখানে আর যাওয়া যায় না, কিছুই আর নেই সেখানে। আরবদের পারিবারিক জীবন কাছ থেকে দেখার শখ ছিল, এত অল্প সময়ে তা সম্ভব নয়। খুব ইচ্ছে ছিল এখানকার অতীত জীবনপ্রবাহ সম্পর্কে জানার, পারলে শহর ছেড়ে বেদুইনদের (যদি থাকে আদৌ) জীবন কাছ থেকে দেখার। হয়ে উঠে নাই। তবু বলতে হয়, ভালো একটা অভিজ্ঞতাই হলো।

শহরের দোতলা বক্স বাড়িগুলোর দেয়ালে দেয়ালে চৌকোণা সূক্ষ আরবীয় খাঁজ, ছোট করে ছাটা দাড়ির কাতারি পুরুষের শুভ্র আরব পোষাকে দুপ-দুরস্ত চলাফেরা, চেনা-অচেনা যেই হোক অসম্ভব আন্তরিকতায় সালাম-কুশলাদি বিনিময়, ছায়াহীন দোহার রাস্তায় খাসির শর্মা খাওয়া, গরম বাঁচিয়ে রাত বারোটার ফুটবল, সেলান(sea line)এ শয়তানের সাহস নিয়ে তরুণদের কার রেস এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ডুয়েল, কাতারি রুটি-মাংস-জয়তুন, এদের অনেককিছুই মনে থাকবে অনেকদিন। তাই যখন ফিরছিলাম, দশ দিনের পুরো প্যাকেট একটা ট্যুর শেষে, তখন মনে হলো দোহা শহরকে আপন করে নেবার অনেক উপকরণই বোধহয় মনে জমা হয়ে গেছে। (শেষ)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.