শাহরিয়ার কবির-- ( জনকনট---২১/০৫/২০১১ )-----
(গতকালের পর)
যে জোবরা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষদের স্যাম্পল হিসেবে ইউনূস পশ্চিমে ফেরি করেছেন, যাদের বদৌলতে তিনি খ্যাতি ও বিত্তের বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন, নোবেল বিজয় করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সেই গ্রামের মানুষদের ভাগ্য কতটুকু বদলেছে? এই গ্রামেরই এক তরুণ সাংবাদিক মুহাম্মদ সেলিম এবং 'বাংলাদেশ প্রতিদিনে'র অনিন্দ্য টিটো কিছুদিন আগে লিখেছেন, 'স্বপ্নগুলো এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে ফেরে ওদের। ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল হারিয়ে ওরা এখন যাযাবর। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের দেখতে পারছেন না চোখের দেখাটাও। ঋণ নিয়ে তারা আজ 'ফেরারি।
' সংখ্যায় এরা এক-দুজন নন, অনেক। ... কথা ছিল ঋণগ্রহীতারাও পাবেন লাভের অংশ। লাভ তো দূরের কথা, আজও কারও ভাগ্যে জোটেনি শেয়ার কেনার আসল টাকা। এভাবেই তাদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যবসা চালানো হয়েছে দিনের পর দিন। এখানেই শেষ নয়, 'সঞ্চয় প্রকল্পের' আয়ের টাকা দিয়ে ব্যাংকের তহবিল বাড়ানো হলেও যারা খেয়ে না খেয়ে সঞ্চয় করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই পাননি সঞ্চয়ের কানাকড়ি।
উল্লিখিত সব ঘটনাই গ্রামীণ ব্যাংককে ঘিরে।
'গ্রামীণ ব্যাংকের শুরম্নর দিকের সদস্য ফতেপুর গ্রামের ছকিনা খাতুন। স্বামী মারা পাওয়ার পর স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যাংকের জোবরা কেন্দ্র থেকে ঋণ নেন। ঋণের টাকা দিয়ে ছেলেকে কিনে দেন রিকশা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঋণের পরিধি।
বাড়তে থাকে সাপ্তাহিক কিস্তির পরিমাণ। ঋণ শোধ করতে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নেন। দাদনের টাকা শোধ করতে জড়িয়ে পড়েন আরও ঋণের বেড়াজালে। গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণ শোধ করতে না পারায় এক বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
'একই এলাকার আরেক সদস্য রহিমা খাতুন সাপ্তাহিক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে চার বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
পালিয়ে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠ পর্যায়ের কমর্ীরা তার ঘরের তালা ভেঙে হাঁড়ি-পাতিল থেকে সবকিছুই নিয়ে যান। শুধু ছকিনা আর রহিমা নন, একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে জুলেখা, হাসিনা, শানু বেগমসহ অনেকের।
'দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে ঋণগ্রহীতাদের শেয়ারের কয়েক শ' কোটি টাকা নয়-ছয় করে ব্যবসা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরম্নদ্ধে। ঋণগ্রহীতারাও লভ্যাংশ পাবেন, এমন কথা থাকলেও লাভ তো দূরের কথা, আজও কেউ ফেরত পাননি শেয়ার কেনার আসল টাকা। এভাবেই গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছে গ্রামীণ ব্যাংক।
ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নরওয়ের রাজধানী অসলোতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় উপস্থাপিত বক্তব্যে বলেছিলেন, 'ঋণগ্রহীতারা নিজের টাকা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। শেয়ার কিনে এখন সুফল ভোগ করছেন গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা। ' কিন্তু একাধিক ঋণগ্রহীতার সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে 'সুফল' পাওয়ার করুণ কাহিনী। ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরুর এক-দেড় বছর পর জোবরার প্রথম মহিলা কেন্দ্রে ঋণগ্রহীতা ছিলেন ৪০ জন। তখন ঋণগ্রহীতাদের গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার কেনার অফার দেওয়া হয়।
শেয়ার কী তা ঋণগ্রহীতারা বুঝতে পারেন না। মাঠকর্মী বুঝিয়ে বললেন, ১০০ টাকা দিয়ে শেয়ার কিনলে তারাও হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানার অংশ। শেয়ারের ওই টাকা দিয়ে ব্যাংক ব্যবসা করে যে লাভ করবে তারাও পাবেন এর অংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের এই প্রলোভনে জোবরা কেন্দ্রের প্রত্যেক সদস্যই কিনে নিলেন শেয়ার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ ২৮ বছর পরও কেউ পাননি শেয়ারের আসল বা লাভের কানাকড়ি।
এমনই এক গ্রাহক লায়লা খাতুন বললেন, 'অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে শেয়ার কিনতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠকর্মী ও কর্মকর্তারা। দেখিয়েছিলেন ভাগ্য বদলের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। ভাগ্য বদল হয়েছে ঠিকই। তবে আমাদের না ব্যাংকের। ' (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ মার্চ ২০১১)
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকে সুফিয়া, লায়লা, রহিমাদের শেয়ার (অনত্মত কাগজে কলমে) রয়েছে ঠিকই, সরকারেরও শেয়ার রয়েছে।
সরকারী কৃষি ব্যাংকের টাকায় গ্রামীণের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে আরম্ভ হয়েছে এরশাদের জমানায়, ২৮ বছর আগে। শতকরা ৬০% শেয়ার ছিল সরকারের, বাকি শেয়ার গরিব ঋণগ্রহীতা সুফিয়াদের। বিদেশ থেকে যে অর্থ এসেছে সেখানেও চুক্তি হয়েছে সরকারের সঙ্গে কিংবা গ্যারান্টার হতে হয়েছে সরকারকে। গ্রামীণ ব্যাংকে ইউনূসকে এমডি হিসেবে নিযুক্তি দিয়েছে সরকার। এই ব্যাংকে ইউনূস ১টি শেয়ারেরও মালিক নন, কারণ বিধি অনুযায়ী বেতনভুক কর্মচারি বা কর্মকর্তারা ব্যাংকের শেয়ার কিনতে পারেন না।
অথচ ইউনূস এখন দাবি করছেন এতে নাকি সরকারের মালিকানা নেই।
আমাদের প্রশ্ন তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অর্থ কে জুগিয়েছে? ইউনূস জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করলেও নিশ্চয়ই তিনি জিনভূতে বিশ্বাস করেন না। ইউনূসীয় জাদু একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানকে রাতারাতি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছে।
দশ.
টম হেইনেমানের প্রামাণ্যচিত্র 'মাইক্রোডেট'-এ গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূসের দারিদ্র্যবাণিজ্যের অত্যনত্ম ক্ষুদ্র একটি অংশ বিধৃত হয়েছে। এতেই দেশে ও বিদেশে গণমাধ্যমে ইউনূসের পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচুর প্রতিক্রিয়া যাকে বলে 'চায়ের পেয়ালায় ঝড়' আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
জরিপ করলে দেখা যাবে ইউনূসের পক্ষেই বলা হয়েছে বেশি। গ্রামীণ সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট ড. ইউনূসের গণসংযোগ পদ্ধতি কত দক্ষ ও শক্তিশালী এ বিষয়ে আগে আলোচনা করেছি। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, বাংলাদেশে গরিবদের পক্ষে লেখার মতো মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, গরিবদের পক্ষে লেখা ছাপার মতো পত্রিকার সংখ্যা আরও কমেছে।
পশ্চিমে ইউনূসদের সহায় ও ভরসা হিসেবে হিলারিরা যেমন আছেন তেমনি তাদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য টম হেইনেমান ও মাইকেল মুররা আছেন। বলা বাহুল্য সেখানেও শক্তিশালী হচ্ছেন হিলারিরা, তাবত মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ও আনত্মর্জাতিক বাণিজ্যিক পুঁজির পাহারাদাররা।
মাইকেল মুরের সামপ্রতিক ছবি 'ক্যাপিট্যালিজম : এ লাভ স্টোরি' ওয়াল স্ট্রিটসহ পশ্চিমের পুঁজিবাজারে যেমন সমালোচনার সুনামি সৃষ্ট করেছে তেমনি টম হেইনেমানের 'মাইক্রোডেট' ড. ইউনূসের গ্রামীণ সাম্রাজ্যের ওপর দিয়ে সাইক্লোনের মতো বয়ে গেছে। গত বছর (২০১০) নবেম্বরে এ ছবি নরওয়েতে মুক্তিলাভের পর বাংলাদেশে ও পশ্চিমে এ নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা-সমালোচনা আরম্ভ হয়েছে ইউনূসের গ্রামীণ সাম্রাজ্যের প্রচার বিভাগ এর পাল্টা আরেকটি ছবি বানিয়েছে। গেইল ফেরারো পরিচালিত 'টু-ক্যাচ এ এ ডলার' ছবিটি আমেরিকায় মুক্তি পেয়েছে এ বছর মার্চে, টমের ছবি মুক্তি পাওয়ার চার মাসের ভেতর। এ ছবির মূল বিষয় হচ্ছে টম যাকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ঋণগ্রহীতা সুফিয়া বেগমের মেয়ে নূরননাহার বলে সাক্ষাতকার নিয়েছেন, সে সুফিয়া বেগমের মেয়ে নয়। ইউনূসের সুফিয়া এখনও বেঁচে আছেন।
টম নাকি সুফিয়াকে নিয়ে মিথ্যে কাহিনী ফেঁদেছেন। এ থেকে বোঝা যায় গ্রামীণ সাম্রাজ্যের প্রচার বিভাগ কতটা শক্তিশালী।
টমের ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ওয়াশিংটন থেকে গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইও অ্যালেঙ্ কাউন্টস অত্যন্ত কড়া ভাষায় চিত্রপরিচালক টমকে একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছেন। এ্যালেঙ্রে মতো টম তার ছবিতে ইউনূসকে হেয় করার জন্য প্রচুর মিথ্যে কথা বলেছেন। ইউনূসের প্রথম ঋণগ্রহীতা হিসেবে যে সুফিয়া বেগমের কথা টমের ছবিতে বলা হয়েছে ঋণ শোধ করতে না পেরে যে খেতে না পেয়ে বিনা চিকিৎসায়, মারা গেছেন এ তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা।
জোবরা গ্রামের সুফিয়া মারা যাননি, অভাবেও পড়েননি। তিনি খুবই ভাল অবস্থায় আছেন, ঋণ নিয়ে অবস্থা পাল্টে ফেলেছেন। আলেঙ্ তার প্রতিবাদপত্রে ফেরারোর 'টু ক্যাচ ও ডলার' ছবির উলেস্নখ করে বলেছেন, এতে টমের ভাষ্য মিথ্যা প্রমাণ করে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা হয়েছে। (ক্রমশ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।