আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহমত বলেই ফেইসবুক থেকে লেখাটিকে এখানে আনা....

তৃতীয় মাত্রায় শহীদ পরিবার ও আমার যত কথা আহমাদ মাবরুর আমি প্রথমেই বলে নেই যে, এই লেখাটিতে আমি গত ৬ এপ্রিল ২০১১ দিবাগত রাতে এবং ৭ এপ্রিল সকালে প্রচারিত তৃতীয় মাত্রার একটি বিশেষ এপিসোড নিয়ে আমার বক্তব্য তুলে ধরবো। শুরুতেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, উপস্থাপক এবং এই প্রোগ্রামটির পেছনের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই, কেননা, তারা মুক্তিযুদ্ধের ৪ শহীদ পরিবারের জীবিত সদস্য এবং গত ৪০ বছর ধরে চলতে থাকা তাদের নির্মম এবং করুন বাস্তবতাকে খুবই সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। নতুন প্রজন্ম তাদের এই বক্তব্যগুলো থেকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পারবেন এবং গৌরবজ্জ্বল সেই ইতিহাস নতুন ভাবে উপলব্ধি করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমি আসলে অন্য কিছু কথা বলবো বলেই লিখছি। অন্য না বলে বরং ভিন্ন বলাই ভাল।

আমি অনেকগুলো বিষয়ে তাদের উপস্থাপনার সাথে দ্বিমত করবো। আমার লেখনীর মূল উদ্দেশ্য হলো, তাদের কথাগুলোকে আরো যৌক্তিক ও মানবিক করা কিংবা বলা যায়, নিরেট আবেগের বাইরে এনে গোটা বিষয়টির একটি গ্রহনযোগ্য উপস্থাপনাই আমার লক্ষ্য। তাদের সাথে দ্বিমতের সুযোগে কেউ যেন আমায় ভূল না বোঝেন, এইটা আমার একটা চাওয়া ও দাবী। আশা করি, কেউ আমায় অবমূল্যায়ন করবেন না। আমার প্রথম কথা হলো, সাধারনভাবে যে কোন বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে আমাদের জড়তা কাজ করে।

সেটা কোন বিল্ডিং ভাংগার ইস্যু হউক, কোন হত্যা মামলা হউক অথবা নদী ভরাট ইস্যু। আমরা এই ব্যপারগুলো নিয়ে টক শোতে কথা বলতে চাই না, কারন বিষয়টা সাবজুডিস বা বিচারাধীন। সাম্প্রতিক কালে কোর্টের রায় নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালতে বেশ নাস্তানাবুদ হলেন। অথচ আমাদের মন্ত্রীরা, সাংবাদিকেরা, কিংবা টক শোর অতিথিরা যেভাবে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আগাম মন্তব্য করেন, বা বিচারটা দ্রুত শেষ করতে বলেন, তাতে সাব জুডিস বিষয়টি যেমন লংঘিত হয়, ঠিক তেমনি এই বিচারের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রমানীত হওয়ার আশংকা তৈরী হয়। বিচারটিকে গ্রহনযোগ্য করতে এই ধরনের মন্তব্য কাম্য নয়।

তৃতীয় মাত্রার এই এপিসোডের অতিথিরাও একই সুরে কথা বলেছেন। তাদের আবেগকে আমি সন্মান করি। কিন্তু এত বছর পরে শুরু হওয়া এই বিচার যেন আমাদের আবেগের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, এটাও মাথায় রাখা দরকার। আমি তৃতীয় মাত্রার এই বিশেষ আয়োজনের সন্মানীত অতিথিদের অনেক বেশী শ্রদ্ধা করি এবং সে কারনেই তাদের পার হয়ে আসা কঠিন সময়টাকে আন্তরিকভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের ব্যপারে তাদের আক্রোশ থাকাটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তারপরও কিছু বিষয়, বা বিশেষ কিছু শব্দ তারা ব্যবহার করেছেন, যা তারা না করলেও পারতেন বলে আমি মনে করি। অনুষ্ঠানের এক জায়গায়, খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী শিবলী মুহাম্মদ বলে উঠলেন, আটক অভিযুক্তদের বিচারের দরকারটা কি? এত লোককে ক্রসফায়ার করা হয়, এদের সেভাবে মেরে ফেললেই তো হয়। তিনি আরো বললেন, পত্রিকায় প্রায়ই দেখি, বন্দী অভিযুক্তদের এই জেল থেকে সেই জেলে স্থানান্তর করা হয়। কোন একটি জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের পথিমধ্যে মেরে ফেলা হয় না কেন? আবেগের কারনে হউক আর যে কারনেই হউক না কেন, আমি এ ধরনের কোন আগ্রাসী মন্তব্য এই মুহুর্তে সমর্থন করতে পারি না। কারন লক্ষ্য করুন, বাস্তবতা কি বলে।

নিজামী-মুজাহিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যখন ট্রাইবুনালের কাছে অনুমতি চাওয়া হলো এবং ট্রাইবুনালকে যখন অবগত করা হলো যে, এই জিজ্ঞাসাবাদের কাজের জন্য ধানমন্ডিতে একটি বাড়ী সেফ হোম হিসেবে ঠিক করা হয়েছে। ট্রাইবুনাল ঐ জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন মঞ্জুর করলেও বাড়ীটিকে জিজ্ঞাসাবাদের স্থান হিসেবে মন্জুর করেনি নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়েই। সেখানে ট্রাইবুনালে আনা নেওয়ার পথে বা অন্য কোন সময়ে যদি অভিযুক্তদের উপর কোন হামলা বা সমস্যা হয়, তখন কিন্তু এই ধরনের মন্তব্যের কারনেই শিবলী মুহাম্মদের মতো কারো কারো দিকে দায়ভার চাপানোর সুযোগ থাকে। তাই এই ধরনের আবেগপূর্ন মন্তব্য পরিহার করা জরুরী। একটি বিষয় অতিথিদের বনর্ণার মাঝেই খুব অসংগতিপূর্ন মনে হয়েছে আমার কাছে।

ঐদিন যতগুলো অতিথি হাজির ছিলেন, তারা তাদের পিতা-মাতা, বা আপনজনদের হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরিভাবে বিহারীদের দায়ী করেছেন। এই ক্ষেত্রে শিবলী ও সাইদুর রহমান যে হত্যার যে লোমহর্ষক বিবরন দিয়েছেন, তাও সরাসরি বিহারীদেরকে অভিযুক্ত করেই। যদিও আমরা সকলেই জানি, যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরই বাঙ্গালী ছাত্রদের বা বাঙ্গালী প্রতিবেশীদের সহযোগিতায়। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের অতিথিরা এরকম দাবী করেন নি। কিন্তু শেষ দিকে এসে যখন তারা সবাই একই সুরে নিজামী-মুজাহিদের বিচার দাবী করেছে, তা একটু বেমানান লেগেছে আমার কাছে।

কারন হত্যার বিবরনে যাদের নাম তারা বলেন নি, তাদের বিচারের প্রসংগটা তারা ওভাবে টেনে না আনলেও পারতেন বলে মনে হয়েছে আমার। সে তুলনায়, তারা অনেক বেশী শক্ত করে সরকারের কাছে বিহারীদের ব্যপারে শাস্তি দাবী করলেই সেটা অনেক বেশী প্রাসংগিক হতো বলে আমি মনে করি। আমাদের পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করে, তা নিয়েও আমার কথা আছে। আমরা সব সময় যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে কোন তথ্য উপস্থাপন করতে চাইলেই, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যাকান্ড, ধর্ষনের চিত্র, নারী-পুরুষ ও শিশুদের পালানোর দৃশ্য দেখাই। আর এই গোটা চিত্রায়নের উপর দিয়ে জামায়াতের বর্তমান নেতা বা আটক ৫ জন + গোলাম আজমের ছবি দেখাই।

মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক সব টক শোতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অন্যায় তুলে ধরি, আর তার জন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দের বিচার দাবী করি। আমার কাছে বিষয়টা খুব বিষ্ময়কর লাগে। আমাদের এই অবস্থান কতটা যৌক্তিক? এই ৫ জন ব্যক্তি কি ৩০ লাখ মানুষকে মেরেছে? এই ৫ জন ব্যক্তি কি ২ লাখ নারী ধর্ষন করেছে? সারা বাংলাদেশে আরো যত অপরাধ হয়েছে, সবই কি করেছে এই ৫ জন? প্রচারনা দেখে মনে হতে পারে যে, আমরা যুদ্ধ করেছি জামায়াতের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, আর তাই সব অপরাধের দায় এখন জামায়াতের। এ ব্যপারে নতুন প্রজন্মের একজন হিসেবে আমি সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করছি, যাতে তারা বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবেন। অনুষ্ঠানে শাওন মাহমুদ যখন তার পিতার সুর করা গানের (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো) বিকৃতি নিয়ে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করলো, তখন অন্য সব অতিথিরা তাকে সান্তনা দিল এই বলে, এই গানটি এখন মানুষের মনে গেথে গিয়েছে, তাই এটার সুরের কোন রূপ বিকৃতি আর সম্ভব নয়।

আবার অতিথিরা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসংগ নিয়ে বলতে গিয়ে বললো, এই বিচার যদি এই সরকার এই মেয়াদে শেষ করতে না পারে, তাহলে বর্তমানে অভিযুক্ত আটক ব্যক্তিরা বের হয়ে এসে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার করবে, মুক্তিযুদ্ধের সব ইতিহাস পাল্টে দেবে, সত্যের বিকৃতি ঘটাবে। অন্য কেউ অনুষ্ঠানে এই কথাটির প্রতিবাদ করলো না। আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তাদের এই আশংকার তীব্র প্রতিবাদ করছি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমি বলতে চাই, একটি গানের সুরের বিকৃতি যদি এদেশের মানুষ প্রতিহত করতে পারে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতিও এ জাতি ঠেকাতে পারবে। এ্ জাতিকে এত বোকা ভাবার কোন কারন নেই।

তৃতীয় মাত্রার এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে আমি আরো কিছু বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করতে চাই। সবচেয়ে বড় অভিযুক্ত যে গোলাম আজম, উচ্চ আদালতেও কিন্তু তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমান করা যায় নি। আমাদের যত কথা, তার যেন একটা আইনী ভিত্তি থাকে, তা লক্ষ্য রাখা দরকার। তাছাড়া, অভিযোগ উত্থাপনের পাশাপাশি আমরা নির্ভরযোগ্য প্রমানাদি সংগ্রহ করতে পারছি কিনা, তাও সতর্কতার সাথে খেয়াল করা দরকার। আমরা নিজামী-মুজাহিদ-সাইদীকে টিভিতে, টক শোতে যতই যুদ্ধাপরাধী বলে গালি দেই না কেন, বাস্তবতা হলো, দীর্ঘ ৯ মাসে তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইবুনাল প্রসিকিউটরেরা একটি সুনিদির্ষ্ট অভিযোগও দাড় করাতে পারে নি।

যদি অভিযোগ আনেও কখনো, তা আদৌ টিকবে কিনা, সে আস্থাও রাখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ভয়ের কথা, ইতিমধ্যে মন্ত্রী সহ বিভিন্ন মহলের অতি মাত্রায় আবেগের ও অতিরঞ্জিত মন্তব্যের কারনে গোটা যুদ্ধাপরাধের বিচারটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, এরকম একটি ধারনা মানুষের মধ্যে তৈরী হয়ে যাচ্ছে। এই ৫ বছরে বিচার শেষ না করতে পারলে, পরবর্তী সরকার এই বিচার করবেনা, এই আশংকা কেন করা হচ্ছে? তাহলে এই বিচার করা কেবল কি এই সরকারের দায়? নাকি এটা বর্তমান সরকারের বিরোধী পক্ষের বিচার বলেই এই ভয়গুলো মানুষের মধ্যে কাজ করছে? আমার মনে হয়, আমাদের সকলের এই প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর ভাবে ভাবা দরকার। মাবরুরের উদ্দেশে বলছি: আমার বাড়ি ফরিদপুর: কথিত যুদ্ধাপরাধী আরী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এমন কিছু তথ্য আমি জানি (লোকমুখে শোনা) যা শুনলে কথিত ক্রসফায়ারে মারতে চাওয়া নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদও একটু কুণ্ঠিত হবেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এক জিনিস আর ব্যক্তিগত অপরাধ আরেক জিনিস।

রাজনীতিতে ভুল বা মতবিরোধ থাকতেই পারে তার জন্য কোনও ব্যক্তিগত ক্রোধ মনে পুষে রাখা ঠিক না। ....বিগত ৪০ বছরে আমরা কথিত যুদ্ধাপরাধীদের কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নজির পাইনি, এতেই কি প্রমাণ হয় না অপরাধটি আরোপিত, রাজনৈতিক হয়রানী? আর যারা এখন্ও জঘন্য অস্ত্রবাজী খুন ধর্ষণ করে যাচ্ছেন সেসব দিয়ে সিডি বের করছেন তাদের শাস্তি কেন হবে না? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.