গত সপ্তাখানেক ধরে মাথাটা একদম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, রাজ্যের চিন্তায়। এমনিতে আমার মাথায় চুল পরাজিত সৈনিকের মত পিছু হটেছে। চকচকে ভাবটা ঢাকবার জন্যে গুটিকয় যা অবশিষ্ট আছে, মেজাজ খারাপের চোটে তাও ছিঁড়ে ফেলবার যোগার। এই মুহূর্তে রাগ প্রশমিত হয়েছে সচলে সাক্ষী সত্যানন্দের দিনপঞ্জিকা খানা আর তাতে চ উ'র খাসা মন্তব্যটি পড়ে। কেউ যখন একটি বিষয় নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নিজেকে বড্ড অসহায় বোধ করতে থাকে আর তখন যদি অন্য কারো মানসিকতায় নিজের চিন্তাধারার প্রতিবিম্ব দেখতে পায়, এ কি পথহারা মুসাফিরের সরাইখানার সন্ধান পাওয়া নয়? খুলে বলি-
অনেকেই বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে যার বাবা মারা গেছে কিংবা আপন বোন ধর্ষিতা হয়েছে তারাই স্বজন হারানোর বা সম্ভ্রম হারানোর মর্ম বোঝে।
সারা দেশ রাজাকারদের আর পাকিস্তানীদের ক্ষমা করলেও ঐ মানুষটি কখনই তা করবে না। অনেকের এই বহুব্যাক্ত কথাটায় আমার ঘোর আপত্তি আছে। এবার ছোট্ট একটি কনফেশন- সরকারী চাকরীর সুবাদে ৬৯ সাল থেকে আমার বাবা মা ভাই বোন এবোটাবাদে থাকতো। মুক্তিযুদ্ধের পর ৭২ এ তারা দেশে ফিরে আসে। আমার চাচারা তখন থাকতেন জার্মানে, ফুপুরা লন্ডনে, খালা, মামা ১৪ গুষ্টির মধ্যে একমাত্র আমার বড় মামা ছাড়া আর কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি বা দেশে না থাকবার কারণে সে সুযোগ পায়নি।
বড় মামা যুদ্ধে আহতও হয়নি। মোদ্দা কথা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার, আত্মীয় স্বজন কেউ কিছুই হারায়নি। তাই বলে কি আমি রাজাকারদের ঘৃণা করবো না? পাকিদের গালি দেবো না? আমার বিশ্বাস সচলে সচল হাচল অতিথি মিলে ঝিলে যেকজন কলম যুদ্ধে নেমেছে তাদের বেশীর ভাগেরই আমার মত অবস্থা; নিজ পরিবারের কোনো ক্ষতি না হলেও ত্রিশ লক্ষ্য প্রাণকে তারা নিজ রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় জ্ঞান করে, দুই লক্ষ্য নারীকে সহোদরা মনে করে। আমাদের এই উপলব্ধির পেছনে আছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান আর পারিবারিক সত্য চর্চা। আমার মা বাবা বড় ভাই বোনকে সর্বদা দেখেছি রাজাকারদের কুকুর সম ঘৃণা করতে।
তা দেখে দেখেই আমার বেড়ে উঠা। গত ফেব্রুয়ারির শাহবাগ আন্দোলনের শুরু থেকেই ফেসবুকে, সচলে টুকটাক লিখছি, অন্যদের লেখা শেয়ার করছি। এই কয়েক মাসে সে কারণে অনেক কাছের বন্ধুকে হারিয়েছি, আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে উপহাস শুনেছি। তবু হাল ছাড়িনি। তবে সার্বিক দিক বিচার করে যা দেখলাম তাতে ফলাফল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
আমার লেখা, আমার চিন্তাধারা শুধুমাত্র অনলাইনে আবেগ ঘন কিছু ফন্ট; সে ফন্ট সঞ্চারিত হয়নি ধানের ক্ষেতে, নদীর ঘাটে, সে ফন্ট চৈত্রের সোনা রোদের মত ছড়িয়ে পড়েনি অগণিত মানুষের মিছিলে মিছিলে। যারা অনলাইনে লিখি আর যারা পড়ি, আমার ও আমাদের ফন্ট শুধুমাত্র সেই অনলাইন ব্যাবহারকারীদেরই হাসি কান্নার খোঁড়াক হবে সে উদ্দেশ্য কাউরো ছিল না। শুধু পড়েই আমরা ক্ষান্ত হয়নি, ভাল একটি গঠনমূলক লেখা নিয়ে আমরা অফলাইনে বন্ধুদের আড্ডায়, আত্মীয় বাড়ীর নেমতন্নে আলাপ করেছি। চ উ'র ত্যানা প্যাঁচানো, বাতের বালা, লছাগু গছাগু আলাপ করতে করতে প্রায় মুখস্তই হয়ে গেছে। লাভের লাভ বিচাকলা।
শুনার সময় হাসতে হাসতে একেকজন গড়িয়ে পড়ে, অথচ দিন কয়েক বাদে দেখা হতেই বলে বসে- মুসুল্লিগুলিরে কানে ধরাইয়া এম্নে বেজ্জতি না করলেই পারতো। দিন যায়, দিন ও দিনের সমষ্টিতে সপ্তা এমনকি মাসও যেতে থাকে আর সেই অনুপাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমতে থাকে আমার বন্ধু সংখ্যা এবং সাপ্তাহিক নেমন্তন্ন। তাতে বিচলিত হয়নি। কিন্তু সপ্তা খানেক ধরে যেন বড্ড হাপিয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে আমাদের এই লেখনী যুদ্ধের ফলপ্রসূ কোনো দিক নেই।
আমাদের মিশে যেতে হবে ধানের ক্ষেতে, নদীর ঘাটে, মানুষের মিছিলে মিছিলে; তবেই সঞ্চারিত হবে চেতনা। আমরা পাঁচ কি দশ পারসেন্ট লোকে চাইলে রাজাকারের বিচার হবে না। গঠন করতে হবে জনমত; সে লক্ষেই অনলাইন যোদ্ধারা কাজ করে যাচ্ছে, আর তার প্রভাব কিছুটা হলেও জনমনে পড়ছে। কিন্তু আমার ঘর, আমার বন্ধুমহল, আমার আত্মীয় স্বজন সবাইকে কি একমতে আনতে পেরেছি? অন্তত আমি পারিনি। লিখবার সাথে সাথে আমাদের বাস্তব জীবনে সত্যের চর্চাটা বজায় রাখাও অত্যন্ত জরুরী।
তবেইতো তৈরি হবে একটি পরিবেশ, একটি পরিমণ্ডল।
এই প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনার উল্লেখ করি… (তথ্যসূত্রঃ ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’- যতীন সরকার; অংশটুকু হুবুহু লেখকের ভাষাতেই উল্লেখ করলাম)
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের আরেক অগ্রজপ্রতিম বন্ধু নাইব উদ্দিন আহমেদ। তিনি অধ্যাপক নন, আলোকচিত্র শিল্পী। আলোকচিত্র শিল্পে তার খ্যাতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত। স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে এসে তার মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম।
সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী হিসাবে বিভিন্ন স্থানে তাকে আলোকচিত্র তুলতে যেতে হয়েছে। এই সুত্রে তাকে পাকহানাদার বাহিনীর অফিসারদের সংস্পর্শেও আসতে হয়েছে। ওদের ক্যামেরা মেরামত করে দেয়ার ছলে ওদের অপকীর্তির অনেক ছবি ওদের ক্যামেরার ভেতর থেকে বের করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। ওগুলোই পরে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবান দলিল হয়ে গেছে।
ক্যামেরার খুঁটিনাটি বুঝে নেয়ার জন্যেই পাঞ্জাবি মেজর কাইয়ুম আসতো নাইব উদ্দিন সাহেবের বাসায়।
নাইব উদ্দিনের ছেলে নিপুণের বয়স তখন মাত্র পাঁচ। মেজর তার পিস্তলটি টেবিলের উপর রেখে গল্প করছিলো। বালক নিপুণের কৌতূহল ওই পিস্তলটির প্রতি। সে সেটি নিতে চায়। মেজর নিপুণকে আদর করে কাছে টেনে নেয়।
জিজ্ঞেস করে, ‘এই পিস্তল নিয়ে তুমি কি করবে?’ নিপুণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘একটা পাঞ্জাবি মারুম। ’ মেজরের মুখ অন্ধকার। আর সস্ত্রীক নাইব উদ্দিন সাহেব ভয়ে একেবারে কাঠ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।