এবার ফিরাও মোরে; লয়ে যাও... হোসেন শহীদ
‘জাদু দেখবা। জাদু। এুনি শুর“ করব। তোমরা কেউ চেঁচাবা না। একটু ধৈর্য্য ধরে দেখÑতোমরাও এই জাদুটা শিখতে পারবা।
...জাদু দেখবা। জাদু। এুনি শুর“ করব। তোমরা কেউ চেঁচাবা না। একটু ধৈর্য্য ধরে দেখÑতোমরাও এই জাদুটা শিখতে পারবা।
...জাদু দেখবা। জাদু। এুনি শুর“ করব। তোমরা কেউ চেঁচাবা না। ...’ Ñস্কুল মাঠের পশ্চিম দিকটা ফাঁকা, তাই ওখান থেকেই হাঁটা শুর“ একরামুলের।
চক্রাকারে খেলার মাঠটা ঘুরে যখন পূবদিকের জটলার [যেখানে ৮০/৯০টা ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু ওদের মধ্যে পিনপতন নীরবতাÑওরা ছোট ওয়ান, মেজো ওয়ান, বড় ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর ও ফাইভের ছাত্র-ছাত্রী] কাছাকাছি আসতে থাকে তখন একরামুল আবার বলতে শুর“ করেÑ‘জাদু দেখবা। জাদু। এুনি শুর“ করব। ...। ’ জটলার যত কাছাকাছি আসে গলা আগের চেয়ে নিচু করতে থাকে; কেননা শ্রোতা-দর্শকদের সঙ্গে তার দূরত্ব কমে।
তবে এক সময় ওই জটলা পের“লে আবার দূরত্ব বাড়তে থাকে। তখন আবার বেশ জোরে বলেÑ‘ জাদু দেখবা। জাদু। ...। ’ তবে খুব বেশি দূরত্ব যখন হয় তখন মুখ বন্ধ।
হাঁটা থামায় না। আবার জটলা যখন তার কাছাকাছি চলে আসে; তখন বলতে শুর“ করেÑ ‘জাদু দেখবা। জাদু। ...’ এভাবেই চলছিল অনেকণ। স্কুলের ছেলেমেয়েরা তখনও ধৈর্য্যহারা হয়নি, হা-হয়ে তার কথা শুনছিল।
এবার কাছাকাছি হলেই জাদুটা দেখাবে এমন সিদ্ধাš— নিয়ে হাঁটছিল একরামুল। আহামরি তেমন কিছু নাÑদুই হাতের বুড়ো আঙ্গুলের আগা দুই কাধে [ডান হাতের আঙুলে ডান কাঁধ, বাঁ হাতের আঙুলে বাঁ কাঁধ) স্পর্শ করে সামনের দিকে মধ্যমা দুটি একে-অপরকে স্পর্শের পর যে বৃত্ত তৈরি হয়, সেটার মাঝদিয়ে মাথা এপার-ওপার করা [তবে বুড়ো আঙুল যেমন কাঁধের স্পর্শ ছাড়তে পারবে না, তেমনি মধ্যমারাও একে-অপরের শীর্ষদেশ ছুঁয়ে থাকবে]। ক্রমেই জটলার কাছাকাছি চলে আসছে, গলার ¯^রও নিচু থেকে নিচুতে নামাচ্ছে। আর দু-পা হেঁটেই জাদুটা শুর“ করবে এমনটাও ভেবে ফেলেছে, ঠিক তখনই কেলা ফতে। সুন্দর একটা আবহ মাঠে মারা গেল! জাদু দেখানোর পরেও যেটা হতে পারত! ঘুম ভেঙ্গে গেল!
টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠান দেখেছে একরামুল।
পড়েছে খবরের কাগজে। কিন্তু ¯^প্নটার মতো লাইভ যেন আর কিছুই তার চোখে ভাসছে না। অফিসে গিয়ে রিপোর্টার শারমিন মনিকে ¯^প্নটার কথা বলেÑওই রকম লাইভ করে নিউজ লেখার বিষয়ে একপ্রস্থ পরামর্শ দেয়। এরপর হঠাৎ করেই তার মনে হয়Ñছোটবেলায় কেউ একজন তাকে এমন একটা বা¯—ব গল্প শুনিয়েছিল; যা শুনে মনে হয়েছিলÑচোখের সামনে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে; নিজেই দৌড়াচ্ছে, পেছনে পাক আর্মির বুটের শব্দ...।
‘‘মধ্য ৭১-এর কোনো একদিন।
সেটা সকাল নয়Ñবিকেলের কাছাকাছি। এলাকাটাই তখনো ইট-সুরকির সড়ক হয়নি; দু-ক্রোশ দূরে ভেড়ামারা থানা শহর। ঘটনাটা ওখানে ঘটলেও অজগাঁ আদাবাড়িয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ক’দিন ধরেই একটা কথা মোড়ের দোকানে, বাড়িতে খাবার পিড়িতে, এমনকি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও ঘুরছেÑপাকবাহিনী যে কোনো সময় এই এলাকায় আক্রমণ করতে পারে। এর অন্যতম কারণÑএখান থেকে পশ্চিমে ২/৩ ক্রোশ দূরেই ভারতীয় সীমানা।
পাকবাহিনীর ধারণা ওখান দিয়েই মুক্তিফৌজ ভারতে ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে ঢুকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছে। অন্যদিনের মতো সেদিনও কৃষক মাঠে গেছে, বউ-ঝিরা দুপুরের রান্না করেছে। কেউ খেয়েছে, আবার কারো তখনও খাওয়া হয়নি, দুপুর মাত্র গড়িয়ে পশ্চিমে রওনা দিয়েছে। স্কুল ছুটির পর হলা করে ফিরছে একদল ছেলেমেয়ে। রা¯—ায় ধুলো উড়ছে।
তবুও গুমোট একটা আবহাওয়া। হঠাৎ করেই সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছে এক চিলতে কালো মেঘ। এরই মধ্যে খবরটা কে প্রথম আনে, তা জানা গেল না। তবে চারদিকে চাউর হলোÑহানাদাররা আদাবাড়িয়ায় আসছে...। আসছে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক...।
আদাবাড়িয়া থেকে বেশ দূরে শেহালা-বামুন্দীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আছে। কিন্তু খবর নিয়ে যাবে কে? Ñতার আগেই চারদিকে গুঞ্জন উঠলÑহানাদাররা ভেড়ামারা ছাড়িয়ে আলারদর্গায়; আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আদাবাড়িয়া পৌঁছবে। এরপর মাঠের গর“ বাড়ি ফিরতে পারলেও গোয়ালে বাধা হল না, চুলোয় রান্না পুড়ে গন্ধ ছড়ালেও সেদিকে তাকিয়ে পলক ফেলার মুহূর্ত নাই, খাবার পেটের অর্ধেক ভাত-তরকারি মাখামাখি পড়ে থাকল। ছেলেমেয়ে-বউ-ঝি, বুড়ো-বুড়ি সঙ্গে নিয়ে কে কোথায় যাবে; বাড়ি পাহারা দেবে কে? Ñএসব বিষয়ের সমাধান যেন নিমেষেই হয়ে গেল। তারপরও বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালানো বললেই তো পালানো নয়Ñঅš—ত ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেলÑগ্রামের অধিকাংশ মানুষ তখনও পালানোর প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি।
হঠাৎ দূরে কোথাও গুলির শব্দ, এমনকি অসহায় মানুষের আর্তনাদও ভেসে এল! ব্যস্ ব্য¯—তা এত বেশি বেড়ে গেল যে সময় থমকে দাঁড়াল! কোনো প্রস্তুতি ছিল না; তারপরও বাবা বললেন, ‘তোর মাকে নিয়ে পালা। আমি বাড়িতেই থাকব। ’ অনেকটা জোর করেই বের করে দিলেন মার সঙ্গে আমাকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখিÑগ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে রা¯—ায়। দৌড়াচ্ছে সবাই...।
তখন আমার বয়স ২৩ কি ২৪ হবে। মা শক্ত-সামর্থ হলেও তাল মেলাতে পারছিল না। একটু একটু করে অন্যদের পেছনেও পড়ছিলাম আমরা। এভাবে অš—তঃ আধাঘণ্টা চলার পর হঠাৎই কানে তালা-লাগা গুলির শব্দে মনে হল ঠিক পেছনেই পাক আর্মি! দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতের বাঁয়ে ফাঁকা মাঠের দিকে প্রাণপণে দৌঁড় লাগালাম। মনে হচ্ছে পেছনে আর্মির বুটের শব্দ! গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ বুকে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
ছুটছি...। মনের মধ্যে আশার আলোÑযদি শেহালা পর্যš— পৌঁছাতে পারি, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে...। কিন্তু দৌড় যেমন শেষ হচ্ছে না, তেমনি আঁধার ঘনিয়ে আসছে। বেলা ডুবে গেছে। সামনে অনেকেই দৌড়াচ্ছে, পেছনেও...।
মনে হচ্ছিলÑএই বুঝি আমার পিঠে গুলি এসে লাগল! পাশাপাশি দৌড়াচ্ছিল পূর্ব আদাবাড়িয়ার নাহিদুল। আহ্ শব্দের গগণবিদারি চিৎকারে পাশে না তাকিয়েও দেখি দৌড়াতে দৌড়াতে লুটিয়ে পড়ল নাহিদুল। আতঙ্কে আমিও যেন পড়তে পড়তে আরও দ্র“তবেগে দৌড় শুর“ করলাম। ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে আমবাগান, জাম বাগানের ভেতর ঢুকে মনে হলÑআর একটু গেলেই হয়ত শেহালা! সামনে বিশাল বাঁশবাগান, বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দৌড়াচ্ছি; খুব বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না। গাঢ় অন্ধকার; একটু দূরের দু-একজনকে চোখে পড়ছে; আবার আড়াল হচ্ছে।
পা চলছে না। জোর করে চালাচ্ছি। হঠাৎ সড়াৎ-পা ফসকে বেশ বড় গর্তে ঢুকে গেলাম! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধুপধাপ শব্দে কতজন যে ছুটে গেল আশপাশ দিয়ে তার হিসেবের আগে দৌড়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্র“ত গতির সঙ্গে এই বুঝি ধরা পড়ি-ভয়ের যোগসূত্রিতায় মনে হল এমনিতেই দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। একটু পরেই দূরে আরও কয়েকটি গুলির শব্দÑরাতের আঁধার চেরা আর্তনাদ, তারপর সুনশান নীরবতা। শরীরে অনিশেষ কাšি—, ুধা-তৃষ্ণার যুগপৎ আগ্রাসনে পলকেই ঘুমিয়ে পড়ি।
এখন ভাবলে অবাক লাগে মানুষের আর্তনাদ, মাকে কোথায় কখন ছেড়ে পালিয়েছিÑসেকথা মনে না করতে পারার দুঃষহ যন্ত্রণাÑএসব কত সহজে ঘুমের কাছে সমর্পিত হয়েছিল! ...চোখে-মুখে বেশ গরম লাগছে, সারা শরীর ঘেমে চিটচিটে ভাব, হাত-পা যেন নড়াতে পারছি না, ঘুমের আবেশ চোখের পাতায় ভর করলেও আলোর ঝলকানিতে চোখ খুলতে বাধ্য হলাম। দেখি বাঁশঝাড়ের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে সূর্যের আলো পড়ছে চোখে-মুখে। বুঝলাম রাত পেরিয়ে সকাল ছেড়ে বেলা অনেক। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় বেশি আলোতে কষ্ট লাগছিল; পাশ ফিরলাম আরেকটু আয়েশ করব ভেবে। মনে করতে পারছি না পূর্বাপর ঘটনা।
যেই পাশ ফিরেছিÑভালো করে তাকিয়েই গা ছমছম করে ওঠে; পাশেই হাড়গোড়, পিঠের নিচেও হাড়ের অ¯ি—ত্ব টের পায়Ñসেকেন্ডের হাজার ভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই যেন বুঝে ফেলি আমি একটি পরিত্যক্ত কবরের মধ্যে শুয়ে আছি! শরীরের ব্যথা-বেদনা ত্বড়িত গতিতে হারিয়ে যায়Ñলাফিয়ে উঠি কবর থেকে। তারপর... ওখান থেকে এক দৌড়ে শেহালার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে...। ’’ Ñসিরাজ চাচা আরও অনেক কিছু বলেন। একরামুল কিছুই শুনতে পায় না। তার মনে হয় কবরে পা ভড়কে সে-ই পড়েছিল; এতণ নিজেই যেন ওখানে শুয়ে ছিল।
এই গল্পটা একরামুল খুব ছোটবেলায় শুনেছে। তখন ও পড়ত কাস সিক্সে, মথুরাপুর স্কুলে ভর্তি হয়েছে সেবারই। চাচা নিয়ে এসেছে গ্রাম ছেড়ে মফ¯^ল শহরে। ওখানে প্যান্টের পকেটে মুড়ি ঢুকিয়ে খেতে খেতে আরমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সেই আরমানের বাবা সিরাজুল ইসলাম।
একদিন টিফিনে আরমানের বাড়িতে গিয়ে সিরাজ চাচার কাছে এই গল্প শুনেছে একরামুল। হঠাৎ ‘জাদু দেখবা। ...’ ѯ^প্ন দেখেই সেসব মনে পড়ে গেল তার।
-একরাম ভাই কেমন আছেন?
-হ্যাঁ ভালো।
-আমি রাশেদ।
-ও, কমরেড রাশেদ। বলো কেমন আছ? [একরামুল ইচ্ছে করেই কমরেড স¤ে^াধনে তাকে ধরিয়ে দিল যে সে চিনতে পেরেছে। ]
-জ্বি ভালো। আপনি এখন কি করছেন?
-আছি একটা পত্রিকায়।
-কমরেড একটা বিষয়ে ফোন করেছিলাম।
কাইমেট চেঞ্জ নিয়ে এনজিও ব্যুরোতে ফান্ড চেয়েছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচিত আছে নাকি?
-না, ঠিক সেরকম নেই। তবে এমএমসির এ ধরনের একটা গবেষণা আমার বন্ধু শাহীন সম্প্রতি শেষ করেছে। পটুয়াখালী কেন্দ্রিক ওই গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংপে আমাদের জেলা প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। ছাপা হয়নি কোনো কারণে। যাই হোক, হঠাৎ খোঁজ-খবর শুর“ করলে কেন?
-না একটা যোগাযোগ ছিল; পার্টির মাসুম ভাইয়ের এনজিওর সাথেই কন্টাক্ট হয়েছিল।
মাসুম ভাই জানালÑতারা অন্য একটা কন্টাক্টে চলে গেছে। সুযোগ ছিল ফান্ড রিলিজ করানোর। একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন। কিছু বাড়তি আয়ও হবে।
-না, তেমন কোনো এনজিওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই।
আর আমি আসলে এখন একটু বেশি ব্য¯—। পরে কথা হবে রাশেদ। ’ [মোবাইলের নো বাটনটায় চাপ দেয় একরামুল]
নতুন হলেও কাগজের সার্কুলেশন ভালো। ফোন রাখার পরপরই বিভাগীয় প্রধান একটি নিউজ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মানবিক দিক বিবেচনায় রেখে নিউজটি এডিট করবেন। ’ ‘জ্বি আচ্ছা’-মাথা নাড়িয়ে একরামুল নিউজটি হাতে নেয়।
সম্পাদনা শেষে সেটি দাঁড়ায় :
মৃত ঘোষণার পর কবর দেয়ার
সময় কেঁদে উঠলো শিশুটি
চাঁদপুর প্রতিনিধি
মঙ্গলবার রাতে সদ্যজাত শিশুকে মৃত ঘোষণার পর চাঁদপুর শহরের পৌর গোর¯—ানে কবরে নামানোর সময় সে কেঁদে উঠায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যায় শিশুটি জš§ নেয় চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে। এ সময় তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন হাসপাতালের চিকিৎসক।
শাহরা¯ি—র দর্শনাপাড়ার আবদুর রব মিয়ার সাত মাসের অš—ঃসত্ত¡া স্ত্রী আলেয়া বেগম ৪ ফেব্রয়ারি সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। মঙ্গলবার বিকেলে হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা.ফাতেমা খাতুনের তত্ত¡াবধানে ও সিনিয়র নার্স লুৎফা বেগমের উপস্থিতিতে নরমাল ডেলিভারিতে তার কন্যা সš—ান হয়।
লুৎফা বেগম নড়াচড়া না দেখে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যার পর শিশুর বাবা শিশুটিকে দাফন করতে পৌর কবরস্থানে নিয়ে যান। কবরস্থানের কেয়ারটেকার র“হুল আমিন ও তাঁর সঙ্গী আবদুর রহমান কবর খুড়ে মাটিতে রাখতেই শিশুটি কেঁদে উঠে। পরে একটি এমবুলেন্স এনে শিশুটিকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ ঘটনায় সিভিল সার্জন কাম হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডা. শাহনেওয়াজ নার্স লুৎফা বেগমকে সাময়িক বরখা¯— করেছেন।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারি না। হাসপাতালের আরএমও সিরাজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদš— কমিটি করেছি। ’
-যে প্রাণীর যত পা; তার মাংসে তত কোলেস্টরেল। এই ধর“ন গর“-খাসি। আরও আছে চিংড়ি মাছ, এই মাছের বেশি পা তাই এতে কোলেস্টরেল অনেক বেশি।
¯^াদু পানির অন্য মাছ যেগুলোর পা নেই সেগুলো খেলে কোলেস্টরেল বাড়ে না।
-আচ্ছা ভাই, ডাইলে কি কোলেস্টরেল আছে?
-না, ডাইলে কোলেস্টরেল নেই। ডাইল তো সবজি।
-আপনার ওজন কত?
-৬৮ কেজি।
-বয়স?
-৫২
-তাহলে ঠিক আছে।
খাবার টেবিলে এরকম কথায় মত্ত অরবিন্দ মুন্না ও মহিবুল হাসান। পাশেই তাদের থেকে কম করে হলেও ২০ বছরের ছোটো; দোহারা ¯^াস্থ্যবান একরামুল হোসেন। এসব শুনে একরামুলের ভাবনায় তুলনামূলক দুটি চিত্র ভেসে ওঠেÑএখানে খাবার টেবিলে ভাত-ডাল ইচ্ছা মতো নেওয়ার সুযোগ, বাটিতে মাছ/মাংস পরিমাণ মতো দেওয়া থাকে। দুপুরে এর আগের অফিসে খাওয়ার কোনো সিস্টেমই ছিল না। বাসা থেকে খাবার আনলেও তা নিয়ে বসে খাবার মতো স্পেস মিলত না।
ছিল খাবার পানির সংকটও। তাই পাউর“টি-কলা, বিস্কিট-চা দিয়েই দুপুর পের“তো। সেটিও একটি ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্রের অফিস। আর বর্তমান অফিসে ডেস্কে বসে সামনে তাকিয়ে পুরো সীমানা দেখতে চোখের কষ্ট হয়। এপাশ থেকে ওপাশে টয়লেট [বলা হয় ওয়াশর“মÑছোট কাজ করা যায়, বড় বড় আয়নায় মুখ দেখা; চুল চির“নি করা, ইন ঠিক করা যায়।
তবে বড় কাজ করতে চাইলে আরো এক ফর্দ হেঁটে বাইরে ওপরের তলায় কমোডওয়ালা...] অবধি হেঁটে দুবার গেলে-এলে মনে হতে পারে রমনা পার্ক একচক্কর দেওয়া হল! এমন ভাবনায় ছেদ পড়ে; মুন্না বলে
-একরামুল দেখি কিছুই বাছ-বিচার করে না; খাইও আমাদের দ্বিগুণ। দেখে মনে হয় পেশার-টেশার আছে। আছে নাকি?
-মেপে দেখিনি তো।
-আরে দেখেন দেখেন...।
-আচ্ছা দেখব।
বললেও বিষয়টিকে পাত্তা দেয় না একরামুল। মনটা বিষিয়ে ওঠে। আধাপেটা খেয়েই ডেস্কে ফিরে।
একটু পরে ডেস্কে আসে মুন্না ও মহিবুল। দার“চিনি চিবুতে চিবুতে গল্পে মাতে।
বিষয়Ñপার্কে সকালে হাঁটা। মগবাজার থেকে কোনো কোনোদিন ভোর ৫টায় রমনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় মুন্না। হালকা কুয়াশা ভেদ করে কীভাবে রমনায় গিয়ে পৌঁছায় সেইসব কথা...। আর মহিবুল শোনায় কীভাবে বাসার ছাদে গিয়ে ব্যায়াম করে। তিনি যোগ করেন-
-আরে আজ কী হয়েছে দেখুন না! বড় ছেলে আয়ানের ঘুমও আমার সঙ্গে সঙ্গে ভোরেই ভাঙল।
সে পিছু ছাড়ে না, নিয়ে গেলাম ছাদে। পেছন পেছন বেশ দৌড়াল। ঘরে ফিরে দেখি কাশতে শুর“ করেছে। ওর মা তো আমাকে এককি¯ি— নিল...। আরে ভাই দাঁড়ান; দাঁড়ানÑওকে একটা ফোন করে ছেলেটার খবর নেয়।
পত্রিকার পাতায় কোথাও চাঁদপুরের নিউজটি ছাপা না হওয়ায় মন খারাপ হয় একরামুলের। দু’একটি জাতীয় দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠায় বক্স করে ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের চাপে অবশ্য পত্রিকায় জায়গার সংকট আছে। কিন্তু দেখলÑএর চেয়ে খারাপ নিউজও ছাপা হয়েছে। এসব ভাবছিল, এ সময় বিভাগীয় সম্পাদক ওই নিউজের ফলোআপ ধরিয়ে দিলেন হাতে।
পরের দিন নিউজটি ভেতরের পাতায় উপরের দিকে সিঙ্গেল কলামে বক্স করে ছাপা হল : ৩০ ঘণ্টা লড়াই করে মারা গেল শিশুটি
-আরমান কেমন আছ?
-হ্যাঁ ভালো, তুমি?
-খারাপ না, চলছে আর কি।
- নতুন কাগজে জয়েন করার পর তো আর খোঁজ-খবরই পাওয়া যায় না তোমার।
-আর বলো না, ব্য¯—তার জন্যই তোমাকে এই কয়দিন ফোন করা হয়ে উঠেনি।
-চাচাজান কেমন আছে?
-আছে ভালোই, কিন্তু...
-কোন সমস্যা?
-না তেমন কিছু না, রিটায়ার্ডের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন।
-কেন? কিছুদিন আগে তো ফ্যামিলি পানিং সেক্টর পুরোটাই রাজ¯^ খাতে গেছে।
এখন তো পেনসনও ভালো পাওয়ার কথা।
-না সেসব ঠিক আছে। মুশকিল হচ্ছে...
-মানে ঠিক বুঝলাম না।
-আব্বার খুব মন খারাপ হচ্ছে চাকরি ছেড়ে উনি কীভাবে থাকবেন, সেটা ভেবে। আর আমি দেখছিÑএই চিš—াতেই তার বয়স দ্র“ত বেড়ে যাচ্ছে।
-এটা তো চিš—ারই কথা। চাচাজানকে বোঝানো উচিত...।
-বুঝাচ্ছি...
-আরেকটা বিষয়Ñদেখবে অবসরের পর কয়েক দিন মন খারাপ করবে, পরে মানিয়ে নেবে।
-হবে হয়ত।
-আর কি খবর বলো?
-কি জানতে চাও?
-ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারগিরি কেমন চলছে?
-খারাপ না, পোস্টিংটা এলাকায় নিতে পারলাম না।
-হ্যাঁ, এই সময় চাচাজানের কাছে থাকতে পারলে উনার নিঃসঙ্গতাও একটু দূর হতো।
-ঠিক ধরেছো। আমিও...। একরাম আমার মোবাইলে কে যেন ফোন করেছে, তুমি লাইনটা কাটবে একটু।
-ঠিক আছে।
কাটছি...।
এর আগেও বেশ কয়েকবার কথা বলার সময় আরমানের মোবাইলে অন্য ফোন ঢুকেছে। তখন তাকে লাইন কেটে দিতে হয়েছে। আরমানকে দু-একবার বলেছেও এই কল এ্যালার্টের অপকারিতা সম্পর্কে। তারপরও ডিএ্যাকটিভ করেনিÑএসব মনে পড়েই একরামুলের মুড অফ হয়।
এই অপশনের প্রধান দুটো অপকারিতাÑঅন্য লাইনে ব্য¯— থাকার কারণে কোনো ফোন রিসিভ করতে না পারলে কল ব্যাক করতে হয়। অথচ অনেক সময় কলব্যাক করে দেখা যায় ওই কলার তার গুর“ত্বপূর্ণ প্রয়োজনেই ফোন করেছিলেন কিংবা উটকো কোনো ফোন। অপশনটা এ্যাকটিভ না থাকলে ওই কলার ফোন বিজি পেত, প্রয়োজন মনে করলে পরে ফোন করত। এতে অন্যপরে সমস্যা হয় না।
বিভাগীয় প্রধান নজর“ল ইসলাম শামীম জানতে চাইলেনÑমুন্না শিবচরের নিউজ এসেছে?।
মুন্না বললেন-সাভারের নিউজ এসেছে।
উঠে এলেন শামীম। মুন্নার ডেস্কের কার্নিশে হাত রেখে বলেন-‘বুঝলেন মুন্না, ই-মেইল ডাউন লোড করেন আপনি, আপনাকে বললাম, শিবচরের নিউজ আসছে কিনা? আপনি বললেন, সাভারের নিউজ এসেছে। কোন প্রশ্নের কি উত্তর সেটা নিয়ে একটা কৌতুক বলি; শোনেন :
ভাতিজাকে দোকানদারি শেখাচ্ছেন চাচা। প্রথমদিনে বুঝিয়ে বললেন-
চাচা : ক্রেতা এলে তার সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলবে।
ধর, কোনো ক্রেতা তোমার কাছে চাইল পেপসোডেন্ট পেস্ট। কিন্তু তোমার দোকানে তখন পেপসোডেন্ট নেই। কী করবে?
ভাতিজা : বলবÑপেপসোডেন্ট নাই।
চাচা : এভাবে বলা যাবে না।
ভাতিজা : তাহলে কী বলব?
চাচা : বলবেÑজ্বি পেপসোডেন্ট তো নেই, তবে ডি-৫ আছে, নিতে পারেন।
ভাতিজা : না নিলে কি বলব?
চাচা : বিনয়ের সঙ্গে বলবে, তাহলে কাল আসুন, পেপসোডেন্টই দিতে পারব।
[বেশ কিছুদিন পর এক ভদ্রমহিলা এসেছেন দোকানে]
ভদ্রমহিলা : টয়লেট পেপার আছে?
ভাতিজা : না ম্যাডাম, তবে শিরিশ কাগজ আছে, নিতে পারেন।
মুন্না, একরামুলসহ ডেস্কের অন্য সহকর্মীরা হো হো করে হেসে ওঠেন।
প্রাসঙ্গিক বিষয়ে হুটহাট এমন কৌতুক বলেন বিভাগীয় প্রধান। এতে উজ্জীবিত হন সহকর্মীরা, হাসির হুলোড় পড়ে।
নতুন করে নিউজ এডিটে মন দেন সবাই। পত্রিকার শুর“র দিকে বিভাগীয় প্রধানের বলা আরেকটি চুটকি মনে পড়ায় মিটিমিটি হাসতেই থাকে একরামুল। সেদিন সংপ্তি ব্রিফিং শেষে প্রকাশিতব্য পত্রিকার সম্পাদক ও মালিকের কিছু বিষয়ের বিরোধের প্রসঙ্গে গল্পটি বলেন। তিনি বলেনÑ এক বয়স্ক নানা তার ৭/৮ বছরের নাতি ও নাতনিকে নিয়ে পাশের গ্রামে মেলায় যাচ্ছিলেন। রা¯—ায় যেতে যেতে তাদের কথপোকথন ছিলÑ
নাতি : নানা মুতব?
নানা : ইশ্, আর সময় পাইলি না।
যা ওই বাবলাগাছটার কাছে যাইয়ি মুতে আয়।
[নাতি ওখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে আসে। এবার নাতনি বলে]
নাতনি : নানা আমিও মুতব।
নানা : তোদের নিয়ে এই হয়েছে জ্বালা, একটা যা করবে, আরেকটাকেও তাই করা লাগবে।
নাতনি : আমার মুত আসছে তো?
নানা : তো যা, ওই বাবলা গাছের আড়ালে গিয়ে বইসি মুতে আয়।
নাতনি : ও দাঁড়িয়ে মুতল, আমি বইসি মুতবো ক্যান?
নানা : যা বুলছি তাই কর। কারণ পরে বুলছি।
নাতনি : আগে বল।
নানা : যা, না হলে থাপ্পড় খাবি কিন্তু।
নাতনি : আচ্ছা যাচ্ছি, আইসি কিন্তুক শুনব।
নাতনি বসে প্রস্রাব করে এসে বলে-
-এইবার বলো ও দাঁড়িয়ে মুততে পারলে আমি পারব না ক্যান?
নানা : আসলে কি হয়েছে জানিস, তোর ভাইটার যা আছে তোর তা নাই, তাই...।
নাতনি : ওর যা আছে, আমার কি তা কোনোদিন হবে না?
নানা : বিয়ের পরে তুইও তা একটা পাবি কিন্তু...
নাতনি : কিন্তু কি নানা?
নানা : মানে ওটা মাঝে মধ্যে তোর ভেতর যাবে আর আসবে, তুই পুরোপুরি ওই জিনিসটার মালিক হতে পারবি না।
এমন অশীল গল্পে সেদিনও সবাই বেশ হেসে ওঠেন। পাশের ডেস্কের এলিজার মুখ লাল হয়। কিন্তু সেদিকে পুর“ষ সহকর্মীদের চোখ পড়লেও সবাই নির্লিপ্ত।
সংবাদপত্রের পরিবেশ ডাক্তার-রোগীর সম্পর্কের মতো যেন, কিছুই আড়াল থাকে না।
- ¯ামালেকুম। আমি একরামুল।
-ওয়ালাইকুম আস্সালাম। কেমন আছ ব্যাটা?
-জ্বি ভালো, আপনারা?
-হ্যাঁ, ভালো।
-অনেকদিন তোমার ফোন পায়নি, ভাবছিলাম খোঁজ নেওয়া দরকার। তাছাড়া একটা প্রয়োজনও ছিল।
-জ্বি বলুন না, কি প্রয়োজন?
-তুমি কি গত কয়েকদিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সবৃদ্ধি সংক্রাš— কোনো খবর পড়েছো?
-ঠিক মনে পড়ছে না? [সংবাদপত্রে চাকরি করেও ঠিক মতো পত্রিকা পড়া হয় না, এতে নিজেকে কিছুটা অপরাধীও মনে হয়]
-তোমার কি দেখার সুযোগ হবে?
-অবশ্যই, আমি দেখে আপনাকে জানাবো।
-তাহলে রাখি বাপ।
-জ্বি, ¯ামালেকুম।
সিরাজচাচা ফোনের আলাপে ‘ব্যাটা’ ও ‘বাপ’ শব্দ দুটি এমন করে বলেন, একরামুলের বুকের ভেতর রিনরিনে ভালোলাগার অনুভ‚তি তৈরি হয়।
এরপরও দুইদিন পর একরামুলের সময় হয় পত্রিকার ফাইল ঘেটে নিউজটা বের করার। তারপর ফোন করে সিরাজ চাচাকে, জানায়Ñসত্যিই মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়বে। এলপিআরে চলে গেছেন যারা তাদেরও।
-তুমি সত্যি বলছ বাপ!
-হ্যাঁ, এ বিষয়ে গেজেট বের“বে কয়েকদিনের মধ্যেই।
[ফোনের ওপাশ থেকে ¯^¯ি—র যে নিঃশ্বাস তিনি ছাড়েন তাতে একরামুলের মনে হয়Ñতার বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর সরে গেল]
-বাঁচা গেল! ...
হোসেন শহীদ
মোবাইল : ০১৭১২৯২৭৯২৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।