মানবতাই ধর্ম !
সরকারি আমলা আনিসুজ্জামান চৌধুরী রাত তিনটায় তাঁর বেডরুমে বসে আছেন। তিনি বিপত্নীক ,তাই আনিস সাহেবের পাশে তাঁর স্ত্রী শুয়ে নেই। স্ত্রী মারা গেল তিন বছর হয়ে এসেছে। বয়স থাকলেও আর দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছে নেই। আনিসুজ্জামান চৌধুরীর বয়স ৫৬, উচ্চপদস্থ আমলা, ভুরি বেশ দশাসই, গ্যালিস দিয়ে প্যান্ট পড়েন তাতে একটু ভারিক্কি ভাব আসে।
আনিসুজ্জামান এই মধ্য রাতে বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছেন তার পেছনে একটা কারণ আছে। এসি রুমেও তিনি ঘামছেন। কারণ একটাই-তিনি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা এইরকম-আনিস সাহেব গহিন অরন্যে দৌরাচ্ছেন,পেছনে তার বাল্য বন্ধু কালাম,তার দুই হাতে হাজার হাজার সাপ। আনিস সাহেব জানেন কালাম তাকে ধরতে পারলে ঐ সাপগুলো তাকে কামড়াবে।
আনিস সাহেব কিন্তু সাপের ভয়ে হাঁপাচ্ছেন না। হাঁপাচ্ছেন এই কারণে যে তিনি কালামকে স্বপ্ন দেখেছেন। কালাম আনিস সাহেবের নেংটা কালের বন্ধু। এক সাথে বৈশাখ-জৈষ্ঠের ঝড় শেষে আমকুড়ানো,মাঝ নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা আর স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে বসে পুরো ক্লাশকে জ্বালানো এই ছিল তাদের কাজ। কালাম ছাত্র হিসেবে ছিল দারুন তবে পড়া লেখায় তার মন ছিল না বিধায় সব সময় সে শিক্ষকদের হাতে নিগৃহিত হত।
আনিস সাহেব ছিলেন শান্ত এবং সৌম্য তবে তা শুধু বাড়িতেই। বাড়ির বাইরে তাঁর থেকে দুরন্ত আর কেউ ছিল না। আনিস সাহেব বাবাকে অনেক ভয় পেতেন, মা ছিল না তাই বাবা রেগে গেলে তাকে থামানোর কেউ ছিল না। আনিস সাহেব চাইতেন না বাবার হাতে মার খেতে। একবার কালামের জোরাজুরিতে উঁনি আর কালাম গেলেন মতির ঝিলে মাছ ধরতে।
তখন ছিল বর্ষাকাল,কদম গাছে কদম আর চারিদিকে পাকা কাঁঠালের গন্ধে একাকার। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল রাত আর আনিস সাহেবের বাবার রাগ দেখে কে! কালাম আর কিশোর আনিসকেসহ বেদম প্রহার। গরিবের ছেলে কালাম সেদিন বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনি,বন্ধু আনিসের জন্য সে দ্বিধাহীন ভাবে মার খেয়েছে। ঐ দিনের পর থেকে আনিস সাহেব আর কালামের মাঝে সৃষ্টি হয় এক ধরণের দূরত্ব যা আর কোনদিনই ঘোচেনি।
কালাম এর পর থেকে আনিস সাহেবকে এড়িয়ে চলত।
আনিস সাহেব সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেও পারেননি। কালামের বাবা ছিল কৃষক। বাবা কৃষক হওয়া সত্যেও কালাম পড়ালেখা করত। স্কুল শেষ করে বা বন্ধের দিনে সে বাবাকে সাহায্য করত। কালামের বাবা জুলমত আলি চাইত কালাম পড়ালেখা করুক,মানুষের মত মানুষ হোক,চাষার বাচ্চা গালি যেন তার ছেলের শোনা না লাগে।
কালাম বাবার কাছ থেকে শুনত কিভাবে,কী উপায়ে কাজ করলে সৎ থাকা যাবে,কারো ক্ষতি কেন করা উচিত না,কেন সে আর আনিসের সাথে মিশবে না। চাষার ছেলে কালাম আনিসকে প্রচন্ড ভালবাসত তাই চায়নি আনিসকে আর তার বাবার হাতে মার খাওয়াতে।
আনিস সাহেব তখন সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, আগের রাতে তেমন পড়া হয়নি বলে পকেটে করে নিয়ে গেছিলেন কিছু বইয়ের কাটিং যদি কমন পড়ে। তবে আনিসুজ্জামান চৌধুরীর দুর্ভাগ্য কিছুই কমন পড়ল না। সামনে বসা কালামকে আনিস সাহেব দ্বিধা নিয়ে, মৃদু সংকোচে দেখাতে বললেন।
কালাম যেন শুনেও শুনল না। আনিস সাহেব আবারও বললেন, না ,এবারও কালাম শুনল না। আনিস সাহেব আকুতি-মিনতি করে বললেন কিন্তু কালামের রা নেই। পেছন থেকে খোঁচান,গুতা মারেন, না, কালাম তাও টু শব্দ করে না। শেষ মেষ আর না পেরে আনিস সাহেব তখন কালামের পিঠে সজোরে এক চিমটি মারলেন,কালাম চিৎকার করে ওঠায় স্যার এসে পড়লেন ।
ঘটনা সামান্যর ওপর দিয়ে যেত কিন্তু দুর্ভাগা আনিস সাহেবের পকেট ফুলে থাকায় স্যার চেকিং করাতে এক দলা কাগজ বেরিয়ে আসল। আনিস সাহেবকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হত যদি তার বাবা জোর চেষ্টা না করত।
আনিস সাহেব এ ঘটনায় কালামের ওপর বিরক্ত হলেন এবং একই সাথে কালামের ক্ষতি করার বুদ্ধি আঁটলেন। আনিস সাহেবের সাথে পরিচয় ছিল তাদের এলাকার এক সাপুড়ের। সাপুড়েকে বেশ কিছু পয়সা দিয়ে আনিস সাহেব বললেন একটা গোখরা সাপ দিতে।
আনিস সাহেব জানেন কালাম বনে জংগলে ঘোরা ছেলে সে ঢোরা সাপ দেখে কিছুতেই ভয় পাবে না। সাপুরে আনিসকে তার মতলব না বুঝেই বাক্স করে দিয়ে দিল এক গোখরা সাপ । আনিস স্কুলের পাশের রাস্তায় এসে দেখে স্কুল ছুটি হয়েছে। সে আস্তে আস্তে নির্জন এক রাস্তায় সেই বাক্স নিয়ে একটা গাছের মাথায় উঠল। কিশোর আনিস কালামকে শুধুই ভয় দেখাতে চেয়েছিল।
কালাম গাছের কিছুটা কাছাকাছি আসতেই আনিস সাহেব বাক্স খুললেন আর সাথে সাথে সাপটা ছোবল মেরে উঠল। আনিস সাহেব গাছ থেকে পড়লেন সাপের কামড় খেয়ে।
আনিস সাহেব সুস্থ হয়ে উঠলেন। অনেক দিন ভাঙ্গা পা নিয়ে পড়ে ছিলেন বিছানায়। সাপটার বিষ তার শরীরে ছড়াতে পারেনি কালামের জন্যই।
কালামের বুদ্ধির জোরেই আনিস সাহেব বেঁচে গেলেন। কিন্তু কালাম কই? আনিস সাহেব তার বাড়ির লোকজনদের কাছে জানতে পারল কালামকে তার বাবা প্রচন্ড মেরেছে এই ঘটনার জন্য। আনিস সাহেবের বাবার ধারণা কালামই সাপ এনে আনিসকে কামরিয়েছে আর সেই তাকে গাছ থেকে ফেলে দিয়েছে। কালাম যখন আনিসকে নিয়ে আসে বাড়িতে আনিস তখন অজ্ঞান। মার খেয়ে পাঁচদিন জ্বরে ভুগে চাষার বাচ্চা কালাম বিনা চিকিৎসায় মারা গেল।
আনিস সাহেবের স্বপ্নের সাপগুলো সেই গোখরার মতোই দেখতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।