আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আনিস, আল্লাহ তোকে বেহেশত নসিব করুন


এটিএম আনিসুজ্জামান। একুশে টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক ‘ভাবী’র করিম মিয়া চরিত্রের অভিনেতা। এক অভাগী মা ও এক অভাগা পিতার ছোট ছেলে আনিস। সে আর নেই। গত ২১শে এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় রাজধানীর বাংলামোটরে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় সে।

এই দুর্ঘটনার প্রতিবাদে আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন বিকাল ৪টায়। যারা একটি প্রতিভার মৃত্যুতে আহত, যারা মানবতার জন্য উৎসর্গীত তাদের প্রতি এতে যোগ দেয়ার আহ্বান রইল। আমার আপন চাচাতো ভাগিনা আনিস। রাতের কাজ সেরে যখন বাসায় ঢুকে রাতের খাবার খেয়ে বসেছি শোয়ার জন্য তখনই ভাতিজা ইলিয়াসের ফোন- কাকা, আনিস এক্সিডেন্ট করেছে বাংলামোটরে। আমি জানতে চাই- মারাত্বক কোন আঘাত পেয়েছে? ও বলল- সে রকমই শুনেছি।

আবার আমি বলি- তুই তাহলে ঢাকা মেডিকেলে যা। দেখ কি অবস্থা। আমাকে জানাস। আমি ভাবি, মারাত্বক কোন দুর্ঘটনা হলে যেয়ে ব্যবস্থা নেব। আর ছোটখাট কোন আঘাত পেয়ে থাকলে পরদিন সকালে যেয়ে দেখে আসব।

কতক্ষণ পরে ইলিয়াসের ফোন- মনিকাকা!.... কিরে কথা বলিস না কেন? কাকা, আনিস.... হ্যাঁ, বল। আনিস কি? নেই। নেই মানে? কি বলিস? ওপাশ থেকে ইলিয়াস হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকে ইলিয়াস। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

একি শুনছি? হাত-পা কাঁপতে থাকে। মোবাইলে ক্রেডিট নেই। কাকে ফোন করি। কি বলব। বড় ভাইকে ফোন করব? সে তো স্ট্রক করেছে মাস দুই আগে।

তাকে কি এত রাতে এ খবর জানানো ঠিক হবে? অগত্যা ভাবির মোবাইলে ফোন করি। কিন্তু তা বন্ধ। আমি তাদেরকে খবর জানাতে ব্যর্থ হয়ে চেষ্টা করি ভাতিজির মোবাইলে ফোন করতে। কিন্তু তাও বন্ধ। আমি এখন কি করি? মানুষ কেন যে রাতে ফোন বন্ধ করে রাখে।

এক অস্বস্তির মধ্যে রাত গাঢ় হতে থাকে। আমার মাথা ততই বেহিসেবি হয়ে ওঠে। আবার ইলিয়াস ফোন করে- কাকা, লাশ কি করব। রাতেই নিয়ে যাব বাড়ি? আমি ওকে বারণ করি। বলি- মেডিকেলে অনেক আনুষ্ঠানিকতা আছে।

তা শেষ করতে সকাল হয়ে যাবে। সকালেই বাড়ি নেয়ার ব্যবস্থা কর। আমি ভোরে আসছি। আপাতত লাশ মর্গে ফ্রিজে রাখতে বল। ঠিক আছে।

ইলিয়াস লাশ মর্গে রেখে বাসায় চলে যায় সে রাতের মতো। পরদিন ভোরে যেয়ে দেখি লাশের পোস্ট মর্টেমের জন্য ঢোকানো হয়েছে। আমাদেরকে যখন লাশ দেয়া হয়। দেখি তরতাজা আনিস তাকিয়ে আছে। মনে হলো ও মুখ খুলে এখনি বলে উঠবে- মামা, এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আপনার যে বইটি বের হচ্ছে আমি তার ইলাস্ট্রেশন করে দিই।

কভার করে দিই। উল্লেখ্য, গত বই মেলায় ও ঠিক এ ভাষায়ই আমাকে একটি ফোন করে। আমি ওকে ইতিবাচক জবাব দিতে পারি নি। কারণ ততক্ষণে আমার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বা কভার করানো হয়ে গেছে। ওকে কথা দিই- আগামী মেলায় নতুন বই ওকে দিয়ে করাবো।

ওর নিস্তব্ধ মুখখানা দেখে কষ্টে বুকটা যেন ভেঙে গেলে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, আনিস আমার বইয়ের কাজ করে দে। তোর জন্য নতুন বই লিখেছি। ওর জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ই নভেম্বর ফরিদপুরে। ২০০০ সালের শুরুতেই চলে আসে ঢাকায়।

যোগ দেয় পদাতিক নাট্য সংসদে। এরই মাঝে আবৃত্তি একাডেমিতে যোগ দেয় এবং নিয়মিত আবৃত্তি চর্চা করে আসছিল। এছাড়া টেলিভিশন নাটক পরিচালনার প্রতি ঝোঁক আসে তার। দেবাশিস বড়ুয়া দ্বীপের পরিচালনায় বাংলাভিশনে প্রচারিত ‘ব্যস্ত ডাক্তার’ ধারাবাহিকের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করে। একইসঙ্গে অভিনয়ও করে।

পরে একই পরিচালকের ‘ভাবী’ ধারাবাহিকে কাজ করে। পদাতিক নাট্য সংসদের নিয়মিত মঞ্চ প্রযোজনা ‘কথা ৭১’সহ আর বেশ কিছু নিয়মিত প্রযোজনায়ও অভিনয় করে আনিসুজ্জামান। নাট্যকর্মী এবং আবৃত্তি সংগঠক এটিএম আনিসুজ্জামানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে ২২শে এপ্রিল। তাকে দাফন করা হয় ফরিদপুরের মধুখালি থানার নিজ গ্রাম দস্তরদিয়া কবরস্থানে। এর আগে দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এরপর বাদ জোহর নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। টিএসসিতে মরদেহ রাখাকালে এই নাট্যকর্মীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র, ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটারসহ বেশ কিছু নাট্যদল এবং নাট্যকর্মী। সে সময় উপস্থিত ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, গোলাম কুদ্দুস, নাদের চৌধুরী, হাসান আরিফ, আহমেদ গিয়াসসহ আরও অনেকে। এর পর লাশ নিয়ে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের ভাড়া করা এম্বুলেন্স আনিসকে নিয়ে ছুটে যায় ফরিদপুর। আমার কিছু স্মৃতি আগেই বলেছি, এক হতভাগা মা ও এক হতভাগা পিতার ছোট ছেলে আনিস।

নিজের বলতে এক শতাংশ জমি নেই। পিতা হাবিবুর রহমান মিয়া অন্যের ক্ষেতে দিনমজুরি করেন। মা হাজেরা বেগম অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। এ থেকে যে আয় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলে তাদের। এরই মাঝে আনিস নাটক চর্চা শুরু করে।

ওকে অনেক বলেছি, নাটক-ফাটক করা বড়লোকদের কাজ। নাটক করে বেড়ালে খাবি কি। মা-বাবাকে সাহায্য কর। একটা চাকরি কর। আনিস কোন জবাব দিত না।

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ও নিজে নাটক লিখতো। তা মঞ্চস্থ করতো আলম মাতুব্বরের বাড়িতে। গ্রামের লোকজন ভিড় করে দেখতো ওর নাটক। ঢাকায় এসে যখন নাটকের লাইন ঘাট খুঁজে বেড়াতে থাকে তখনও বলেছি একটা কাজ কর। মা-বাবার পাশে যেয়ে দাঁড়া।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। আনিস নাটক করতে থাকে। কাজ করে লিটল ম্যাগাজিনের। আরও কয়েকজনে মিলে বের করে লিটল ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনের নামটি আর মনে নেই।

একবার ঈদে বাড়ি গিয়েছি। ও আমার হাতে একটি লিটল ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল মামা এটা আমরা বের করেছি। আমার খুব রাগ হয়েছিল ওর ওপর। পরে চিন্তা করি ও তো গঠনমূলক পথে রয়েছে। তার পর চলতে থাকে আনিস।

একদিন একুশে টেলিভিশন খুলে দেখি ভাবী নাটক হচ্ছে। সেখানে চাযের দোকানদার করিম মিয়া আমাদের আনিস। ভাবতে ভালই লাগল। আমার স্ত্রী বলল- ওতো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কতগুলো বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছে। আমি ভীষণ অসুস্থ হলে সর্বশেষ আমার বাসায় এসেছিল।

আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। মা ওর কাছে পাঠিয়েছিল কবিরাজি ওষুধ দুর্বা ঘাস, পেঁপে। তাই নিয়ে সেই ফরিদপুর থেকে আনিস আমার বাসায় আসে। তার পর তাকে আর দেখি নি। দেখলাম ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিস্তব্ধ, নীরব।

এক অভিমানী আনিসকে। ২২ তারিখে ওর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল ২২ তারিখে ওর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। এখনো বিয়ে করেনি। মা-বাবা বিয়ে করাবার জন্য মেয়ে দেখছিলেন। বাড়ি গিয়ে পাত্রী দেখবার যাওয়ার কথা।

কিন্তু আনিস বাড়ি গেল। অন্য এক আনিস হয়ে। যাকে কেউ আর আগলে রাখতে চায় না। যত তাড়াতাড়ি পারে ওকে বিদায় দিতে পারলেই যেন বাঁচে সবাই।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.