মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি জগতের মধ্য শ্রেষ্ঠ করে তৈরী করেছেন। উদ্দেশ্য মাত্র একটাই- তা হলো এই মানুষই দিকে দিকে তার একত্ববাদ প্রচার করবে। এ কারনেই আল্লাহ সর্বপ্রথম মহামানব হযরত আদন (আ) কে ধরার বুকে প্রেরন করেছিলেন। তারপর আখেরী নবী ও রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। সকল নবীই একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য মানুষকে আহবান জানিয়েছিলেন।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে হযরত রাসূল (স) এর ওফাতের পর থেকে নবুয়তের যুগ সমাপ্ত হয়েছে। এর পর থেকে শুরূ হয়েছে অলীদের যুগ। যাকে বেলায়েতের যুগ ও বলা হয়। এ যুগে যারা মানুষকে হেদায়েতের পথ দেখান তাদেরকে অলী-আল্লাহ বলা হয়।
কোন কোন মনীষীর মতে নবূয়ত মনসুখ বা বাতিল হয় কিন্তু বেলায়েত মনসুখ হয়না বরং অব্যহত ধারায় চলতে থাকে।
নবুয়তের যুগের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, যখনই দুনিয়ার বুকে কোন নবীর আগমন ঘটেছে তার পূর্ববর্তী নবীর সংবিধান তখন বাতিল হয়ে গেছে। পুর্ববর্তী নবীর জীবীত উম্মতদের পরবর্তী যুগের নবীর প্রতি পুর্ন আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়েছে যারা করেনি তারা ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে এখানে ধর্ম বা ধর্ম গ্রন্থের চেয়েও বেশী গুরুত্ত হচ্ছে ব্যক্তির। কেননা ধর্ম গ্রন্থ মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনা।
বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগনই নবীর উত্তরসূরী হিসেবে দায়িত্ত পালন করে থাকেন।
" আমি আমার উম্মতের মধ্য থেকে একদল লোক এমন সৃষ্টি করেছি যারা সঠিক পথের নির্দেশ দিবে এবং ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে ( সুরা আরাফ-১৮১)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায় অলী আল্লাহগন আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। তাদেরকে মানুষের হেদায়েতের জন্যই পাঠানো হয়েছে। আর এ কারনেই হযরত রাসূলে (স) আকরাম এর ওফাতের পর থেকেই যুগে যুগে অলী-আল্লাহগন ইসলাম প্রচার করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে আসছেন। উদ্দেশ্য মানুষ তাদের দ্বারা সৎপথের সন্ধান লাভ করুক।
আল্লাহর একত্ববাদ তথা ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অলী-আল্লাহগন বিরাট ভুমিকা পালন করে আসছেন।
কিন্তু দুখের বিষয় এই যে যাদের জন্য এই মহামানবগন জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে থাকেন তারা তাদের সঠিক মূল্যয়ন করা তো দুরের কথা বরং নানাবিধ কটাক্ষ করতেও অনেকে দ্বিধাবোধ করেনা। নবীদের জীবনে ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে আল্লাহ যখনই কোন নবীকে পাঠিয়েছেন পথভোলা মানুষ তাকে চিনতে না পেরে নানাবিধ ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অত্যাচার করেছে। এমনকি অনেক কে হত্যা পর্যন্ত করেছে।
" তাদের নিকট এমন কোন রাসূল আসেনি যাকে তারা ঠাট্টা করতোনা ( হিজর আয়াত-১১)
অলী_আল্লাহগের অবস্থাও তদ্রুপ যুগে যুগে তারা অত্যাচারী শাসকদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবুও তারা ধর্ম প্রচারে ক্ষান্ত হন নি।
কোন কোন সময় নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গমন করেছেন। এ সকল অলী আল্লাহর আকর্ষনীয় চরিত্র-মাহাত্ম্য ও কঠোর আত্মত্যগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের জাগরন সূচিত হয়েছে।
ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার:
ভারতবর্ষের মানুষ ইসলামের দাওয়াত পেলেন কিভাবে? আর কার কাছেই বা কলেমা পড়ে তারা মুসলমান হলেন। যতদুর জানা যায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর ওফাতের পরে একদল লোক রাসূল (স) এর আদর্শ মোহাম্মাদী ইসলাম প্রচারের জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাদের উসিলায় মানুষ আল্লাহ ও রাসূলের সন্ধান লাভ করেছে। খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দিতে হযরত ওমর (র) খেলাফত কালে কয়েকজন মুসলমান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশে আসেন।
তাদের নেতা ছিলেন মামুন (র) ও হযরত মোহায়মেন (র)। তারা এদেশে এসে হিন্দু , বৌদ্ধ ও অন্যান্য অমুসলিম উপজাতীয়দের মদ্ধ্য ইসলামের আদর্শ প্রচার করতে লাগলেন। ফলে বেশ কিছু লোক ইসলাম গ্রহন করেন। এরপরে পুনরায় এদেশে যারা ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছেন তারা হলেন হযরত হামিদুদ্দীন, হযরত হোসেন উদ্দীন হযরত মুর্তাযা হযরত আবদুল্লাহ ও হযরত আবু হালিব। মোট ৫ টি দল পর পর বাংলাদেশে আগমন করেন।
তাদের সাথে কোন অস্র বা কোন কিতাবাদি ছিলনা তারা রাজ ক্ষমতার সাহায্য গ্রহন করেন নি। এ সকল সাধকের লক্ষ্য ছিল ইসলামের আদর্শ ও উন্ণত চরিত্র দিয়ে অমুসলিমদের আকৃষ্ট করা এবং সংখ্যায় কম হলেও প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান তৈরী করা। কেন না নামধারী মুসলামান অনেক থাকার চেয়ে আল্লাহ ও রাসূলের (স) প্রতি পূর্ন ঈমানদারের সংখ্যা কম হলেও উত্তম।
এই সাধকেরা গ্রামন্চলে বসবাস করতেন এবং মাঝে মাঝে বিভিন্ন এলাকা সফর করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। তাদের পরে মিশর ও পারস্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আরো ৫টি দল আগমন করেন।
তাদের বলা হতো আবিদ। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় খানকাহ স্থাপন করে ধর্ম প্রচারে কাজ চালিয়েছেন।
পাক ভারত বাংলা উপমহাদেশে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার অনেক পূর্বে থেকেই ইসলাম প্রচার কাজ শুরূ হয়। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে মূসলীম মনীষী ও অলীগন এদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য আগমন করেন। তাদের মধ্য বেশীরভাগই ছিলেন ইয়েমেনের বাসিন্দা।
সূদূর আরব দেশ থেকে অনেক অলী আল্লাহগন বাংলাদেশে আগমন করে ইসলামের সত্যবানী প্রচার করেছেন। তাদের মধ্য হযরত শাহজালাল (র), শাহ পরান (র), হযরত বায়েজীদ বোস্তাম (র), হযরত খাজা মাইনুদ্দীন চিশতি (র), হযরত শাহ আলী বোগদাদী (র), হযরত খান জাহান আলী (র) অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচারক ছিলেন।
হযরত শাহজালাল (র):
বিশ্ববিখ্যাত সাধক হযরত শাহ জালাল (র) বাংলার একজন মহান ও বিশিষ্ট ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও আধ্যাত্মিক শক্তির বলে এই উপমহাদেশে ইসলামের ব্যপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে হযরত শাহজালাল (র) ৩৬০ জন আউলিয়াকে নিয়ে ইয়েমেন থেকে দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের সিলেটে আগমন করেন।
তখন সিলেটের রাজা ছিলেন গৌরগোবিন্দ। তিনি এত অত্যাচারী ছিলেন যে মুসলমানদের প্রকাশ্য আজান দিতে ও গরূ কোরবানী করতে দিতেন না। কোন ব্যক্তি গরূ কোরবানী দিলে তাকে হত্যা করা হতো। একদা পীর বোরহানুদ্দিন নাম জনৈক ব্যক্তি পুত্রের আকিকা করার জন্য গরূ কোরবানী দিলে রাজা গৌরগোবিন্দ পীর বোরহানুদ্দিনের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে এবং তার ডান হাত কেটে ফেলে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এ খবর পেয়ে হযরত শাহজালাল (র) অত্যণ্ত ব্যথিত হলেন।
তিনি রাজা গৌরগোবিন্দের রাজদরবারে সংগিদের নিয়ে রওনা হলেন কিন্তু কুচক্রি রাজা খবর পেয়ে হযরত শাহজালাল (র) যাতে রাজদরবারে আসতে না পারেন সেজন্য সকল প্রকার নৌ চলাচল বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আল্লাহর ওলীরা যে আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান সেকথা ঐ রাজা বিশ্বাস করতেন না।
আল্লাহর ওলী হযরত শাহজালাল (র) তার ৩৬০ জন সংগী নিয়ে রাজদরবারের দিকে রওনা হলেন কিন্তু নদী পারাপারের কোন ব্যবস্থা নেই দেখে নদীর পাড়ে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে রইলেন। আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে তিনি জায়নামাজে বসেই সুরমা নদী পার হয়ে গেলেন। রাজা গৌরগোবিন্দ এ মহান সাধকের আলৌকিক কারামত দেখে রাজদরবার ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
বিনা যুদ্ধে সিলেট জয় করে হযরত শাহজালাল (র) সেখানেই আস্তানা গড়ে তোলেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
হযরত বাবা আদম মক্কী (র):
প্রখ্যাত সাধক হযরত বাবা আদম মক্কী (র) তার প্রায় ৭ হাজার শিষ্য নিয়ে সুদুর মক্কা হতে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদুরে বিক্রমপূর এলাকাধীন রামপালের নিকটবর্তি আবদুল্লাহপুরে আস্তানা গড়ে তোলেন। তখন রামপালের রাজা ছিলেন বল্লাল সেন তিনিও সিলেটের রাজার মতোই অত্যাচারী ছিলেন। জনৈক ব্যক্তির গরু কোরবানীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাবা আদম এর সাথে রাজা বল্লাল সেনের যুদ্ধে বাবা আদম মক্কী (র) তার ৩০ জন সংগীসহ শাহদাৎ বরন করেন।
এদিকে রাজা বল্লাল সেনের সংবাদবাহক পায়রা মুক্তি পেয়ে রাজবাড়িতে উড়ে আসে। যুদ্ধে বল্লাল সেনের পরাজয় হয়েছে ভেবে রাজপরিবারের সকলেই আগুনে আত্মাহুতি দেয়। ফিরে এসে সকলের মৃত্যু হয়েছে দেখে নিজেও আগুনে ঝাপ দিয়ে প্রান বিসর্জন দেয়।
আল্লাহর ওলী বাবা আদমের রক্ত বৃথা গেলনা। তার আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে অনেক হিন্দু তার শিষ্যদের হাতে বাইয়েত হয়ে ইসলাম গ্রহন করেন।
এখনও বাবা আদম মক্কী (র) এর মাজারে বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ভক্ত আগমন করে থাকেন
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।