রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে তসলিমা নাসরিন তার লেখা এক উড়োচিঠিতে বলেছিল, “ আজ তোমার শ’য়ে শ’য়ে বন্ধু বেরুচ্ছে ,বুঝিনা সেদিন তারা কোথায় ছিল যখন তুমি পয়সার অভাবে এক খানা সিংগারা খেয়ে দুপুর কাটিয়েছ ” রুদ্রের প্রতি তসলিমার করুণাবোধ সেদিন আমকে স্পর্শ করতে পারে নি, তবে আজ ৪ এপ্রিল,11 তে এসে উপলব্ধি করতে পারছি অভাববোধ মানুষকে কত অসহায় অবস্থার মাঝে ফেলে দেয় । যেই আমি গতকাল অযথা কড়ি কড়ি টাকা উড়িয়েছি সেই আমিই এখন পয়সার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তও যেতে পারছি না । একা একা ঘরে বসে আছি আর সেই সাথে ডায়ে -রির ফাঁকা পৃষ্টগুলো ভরাট করার চেষ্টা করছি । ইতিমধ্যে ক্ষুধার তীব্রতা বেড়ে গিয়ে মাইনাস এ গিয়েছে ,তবুও খাবার কোন বন্দোবস্ত করতে পারছি না । একবার ভাবছি কারো কাছে চাইব,আরেকবার ভাবছি ও ঘর থেকে না বলেই কিছু খাবার নিয়ে আসব ।
কিন্তু কিছুই করতে পারছি না । কারন খুব সাধারণ । এই যেমন -না বলে কিছু নিয়ে আসলে সন্দেহ করবে, বুঝতে পারলে চোর ভাববে, বারাবারি করলে হইত তাড়িয়ে দিবে , আবার বলে কয়ে কিছু চাইতে গেলে নানান কথা গলা-দঃকরন করতে হবে , কিন্তু আমার পাকস্থলী এখন শুধুই খাবার চাচ্ছে কোন তীক্ষ্ণ কথা কিংবা সান্ত্বনার বাণী নয় । তাই কিছুই করা হল না । শুনেছি বহু মানুষ আছে যারা বিপদে পরেই হোক কিংবা অভাবের কারনেই হোক দু’দিন- চারদিন পর্যন্তও উপোষ করে ।
আমার অবশ্য তেমন কোন ভয় নেই । তবু পয়সার অভাবে যারা না খেতে পেয়ে বিনিদ্র রাত কাটায়, অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে, বাধ্য হয়ে বেছে নেয় অন্যায় এর পথ তাদের কথা বারবার মনে আসছে । কৃত্রিম একটা অভাব- বোধ আজ আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল কত কষ্টে দিন কাটায় পৃথিবীর বহু দেশের হাজারো দরিদ্র-অসহায়, রোগক্রান্থ মানুষ-গুলো । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মা নদীর মাঝি ” উপন্যাসের কয়েকটা লাইন আজ অনুভূতির একেবারে গভীরে দাগ কেটে দিয়ে গেল । ঘুরে ফিরে এই লাইনগুলোই সাঁতরে বেড়াচ্ছে আমার নিউরন সমুদ্র জুড়ে, “.............।
। ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না”
জেলেপাড়ার এই মানুষগুলোর অভাব অনুভূতি একেবারেই সাদামাটা, খুবই সাধারণ অথচ এদের মনেই অভাবের কুৎসিত ধ্বনি বজ্রের মতো হুংকার ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে ।
ক্ষণিকের এই কৃত্রিম অভাববোধ আমাকে জানিয়ে দিয়ে গেল দরিদ্র মানুষের দুঃখ-গাঁথা, চাওয়া কিংবা না পাওয়ার গল্প । কিন্তু আমারি কাছে যখন দরিদ্র কোন এক শিশু এসে হাত বাড়াবে একটু সাহায্যের জন্য তখন কি আমার হাত সাহায্যের হাত হবে নাকি অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিবে ঠিকানাবিহীন এই শিশুটিকে । তাও তো মুখ খুলে বলতে পারছি না।
যেমন করে চিরকালের সাথী সমুদ্রও আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না তারি বুকে বেঁচে থাকা মাঝিমাল্লাদের । তাইতো কবিও আক্ষেপ করে বলেছেন,
“ও মাঝিরে পরনে তোর ছেড়া কাপড় সাগর কি তা বুঝে, ঘরে তোর আহার নাইরে সাগর কি তা জানে ”
তাই আমারও ভয় হয়, কেননা আমিতো সেই সব বিবেকহীন মানুষদেরই দলে যারা মিথ্যা বলে- মিথ্যা বলায় । যেমন করে সেদিন এক বৃদ্ধকে মিথ্যা বলে কেটে পরেছি । অথচ তেমন কিছুই চায়নি । ইস্ট লন্ডন মসজিদের সামনে এসে যখনই দাঁড়ালাম তখনি এক বৃদ্ধ বয়সের লোক এসে লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল, “বাসা থেকে বের করে দিয়েছে, খেতে দেয় না, পয়সাও দেয় না ।
দয়াকরে যদি কিছু টাকা দিতেন তাহলে দোকান থেকে রুটি কিনে খেতাম, খুব ক্ষুধা পেয়েছে । ” আমি খুব সাধারনভাবেই না সূচক বাক্য উচ্চারণ করলাম, “sorry” .রাস্তা পার হয়ে যখনি ওপারে গেলাম তখনি মনে হল আমিতো তাকে কিছু টাকা দিলেও পারতাম । কত টাকাইতো অকারণে খরচ করা হয় । মনের মধ্যে বিবিকের একটা ঝড় বয়ে গেল। আমি সামলে উঠতে না পেরে দৌড়ে গেলাম লোকটাকে কিছু টাকা দিয়ে আসতে ।
কিন্তু গিয়ে দেখি লোকটি আর সেখানে নেই । হয়ত অন্য কারো কাছে হাত পেতেছে কিংবা সমস্ত ক্ষুধা –ব্যথা বুকে নিয়ে নীরবে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে, নিভৃতে লোনা জল গড়িয়ে পরছে তার দুঃখ ভরা দুটি চোখ দিয়ে ...। আর তার চোখের জল অভিশাপ হয়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটির গর্ভে, অনুগত দাসের মতো সেই জল বয়ে নিয়ে চলছে আমাদের পৃথিবী । যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা হাসি-হাসাই, কাঁদি-কাঁদাই, স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন ভাঙ্গি , সৃষ্টি করি আবার ধ্বংস করি ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।