টানটান চাপা চাপা উত্তেজনার মধ্য দিয়ে, শত সহস্র বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, নিন্দুকদের হাজারো আপত্তিকে পাশ কাটিয়ে আবার আমাদের মাঝে লোডশেডিং বীরদর্পে হাজির হয়েছে তার আপন মহিমায় তার স্বভাবজাত আলো আঁধারীর শৈল্পিক বৈশিষ্ট নিয়ে। কবির ভাষায় বলতে হয়,
”এসেছে লোডশেডিং,
তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান”
আবার এদিকে মন্দ লোকেরা চরম বিরক্তি নিয়ে বলছেন, ”ধ্যাত্তোরী, আবার আইলো লোডশেডিং। ” আরি ভায়া, এ কথা বলার আগে আপনি দেশের ভাবমূর্তির কথা একবারও চিন্তা করলেন না?
অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে লোডশেডিংয়ের মত একজন মহামান্যকে স্বাগত জানানোর এতটুকু মানসিকতা যদি আমাদের না থাকে তাহলে আমাদের মান সম্মান নামতে নামতে সেফটি ট্যাংকের তলায় চলে যাবে সে খেয়াল রাখেন আপনারা? অথচ বিশ্বকাপের সময় এই আপনারাই বিদেশীদের স্বাগত জানানোর জন্য কি না করেছেন। আপনাদের কারণেই লোডশেডিংয়ের মত সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তির একটি খাঁটি জিনিস চরমভাবে অবহেলিত। লোডশেডিং স্বার্থহীনভাবে আমাদের যে কত উপকার করছে তা আমরা বুঝেও না বুঝার ভান করি।
অথচ সেতো বিনিময়ে বেশি কিছু চায় না, এই একটু আশা-ভালবাসা। আমরাতো তাকে তা দেই না বরং আমাদের মুখভরা গালি তার নিত্যদিনের সঙ্গী। মানুষ হিসেবে এ আমাদের জন্য এক লজ্জাজনক পৃষ্ঠা, জাতি হিসেবে এ এক কলঙ্কময় অধ্যায়।
আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুনতো লোডশেডিং কি আমাদের জন্য নিম্নবর্নিত উপকারগুলো করেনা?
১. অপচয়ের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে।
ব্যাখ্যা: জাতি হিসেবে এমনিতেই আমরা চরম বেহিসাবী।
বাথরুমে ট্যাপের পানি পড়তে পড়তে নদী বয়ে গেলেও নাহি কোনো খবর। টিভি দেখতে দেখতে আমরা ঘুমিয়ে যাই, পিসি টাকে সুবিধার জন্য স্ট্যান্ডবাই মুডে রেখে চলে যাই। সূর্যের আলো ঘরে এসে আবার ফিরে যায় কিন্তু বাতি নিভেনাই। তাই অপব্যয়ী হিসেবেও আমাদের তুলনা নাই। এই অপচয় রোধ করার জন্য জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে লোডশেডিং আমাদের হয়ে আমাদের সকল দায়িত্ব তার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
তাইতো সে এলেই সবকিছু অফ করে দেয়। অপচয় হওয়ারতো চান্সই নাই।
২. যান্ত্রিক কোলাহল থেকে দূরে রেখে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে আসে।
ব্যাখ্যা: আরে ভাই, আপনারাইতো কিছুদিন পরপর কাজের চাপে পিস্ট হওয়ার পর এই শহরের যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিস্তর টাকাপয়সা খরচ করে শহর থেকে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসতে চান। যে কাজের জন্য আপনি এত কাঠ খড় পোড়ান সেই কাজটি লোডশেডিং আপনাকে অসংখ্যবার করে
দিয়ে যায় এক্কেবারে ফ্রি অফ কস্ট।
কারণ সে আসামাত্রই আপনার ঘরের লাইট, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজ সকল যন্ত্রের বিশ্রাম পর্ব শুরু। আর যন্ত্রের বিশ্রাম মানেই আপনি যান্ত্রিকতার কোলাহল থেকে মুক্ত। শুধু তাই নয় লোডশেডিং যখন আসে বিশেষ করে রাতের বেলা তখন নিশ্চয় চরম গরমে আপনি চলে যান ছাদে। হৃদয় জুড়ানো হীমশীতল দখিনা বাতাস আপনার দেহমন জুড়িয়ে দেয়। তার মানে কিন্তু আপনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে এলেন।
আর তখন আপনার সাথে যদি থাকে আপনার প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমা তাহলে এর চেয়ে মধুর রোমান্টিক পরিবেশ আর কি হতে পারে? তাহলে বুঝা গেল লোডশেডিং আপনাকে যান্ত্রিক কোলাহল থেকে দূরে রাখার
পাশাপাশি প্রকৃতির সান্নিধ্যেও নিয়ে আসে।
৩. চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ব্যাখ্যা: আমরা বাঙ্গালীরা নাকি চিন্তা করি কম। কাজ করি তার চাইতেও কম। চিন্তা করুনতো (আবার চিন্তা!) কত বড় অপবাদ।
কারা চিন্তা করে আর কারা করে না তা তাদের মাথা দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের দেশে টাকমাথার যে প্রাচুর্য এবং সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তো এ হার প্রত্যাশার চাইতেও বেশী, তাতে বলা যায় এ অপবাদ বিরোধী
দলের গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। আর কাজ করে কে কবে হাতিঘোড়া হয়েছে। এ মহাবিশ্ব, ঝকঝকে তকতকে আধুনিক পৃথিবী, এত এত আবিষ্কার সবইতো গভীর চিন্তার ফসল। যাই হোক আপনি যদি আরো অধিক এবং কার্যকরী চিন্তাশীল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চান তাহলে লোডশেডিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।
সারাদিন কাজ শেষে বাসায় এসে
আপনি যখন চেয়ার, ছোফা, খাট, পালং বা টুলে এসে বসেন সাথে সাথে অনুগত ভৃত্যের ন্যায় লোডশেডিং বিদ্যুৎগতিতে এসে হাজির হয় আপনার কাছে। নিউটনের বিপরীত প্রতিক্রিয়া সূত্রানুযায়ী তৎক্ষনাৎ লাইটের আলো বিদায় নেবে আপনার কাছ থেকে। এখন আপনার চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ আপনি অনুভব করবেন ”মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব”
নিয়ে কি জোরালো চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে আপনার মষ্তিষ্কে। আলোহীন বাতির কল্যানে হাতে যেহেতু কোনো কাজ নেই মাথা দিয়ে শুরু করে দিতে পারেন ”একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে জলসেচ দেওয়ার কাজে আপনার ভূমিকা” অথবা ”দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ কতটুকু যুক্তিযুক্ত” টাইপের জটিল চিন্তাভাবনা।
ক্রমেই আপনি হয়ে উঠবেন একজন তুখোড় চিন্তাশীল।
৪. কষ্টসহিষ্ণু মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে।
ব্যাখ্যা: আপনার সম্মন্ধে আমি কিছু অনুমান করছি. মিলিয়ে দেখুনতো। যখন লোডশেডিং আসে তখন আপনি প্রচন্ড গরমে দরদর করে ঘামেন। গরমের হাত থেকে বাচতে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হাত ব্যাথা করে ফেলেন।
বৈদ্যুতিক আলোর বিকল্প হিসেবে মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় পড়ালেখার বৃথা চেষ্টার ফলস্বরুপ চক্ষু ব্যাথা। তারপর ’ধুর শালা’
বলে জ্বলন্ত মোমবাতিটি হাতে নিয়ে উঠতে গেলে গলিত মোম আপনার হাতে পড়তেই আপনার বেদনাময় চিৎকার। এইযে আপনি এত ব্যাথা, এত কষ্ট নিয়ে বেড়ে উঠছেন তারপরও কিন্তু আপনি বেচে আছেন। তার মানে আপনি যথেষ্ট পরিমানে কষ্ট সহিষ্ণুতা অর্জন করেছেন এবং আজও করছেন। আশা করা যায় লোডশেডিং প্রদত্ত কষ্টসহিষ্ণুতার এই প্রশিক্ষন আপনি
আপনার বৈবাহিক জীবনে আপনার জালিম (যদি হয়) স্ত্রীর শত অত্যাচারের মাঝেও কাজে লাগবে।
লোডশেডিংয়ের এই অবদান আপনি কিভাবে অস্বীকার করবেন?
৫. আর মাসশেষে বিদ্যুৎবিলের পরিমানতো লোডশেডিংয়ের কল্যাণে কমই হওয়া কথা। অবশ্য ভূতুড়ে বিলের ক্ষেত্রে আমার এই থেরাপি একেবারেই অকার্যকর।
এই কথা সেই কথা কত কথাইতো হল। কিন্তু শেষ কথা হল শেষ পর্যন্ত কেউই বেচে থাকেনা। এই নশ্বর পৃথিবী থেকে একদিন হয়ত লোডশেডিংও চিরতরে চলে যাবে।
অলরেডি সে ঘোষনা উপর থেকে চলেও এসেছে। আমাদের পিডিবি এর হর্তাকর্তারা বলেছেন ২০১৩ সাল নাগাদ আমাদের দেশ থেকে লোডশেডিংকে সম্পূর্ণরুপে উৎখাত করা হবে। ফলে লোডশেডিং ক্রমেই নিশ্চিৎ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এইযে লোডশেডিং আমাদের জন্য এতকিছু করল, বিনিময়ে সে কি পেল? কিছুই না, বরং সারাটা জীবন সে অন্ধকারে কাটিয়ে দিল। আসুন এই মৃত্যুপথযাত্রী (যদিও তার কর্মতৎপরতা ব্যপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে) তার সারাটা জীবন যেভাবে আমাদের সেবা করেছে এবং আশা করি ২০১৩ সাল পর্যন্ত করতে থাকবে তা আমরা স্বীকার না করলেও
অন্তত অস্বীকার যেন না করি।
আমাদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে লোডশেডিংয়ের যে অবদান তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকুক স্বর্ণাক্ষরে। মনে রাখবেন যে নিঃস্বার্থভাবে.................(ধূর শালার কারেন্ট আবার গেল গা। কিছুইতো দেখিনা লেখমু কেমনে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।