প্রাপ্তি
এ.এন.এম.শফিকুল
গোপালপুর গ্রামের কোন বাড়ির চাল দিয়ে জ্যোৎস্না দেখা যায় সেটা আমার বাড়ি। বাবার দেয়া আমার একটা নাম ছিল। আমি নিজেও নামটা ভুলে যাই। হঠাৎ হঠাৎ দগদগে ঘা এর মত নামটা মস্তিষ্কে হানা দেয়। গ্রামের সবাই আমাকে খরচা বিবি বলে ডাকে।
খরচা নামটার সার্থকতা হল আমি নাকি খরচ হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট লাগত। নিজের উপর ঘেন্না লাগত। মনে হত আত্মহত্যা করি। কিন্তু একটি মানুষের জন্য পারিনি।
এই মানুষটা ছায়ার মত আমাকে সব সময় ঘিরে থাকে। যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন কোন খবর আসত,আমি সজাগ হয়ে থাকতাম। যদি আমার স্বামীর কোন খবর পাওয়া যায়। মকবুল চাচা মাঝে মাঝে খবর নিয়ে আসতেন
-বেটি তোর স্বামী একাই সাতটা হানাদার মারছে। দোয়া-দুরদ পড়।
তোর বিয়ার সময় ওর চোখ দেখেই বুঝবার পারছিলাম ছেইলেডার ভিতরে কিছু একটা আছে।
আমিও বুঝতে পেরেছিলাম,যখন বাসর রাতে আমার হাত ধরে বলেছিল-বালা বাইরে চাঁদেও আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে,সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। আল্লাহ আমাকে বিশেষ কিছু দিতে চাইলে তখন এরকম পরিবেশ তৈরি করেন। চল জ্যোৎস্না-জলে ভিজে আসি।
আমার বলতে ইচ্ছে করল আজকের এই পরিবেশ আমার জন্য বিশেষ উপহারটা আপনি নিজেই। সেই বিশেষ কিছুকে খুব বেশী দিন কাছে রাখতে পারলাম না। দেশ আমাকে এবং তাকে দাড় করিয়ে দিল ভিন্ন দুই যুদ্ধক্ষেত্রে। আমাদের গ্রামে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করল। গ্রামের শ্রেষ্ঠ রাজাকার আমাকে পশুগুলোর কাছে তুলে দিল মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হওয়ার অপরাধে।
আমার বাবাকে হত্যা করা হল খুচিয়ে খুচিয়ে আমারই চোখের সামনে। মৃত্যুর মূহুর্তে বাবা চিৎকার করে বলতে লাগলেন-আমাদের বীর যোদ্ধারা তোদের হত্যা করবে। তোদের প্রবাহিত পাপিষ্ঠ রক্তে আমাদের মাটির শাপমুক্তি ঘটবে।
ভয়ঙ্কর অভিশাপ্ত জীবন শুরু হল আমার। যৌনতার হিংস্রতায় আমি ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলাম বারংবার।
সিগারেটের ছ্যকা আর নখের আঁচড়ে সারা শরীরে ঘা হয়ে গেল আমার। রক্তবমি হতে শুরু করল। প্রথম প্রথম আমি পশুগুলোর পা জড়িয়ে চিৎকার করতাম। বলতাম-আমাকে মেরে ফেল কুত্তার বাচ্চার দল। তখন নির্যাতন বেড়ে যেত।
আমার হাত বুটের নিচে ফেলে রক্তাক্ত করা হত। একদিন অশরীর ছায়ার মত তিনি আসলেন। আমাকে বললেনÑমুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসাবে কাপুরুষদের কাছে আমাকে,দেশকে কেন শুধু ছোট করছ। আমি দেশের জন্য মরেছি একবার,তুমি মরছ বারবার। দেশের জন্য তোমার অবদান আমার চেয়ে অনেক বেশী।
আমি অনুরোধ করা বন্ধ করে দিলাম। অন্ধকার কুঠরী ঘরে দিন রাতের কোন হিসাব থাকে না। সময়ের হিসাব বাদ দিয়ে আমি মৃত্যুর হিসাব শুরু করলাম। নিজের প্রতিদিনের মৃত্যুর হিসাব রাখতাম শরীরের ঘা এর রক্ত দিয়ে। কুঠরীর দেয়ালে প্রতিবারের মৃত্যুর জন্য একটি করে দাগ দিতাম।
দাগে দাগে ভরে উঠল সব দেয়াল। একটা সময় ক্ষুধা আর শারীরিক নির্যাতনে আমার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পড়ল। আমার মৃত্যুর হিসাব রাখা বন্ধ হয়ে গেল। সজ্ঞাহীন অবস্থায় কেটে গেল দীর্ঘ সময়। আমি যখন সুস্থ জীবনে ফিরে এলাম তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
ততদিনে আমি অন্তস্বত্তা হয়ে গেছি। সবাই চাইল পাপটাকে শেষ করে দিতে। কিন্তু আমি চাইলাম উল্টোটা। আমার অজস্র মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষীকে আমি আলোর মুখ দেখালাম। ছেলেটার নাম রাখলাম স্বাক্ষর।
আমার মৃত্যুর উপর জীবনের প্রথম স্বাক্ষর। মানুষের হাজার প্রশ্নের হাত থেকে রক্ষা করতে সৃষ্টিকর্তা তাকে বোবা হিসাবে পাঠালেন। তার না বলা কথা আমি বুঝতে পারতাম। গত বিশ বছর আগে এক স্বাধীনতা দিবসে অভিমানী ছেলেটি আমাকে একা রেখে চলে গেল। আমি আজও তার অপেক্ষায় আছি।
সেদিনের রাজাকার বর্তমানে দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের লোক। স্বাধীনতার উনচল্লিশ বছরে তার প্রাপ্তি অনেক কিন্তু আমার প্রাপ্তি প্রতি বিজয় দিবসে একটা করে সাদা শাড়ী। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে সারা ঘর। আমি অনুভব করতে পারছি বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষায় আছি একটি মূহুর্তের।
যেই মূহুর্তে স্বাক্ষরকে সৃষ্টিকর্তা কথা বলার সুযোগ দিবেন। স্বাক্ষর আমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলবে-‘‘মাগো,এস বাইরে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখি। ”
বাইরে থেকে কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। শরীরটা অসম্ভব খারাপ লাগছে। প্রাণপন চেষ্টা করছি বিছানা থেকে নামতে কিন্তু মরণ ঘুম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।