আমি ছিলাম বাসার সবথেকে ছোট। আপু-ভাইয়াদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মিয়-সজন যেই আসুক না কেন আমাকেই দেখতে হত কে আসল, কাকে চাচ্ছেন, আপনার নামকি, কি দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। যার ফলে ওদের সবার বন্ধুদের আমার চেনা হয়ে যেত।
১৯৯০ সালে আমার বড় ভাই জুনিয়র স্কুল থেকে ক্লাস নাইনে যশোর শাহীন কলেজে ভর্তি হল। এখানে অনেক নতুন নতুন বন্ধু হল ওর।
কেউ কেউ মাঝে মাঝে বাসায় আসত, সবাইকেই নামে চিনতাম আমি। তার মধ্যে মনি ভাইই সবথেকে ঘনিষ্ঠ ছিল। ভাইয়ার খোজে প্রায়ই বাসায় আসত। আমাদের বাসাটা মেইন গেট থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে। ওনার অভ্যাস ছিল, গেটের কাছ থেকেই জোরে জোরে আমার ভাইয়ের নাম ধরে পলাশ, পলাশ করে ডাকতো।
আমার অন্য ভাইদের সাথেও উনার খাতির ছিল। মাঝে মাঝে ওদের সাথে ক্যারাম, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলত, সন্ধার পর ওদের সাথে একসাথে চা নাস্তা খেয়ে চলে যেত।
ভাইয়া এস এস সির পরে ঢাকায় চলে গেল। মনি ভাই শাহীনেই থেকে গেলেন। ঈদ- পার্বনের ছুটিতে ভাইয়া বাসাতে আসলেই হয়, উনিও ভাইয়ার খোজে ঠিকই চলে আসতেন আমাদের বাসায়।
মনি ভাই ছিলেন বাসার বড় ছেলে। উনার বাবা অবসরে চলে যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে এইস এস সির পরই আর্মিতে যোগ দেন। সেই থেকেই সংসারের দ্বায়িত্ব পুরোপুরি উনার কাধে, উনিই একমাত্র আয়ের উৎস। ছোট ভাইটাকে লেখা পড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা, আর্থিক দিকটা কিভাবে আরো গতিশীল করা যায়, সেই সাথে নিজেকে আরো প্রতিষ্ঠিত করা এসব নিয়ে উনি খুব ভাবতেন। আর্মিদের কত কঠোর নিয়ম-শৃংখলা, ভয়ানক কঠিন কঠিন আর্মি ট্রেনিং, সেই ট্রেনিংগুলা কিভাবে উনি সাফল্যের সাথে পাস করছেন, উনার প্রমোশন, চাকরি লাইফ সব কিছু ভাইয়ার কাছে এসে শেয়ার করতেন।
চাকরির প্রতি উনি যেমন নিবেদিত ছিলেন, তেমন প্রমোশন ও পেয়েছিলেন খুব দ্রুত।
২০০৩ সালে, তারিখটা ঠিক মনে নাই, সন্ধার দিকে মনি ভাই উনার বিয়ের কার্ড হাতে হাজির। ভাইয়া তখন দেশের বাইরে, তাই মা কেই খুব করে উনার বিয়েতে যেতে বলল, আর মার কাছে দোয়া নিয়ে গেলেন।
এর পরের ঈদে মনি ভাই আমাদের বাসায় ভাবিকে নিয়ে বেড়াতে আসলেন। ভাবি দেখতে অনেক সুন্দরী, লম্বায় প্রায় পাচ ফিট-ছয়, ফর্সা- স্লিম, ইন্ডিয়ান নায়িকা ফেল।
কথাও বলেন খুব সুন্দর করে। একদম পারফেক্ট আর্মির বউ বলতে যা বোঝায় আর কি।
এরপর, প্রায় সব ঈদেই যশোরে ঈদ করলেই আমাদের বাসায় ভাবিকে নিয়ে আসতেন। সন্ধাতে আসতেন, খেয়ে-দেয়ে গ্লপগুজব করে টরে যেতে যেতে অনেক রাত করে ফেলতেন। মার হাতের রান্না উনার খুব প্রিয় ছিল, কোন ভনিতা না করে সবগুলা আইটেমই চেখে দেখতেন।
মনি ভাই ফোনে প্রায়ই মার কাছে ভাইয়ার কথা জিজ্ঞাস করত,"পলাশের পড়া শেষ হতে আর কত দিন বাকি, দেশে কবে আসবে, এই সব। উনার বিয়েতে ভাইয়া থাকতে পারেনি বলে উনার সেকি আফসোস। কাকতালিও ভাবে মনি ভায়ের মেয়েটার নাম আমার ভাইয়ের মেয়ের নামের সাথে মিলে ছিল "সোহা"।
যে মনি ভায়ের কথা বলছি উনার আরেক নাম আসাদুজ্জামান। বন্ধুরা সবাই উনাকে মনি নানেই চিনত।
উনি ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস হত্যাযোগ্যে নিহত ৫৭ জন আর্মি অফিসারের মধ্যে একজন। একমাত্র মেয়েটা এদিন এতিম হয়েছে, বউটা হয়েছে বিধবা।
মনি ভাই ছিলেন অন্যতম মেধাবি অফিসার। আগেই বলেছিলাম,চাকরির প্রতি উনি যেমন নিবেদিত ছিলেন, তেমন প্রমোশন ও পেয়েছিলেন খুব দ্রুত। ক্যাপ্টেন হলেন, জাতিসংঘ মিশনে বিদেশে ছিলেন দেড় বছর, তার পর এসে যোগ দিলেন রেব এ।
বিডিয়ারে যোগ দিয়েছিলেন খুব বেশিদিন হয় নি, সেসময় মনি ভাই চিটাগং এ ছিলেন। বিডিয়ার সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন। তারপরের ঘটনা সবাই জানে।
শুধু কেউ জানেনা মৃত্যুর আগে তার শেষ চাওয়াটা কি ছিল, কেমন অসহায়- মর্মান্তিক ছিল মৃত্যুর আগের সেই মুহূর্তগুলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।