আপন মানুষটির বিভৎস লাশ দেখার পর কান্নায় ভেঙে পড়া এই পরিবারকে সান্তনা দেবার ভাষা আমার নেই।
১৯৭১ সাল। ২৫শে মার্চ ঢাকায় হলো ক্র্যাক ডাউন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- ঢাকার পিলখানায় চলল হত্যাযজ্ঞ। তারপর মানুষের ঘরে ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হলো।
কাটলো নয় নয়টি মাস। যুদ্ধ-রক্ত দিয়ে শেষ হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমরা পরিণত হলাম স্বাধীন জাতিতে। তবে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার দুইদিন আগেই ভেঙে দেয়া হলো এ জাতির মেরুদন্ড। যারা এ দেশটাকে গড়ার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারতো সেই মানুষগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করে দেয়া হয় গণকবর কিংবা ফেলে দেয়া হয় কোনো ডোবা নালায়।
বিভৎস এই হত্যাকান্ডকে আমরা নিন্দা জানাই আজও।
স্বাধীনতার ৩৮ বছরে পা দেবো আর একমাস পরেই। ঠিক সেই মুহূর্তে; স্বাধীনতা দিবসের ঠিক একমাস পিছিয়ে এসে ২৫শে ফেব্র“য়ারী ঢাকার পিলখানায় ঘটে গেলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে জঘন্যতম একটি অধ্যায়। সকলের নিশ্চয় ঘটনাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটা তো ঠিক, ইতিহাসে এই দিনটি থাকবে কলঙ্ক হয়েই।
টিভির পর্দায় স্বজনদের আহাজারি, ছোটছোট বাচ্চাগুলোর আর্তনাদ আমার চোখকে করেছে সিক্ত। শুধু আমার কেনো! সারা জাতি আজ শোকে কাতর।
কি এমন হলো! যে বিডিআর জওয়ানেরা সেদিন বিদ্রোহ করলো! হঠাৎ করে কেনই বা তারা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে উঠলো! এতো প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। আমি শুধু জানি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ রাইফেলস গঠিত হয়েছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দিয়ে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা এই দুইটি বাহিনীর হয়ে আমাদের রক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত।
একজন সিমান্তের অতন্ত্র প্রহরী অন্যজন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রহরী। দেশের সংকটে সর্বপ্রথমে আমরা বলি, আর্মি কিংবা বিডিআরদের কথা। আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে রাতে ঘুমাতে পারি কারণ তখন বিডিআর আমাদের সিমান্তে নির্ঘুম রাত কাটায়। আমরা নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলতে পারি কারণ আমাদের আর্মি সর্বক্ষণ কুচক্রদের দিকে নজরদারি করছে। যেই সেনাবাহিনী এবং বিডিআর আমাদের রক্ষা করায় প্রস্তুত থাকে সেই দুটি বাহিনী যেনো আজ প্রতিপক্ষ।
সেনাবাহিনীর উপর যেনো বিষাক্ত সাপের মতো তারা ছোবল মারলো। প্রতিপক্ষ হয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর। তাদের জমে থাকা ক্ষোভ নাকি তারা প্রকাশ করেছে। কিন্তু ক্ষোভের ভাষা যদি হত্যা, ক্ষোভের ভাষা যদি নিজ ভাইয়ের বুকে গুলি, ক্ষোভের ভাষা যদি হয় নিজ মায়ের বুক খালি করে দেয়া তবে এ ভাষাকে ক্ষোভ বলা যায় না। এ ভাষা নির্মমতার ভাষা।
নিজ ভাইয়ের রক্তে আজ তারা পিলখানাকে করেছে রক্তাক্ত। বাংলাদেশের সবচাইতে নিরাপদ জায়গার একটিকে আজ তারা করে তুলেছে সবচাইতে অনিরাপদ জায়গা। এর পেছনে কোনো কালো ছায়ার হাত স্পষ্ট। ভায়ের বিরুদ্ধে ভাই তখনই ক্ষুব্ধ হয় যখন পেছন থেকে কেউ ইন্ধন যোগায়। পেছনের ইন্ধনে এবং হঠাৎ কুকুরের মতো লেলিয়ে দেয়ার পেছনে ছিল অত্যন্ত শক্ত কোনো মহল।
তা নিশ্চই বের হয়ে আসবে শীঘ্রই।
সব কিছু হলো। বিদ্রোহকে ঠান্ডা করা হলো। কিন্তু ভেতরে যে লাশের বন্যা হয়ে গেছে। একের পর এক আর্মি অফিসারের লাশ উদ্ধার হচ্ছে, গণকবর থেকে কিংবা ড্রেনে।
এ যেনো সেই হানাদারদের প্রতিচ্ছবি। একটি বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতেই যেনো এই বর্বরতা। কতটা নৃশংস হলে ড্রেনে একটি লাশ ফেলে দিতে পারে! কতটা নৃশংস হলে একটি মৃতদেহকে গায়েব করার জন্য পুড়িয়ে দিতে পারে! এক’শর কাছাকাছি আর্মি অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে। এই প্রতিটি অফিসার দেশের সবচাইতে মেধাবী এবং সাহসী সন্তান। তারা দেশকে আরও কিছু দিতে পারতো।
কিন্তু তাদের থমকে দেয়া হলো। জাতির ভবিষ্যত পথ চলাকে আবার আঘাত করা হলো। ঠিক যেনো সেই হানাদার বাহিনীর পায়তারা। দেশের দোসরদের সহযোগিতায় তারা হত্যা করেছিল দেশের গড়ার কারিগরদের। আজ তারা হয়ত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করলো দেশ রক্ষা করার কারিগরদের।
এ ক্ষতি পূরণীয় নয়। এ ক্ষতি ৭১-এও মেনে নেয়া যায় নি। তাও সান্তনা দেয়া গেছে এই বলে, যারা মেরেছে তারা অন্য দেশের লোক! কিন্তু এবার আর ভাষা খুজে পেলাম না। কোনো সান্তনা আর পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি আমাকে কোনো সান্তনা দিতে পারছে না।
আমি নির্বাক-হতবাক। একটি বাহিনীর চিফকেও তারা মেরে ফেলতে ভয় পায়নি তাদের হাত কাপেনি। কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল তারা। মুক্তিযুদ্ধের হানাদার বাহিনীর বর্বরতার গল্প আমাদের নতুন প্রজন্মকে বলা হলে আমরা কল্পনা দিয়ে তা ভেবে নিতাম। শুধু আমরা কেনো যারা সেদিন সেই বর্বরতা দেখে নি তারাও কল্পনা দিয়েই কিংবা ভিডিও ফুটেজ দেখে তা অনুভব করে।
কিন্তু বাস্তবতায় তা জানতো না কেউই। কিন্তু আজ আর হানাদার বাহিনীর গল্প বলার দরকার নেই। তাদের বর্বরতার উদাহরণ তৈরী হয়ে গেছে নিজ দেশেই। ২৫শে ফেব্র“য়ারী রচিত হলো একই বর্বরতার ঘটনা। ভিন্নতা হচ্ছে, তখন ছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর এখন আমার দেশের নিজ বাহিনী।
বড্ড লজ্জা হচ্ছে। বড্ড লজ্জা। যারাই এই জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত ছিল তারা তাদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবেন কি করে! কোন মুখে তারা পাকিস্তানীদের খারাপ বলবে। তারাই তো সেই পৈশাচিক বাহিনীর প্রতিচ্ছবি।
টিভির পর্দায় যা দেখছি তা শুধুই আমাকে ভাবাচ্ছে।
একটি সিস্টেমকে দাঁড় করাতে অনেক সাধনার দরকার হয়। আজ জাতির শ্রেষ্ট সন্তান দিয়ে দাঁড় করানো সেই সিস্টেম পুরোপুরি ভেঙে গেছে। বিডিআরকে এখন শূণ্য থেকে আবার দাড় করাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমার কথা বললেও এখন বলেছেন, যারা হত্যা এবং লুটপাটের সাথে জড়িত ছিল তাদের কোনো ক্রমেই ক্ষমা করা হবে না। অবশ্যই ক্ষমা করা উচিত নয়।
তবে যারা জড়িত নয় তাদের যাতে কোনো হয়রানি না হয় সেদিকে সরকারকে কোঠর নজর দিতে হবে। কারণ, অতীতে আমরা দেখেছি, আসামি হাত থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু অযথা হয়রানির স্বীকার হয় সরল মানুষগুলো। এবার যেনো আর তা না হয়।
অনেক জল্পনা, অনেক নাটকীয়তা শেষে বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু নিহত পরিবারগুলোর আর্তনাদের কোনো সমাপ্তি হবে না।
বাবা আর তার সন্তানের কাছে ফিরবে না। বাবা হারানো বেদনা সেই সন্তানের থেকেই যাবে। মা হারানোর বেদনার কোনো সমাপ্তি কখনই হবে না। বেদনা সারাটা জীবন তারা বয়ে বেড়াবে। এই দিনগুলোর বিভৎসতা প্রতি বছর হয়তো এই দিনটি আসলেই আমরা স্বরণ করবো কিন্তু নিহত সদস্যদের পরিবারগুলো প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত তারা এই ক্ষত বয়ে বেড়াবে।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস এর দুজন বীরশ্রেষ্ঠ আছেন। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ এবং বীরশ্রেষ্ঠ নূর মুহাম্মদ। এই দুই বীরশ্রেষ্ঠ জাতির গৌরব। যেই বাহিনীর হয়ে তারা নিজের প্রাণ তার দেশের জন্য বিলীয়ে দিয়েছিলেন সেই বাহিনীর এই বর্বরতায় নিশ্চয় আজ তারা লজ্জায় কাতর হয়ে উঠেছেন। অন্ধকার জগতে যেনো তারা চোখের জলে ভাসাচ্ছেন।
হয়তো তারাও বলছেন, নিজ ভাইয়ের বুকে গুলি করার জন্য তো যুদ্ধ করেনি। এই জন্যই তো প্রাণ দেইনি। সেই হানাদারদের প্রতিচ্ছবি দেখার জন্যতো মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দেইনি।
--------------------------------------------------------------------------------
আমরা বিদ্রোহের নামে, দাবি আদায়ের নামে এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানাই। সেই সাথে সমবেদনা জানাই নিহতদের পরিবারদের প্রতি।
সরকার তিনদিনের শোকদিবস ঘোষনা করেছেন। সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ। জাতির সন্তানরা এই প্রাপ্তিটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য ছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।