আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাঁকি

ভালোকে আমার ভয়,ভালো বেশীদিন থাকবেনা... মন্দকে আমার ভয়, কেননা আমি দুর্বল, আঘাত সইতে পারবোনা... সাফল্যকে আমার ভয়, ব্যর্থতাকেও ভয়... নিরন্তর ব্যস্ততার মহাকালে আমার করণীয় কিছুই নেই... যোগ্যের পৃথিবীতে আমি অযোগ্য, অধম...
খালি পায়ের তলে নরম একটা কিছু পড়ে। ফজলু মিয়া চমকে উঠে। একটা আম। টকটকে হলুদ একটা পাশ। হাতে নিয়ে পুরোটা আম দেখতে ইচ্ছে করে তার।

হাটের দিন, প্রচুর মানুষজন আজ বাজারে। তুলে নেবে নাকি! কেউ যদি দেখে ফেলে! এদিক ওদিক দেখে নিয়ে চট করে আমটা তুলে নেয় সে। ওপাশটা কালো কুচকুচে, ময়লা কালো। বিশ্রী রকমের একটা পোকার বাসা। ফজলু মিয়ার কাছে এই আমটা পৃথিবীর ক্ষুদ্র সংস্করণ! সারাজীবন একই কাজ করেছে।

একবার রহিমার জন্যে শাড়ি কিনতে গিয়ে ভাঁজ খুলে উল্টো পাশটা দেখেছিল বলে দোকানদার কতগুলো কথাই না শোনালো। কলমের খোলস খুলে ভেতরের কালিভরা শীষটি দেখবে, চা খাওয়ার আগে কাপটা মাথা পর্যন্ত তুলে নিয়ে কাপের তলা দেখবে। সোজা পিঠের উল্টো পিঠ ঘেঁটে দেখতে দেখতে জীবন পার। ওদিকে তার ক্লাস এইট ফেল করা বন্ধু হানিফের বিল্ডিঙটার দিকে তাকালে নিকে জোকার লাগে। হাহ! ম্যাট্রিক পাশ ফজলু মিয়া! মিষ্টি স্বাদের আমটা মুখে অমৃতের মতো লাগছে।

পোকার পাশটা না দেখার ভান করে খেয়ে চলেছে সে। খেতে একদম ঘেন্না লাগছেনা। লাগবেই বা কেন? ঘেন্না লাগার আছেটা কি এখানে? অফিসের বড় স্যার যখন ফজলুকে দিয়ে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতাল পাঠালেন, তখন স্যার অফিসেই ছিলেন। অথচ তাকে বলা হয়েছিল কেউ আসলে যেন বলে স্যার নেই। ঘেন্না লেগেছিল।

অ্যাকাউন্টস এর সোনিয়া আপা যখন রাত ১ টায় চঞ্চল পায়ে স্যার এর রুমে ঢুকে তার দিকে মিষ্টি মিষ্টি হেসে দরজা বন্ধ করে দিতেন, ফজলুর ঘেন্না হয়েছিল। হানিফের কাছে একটু একটু করে করে জমিয়ে রাখা টাকার কথা বন্ধু হয়েও যখন সে বেমালুম ভুলে গেলো, ঘেন্না হয়েছিল, একবার, দুইবার, অনেকবার। ফজলুর সন্দেহ হয়। আমের বিশাল অংশ খুবলে খাওয়া পোকাটা কি সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে রেখে সোনিয়া নামের কোন বড়লোক পোকানীর সাথে রাত কাটায়? সেটা তো জানবার উপায় নেই। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকতে হয়।

পোকার জীবনে কি আর পোকাত্ব বলে কিছু আছে? আছে? আছে হয়তো, হয়তো নেই। থাকলেও ফজলু মিয়া জানেনা। তাই সুনিশ্চিত ঘেন্না হবে বড়স্যারকে, সোনিয়াকে, হানিফকে, পোকার জন্যে নিখাদ সহানুভূতি। শরীরে জোর পায়না সে আজকাল। রহিমার জোরাজুরিতেই বাজারে আসে।

সারাজীবন পান্তা আর মরিচ খেতে খেতে ওর বিশাল হয়ে থাকা ভুঁড়িটার শান্তি নেই। খালি চায় আর চায়। ওর জিভের আবদারও বেড়েছে। লাল করে রাখা চাই ই চাই। পান না খেলে চলবে কেন! সকালে পান, বিকেলে পান, সন্ধায় পান, ঘুমের মধ্যে পান, জেগে পান, কথা বলতে পান, চুপ করে থাকতে পান, হাসতে পান, কাঁদতেও পান।

পান আর পান। অভিমান করে কাল থালা থেকে বহুদিন পর রান্না করা পুঁটি মাছ ক'টা তুলে দিলো। পান নেই, তো কথা নেই। রহিমা পান চায়, লাল হয়ে থাকতে চাওয়া জিভটার সাথে ফজলু মিয়ার পকেটের দেখা সাক্ষাত নেই। পকেট পানের খোঁজ রাখে।

পানের অবসর কই পকেটে উঁকি দেয়! ১০ টাকায় ৮টি পান কিনতে পাওয়া যায়। সে গুণে গুণে ৮টা পান বাছে। টাকা নিতে পকেটে হাত দিয়ে ফজলুর মজা লাগে। হা হা। পাঁচ টাকার একটা কয়েন পকেটে পড়ে।

আরেকটা কয়েন নেই!! ঠিক এটাই ভাবছিল!! প্রকৃতির প্রতিশোধ!! আমটা নেয়ার সময় একটা কয়েন পড়ে গেছে। কয়েন কি করে টের পেলো যে আমের মধ্যে বেঁচে থাকা পোকাটার একটা অঘটন ঘটতে যাচ্ছে! এই ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করে কে?বিশ্রী একটা পোকার জন্যে সে কয়েন হারালো, বড়স্যারের কিছু হলো না! সোনিয়া স্বামীর ঘরে অসহ্য সুখে! হানিফের দোতলা বাড়ির ছাদে তিনতলা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রণকারীর চোখের জন্যে একটা চশমার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সমস্যা হলো তাকে তো চেনাই যাচ্ছে না, চশমা দেবে কি করে! ভাবনার পথে এগোতে গিয়ে ফজলু মিয়া ফিরে আসে । -অহন নিতাম না, যাওনের পথে পান লইয়া যামু আইয়ুব, থাইকো কইলাম... রাত বাড়ে।

বৃষ্টির অকস্মাৎ ভ্রমণ মানুষগুলোর ব্যস্ততার সময় কমিয়ে আনে। কেনাবেচার খেলা ছেড়ে সব পাড়ি জমায় যে যার পথে। ফজলু মিয়া পান বেপারীর বেছে বেছে ফেলে দেয়া পানগুলো কুড়াতে থাকে। চারপাশে বৃষ্টির পর্দা টেনে দেয়া আছে। কে টেনেছে সে জানে।

কেউ দেখছে না তাকে। খুব পরিষ্কার, সুন্দর একটা চিকন রশি চাই, ধোঁকার রশি। বৃষ্টিতে জমে কাদাপানিতে পাওয়া যাচ্ছে না। এক টাকায় তিন হাত রশি কেনে। বাকি চার টাকা লুঙ্গীর গাঁটে রাখতে সে গিয়ে সাবধান হয়।

গাঁটের জায়গায় একটা ছোট্ট ফুটা। সেই নিয়ন্ত্রণকারী ছোট জিনিস একটু বেশীই দেখতে পায়। টাকা রেখে তার উপর একটু রশি শক্ত করে পেঁচিয়ে নেয় ফজলু মিয়া । পানগুলো ধুয়ে নিয়ে উল্টো করে সাজায়। বাকি রশিটুক গিঁট দেয়।

উল্টো করে সাজিয়ে নেয়া পান আর রশি, দুয়ে মিলে একটা প্রকট ফাঁকির প্রচ্ছন্ন প্রহসনে রূপ নেয়। রশির শক্ত গিঁটে ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে কিছু স্বপ্নের বীজ, অক্সিজেনের অভাবে জন্ম নেয় অনেক দীর্ঘশ্বাস। হাতের মুঠোয় ধরে থাকা পোকাটাকে যত্ন করে ফজলু মিয়া একটা কাঠের গুঁড়ির উপর ছেড়ে দেয়। সে ছাড়া আর কেউ জানতে পারবেনা কিছুক্ষণ আগে একটা পোকা তারই হাতে সর্বস্ব হারিয়ে পথে নেমেছে। তার হাতেই ঘটে গেছে দুঃখময় একটা মিথ্যে পরিসমাপ্তি।

ফজলু মিয়া বাড়ি ফিরে চলে। আঁধারের মাঝে সঙ্গ ছেড়ে দূরে হটতে থাকে তার ছায়া। পিছে পড়ে থাকে উল্টো হয়ে থাকা একটা পাঁচ টাকার কয়েন। একটা বিশ্রী রকমের পোকা। সব হারানোর এক বুক কষ্ট নিয়ে ওটা হাঁটতে পারবে তো!
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।