আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাঁকি

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। ফাঁকি মোহাম্মদ ইসহাক খান জনাব মাসুদুর রহমান সাহেবকে দেখলেই ভক্তি হয়। তাঁর পক্ককেশ, বুক পর্যন্ত লম্বা শুভ্র শ্মশ্রু, গায়ে ফিনফিনে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পায়জামা, নূরানী চেহারা, সমস্ত শরীর থেকে যেন একটা দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে।

তিনি সবুজ রঙয়ের তসবিহ টিপতে টিপতে এসে দাঁড়ালেন রাস্তার মাথায়। মাসুদুর রহমান সাহেবের বয়স ষাট, রিটায়ার করেছেন তিন বছর হল। তিনি সরকারের মোটামুটি উচ্চ পর্যায়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, অবশেষে যখন সময় ফুরিয়েছে, তখন থেমেছেন। এখন তিনি থাকেন ঐ সাদা বাড়িটাতে। তাঁর ছেলেপুলে, নাতিনাতনি নিয়ে ভরভরন্ত সংসার।

তিনি নিজের দায়িত্ব সারাজীবন যত্নের সাথে পালন করেছেন, একটুও গাফিলতি করেন নি। এখন তাঁর দায়িত্ব তাঁর সন্তানেরা নিয়েছে, তিনি আল্লাহ-বিল্লাহ করে দিন গুজরান করেন। এখন তাঁর বিশ্রামেরই সময়, কখন উপর থেকে ডাক চলে আসে ঠিক নেই। সারাদিন নিজেকে ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত রাখেন। টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি এসব মূল্যহীন জিনিস, রোজহাশরের দিন আল্লাহপাক দেখবেন তিনি কত নেকী সঞ্চয় করেছেন।

যদি দেখেন যে নেকী ঠিক আছে, তাহলে পথের ফকিরও বেহেশতে চলে যাবে, আর নেকীতে ঘাটতি থাকলেই কোটিপতিও পার পাবে না, জাহান্নামে অনন্তকাল জ্বলে-পুড়ে মরবে। সবসময় তাঁর হাতে একটা তসবিহ থাকে। দমে দমে জিকির করেন তিনি, রাস্তাঘাটে ছেলেপুলেকে দেখলে মসজিদে আসার আহ্বান জানান, আখেরাতের কথা বলেন, তিনি যেন একটা চলমান দ্বীনি পরিবেশ। নেকী জিনিসটার বড়ই অভাব আমাদের, মুহূর্তে মুহূর্তে সজ্ঞানে অথবা অবচেতন মনে পাপ হয়ে যাচ্ছে। চোখের গুনাহ, কানের গুনাহ, হাতের গুনাহ, অন্তরের গুনাহ।

খারাপ দৃষ্টির কারণে, পেছনে অন্যের নিন্দা করতে গিয়ে অনেক পাপ জমে যাচ্ছে নিজের খাতায়। আজকালকার ছেলেগুলোর যে কী হয়েছে, মুরব্বী মানতেই চায় না। আগে বয়োঃজ্যেষ্ঠ কাউকে দেখলে হাতের সিগারেট লুকিয়ে ফেলত, এখন আর তা করে না, মুখের উপরই ধোঁয়া ছাড়ে, নয়তো এড়িয়ে যায়, অন্য রাস্তায় চলে যায়, কারণ বুড়ো মানুষের কথা মানেই ঘ্যানঘ্যান, সেই পুরনো নীতিকথা। মাসুদুর রহমান সাহেব অবশ্য খুবই নরম স্বভাবের মানুষ। তিনি ছেলেপুলেকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেন, বাবা, দুনিয়ার এই রঙিন জীবন দুই দিনের।

আখেরাতের জীবন হল অনন্ত। তোমরা যে বেহুদা গল্প করে সময় নষ্ট করছ, এটা তো এমনিতেও খারাপ, কারো কোন লাভ হচ্ছে না। তোমাদের বয়সী ছেলেদের মধ্যে যে এত হতাশা দেখা যায়, তার কারণ একটাই, তোমরা আল্লাহপাক থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। দুনিয়া আমাদের অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে, আমাদেরকে অন্ধ করে দিচ্ছে। একবার মসজিদে এসো, সেজদায় লুটিয়ে পড়, দেখো, কি একটা প্রশান্তি তোমার মনে ভর করে, আল্লাহপাক কীভাবে তোমার সমস্যা সমাধান করে দেন।

মসজিদে এসো, কেমন? আর নামায পড়া তো এমন কোন কষ্টের কাজ নয়, মাত্র দশ-পনেরো মিনিট লাগে। দুই তিন ঘণ্টা সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিতে পারবে, আর সৃষ্টিকর্তাকে, যিনি তোমাকে-আমাকে জীবিকা যোগাচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, তাঁকে দশটা মিনিট সময় দিতে পারবে না? সাধারণত বয়স্ক লোকেরা চ্যাংড়া বয়সী ছেলেপুলেকে দেখলেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ধাওয়া দেন, "বদ পুলাপান" বলে গালিগালাজ করেন, কারণ এরা ক্রিকেট বল মেরে জানালার কাঁচ গুঁড়ো করে দেয়; কিন্তু মাসুদুর রহমান সাহেব গালিগালাজ করেন না। তিনি জানেন যে গায়ে হাত বুলিয়ে দুটো কথা বললে ছেলেপুলেরা কথাগুলোকে যেভাবে নেয়, ধমক দিয়ে বললে সেভাবে নেয় না, বরং আরও দূরে সরে যায়। কাজেই পাড়ার ছেলেপুলেরা মাসুদুর রহমান সাহেবকে দেখলে এত ভয় পায় না, ক্রিকেটের ব্যাট-বল- স্ট্যাম্প নিয়ে পাশের গলিতে সটকে পড়ে না। বরং দুয়েকজন তাঁর কথায় উৎসাহী হয়ে মসজিদে যাতায়াত করা শুরু করেছে।

তারা আবিষ্কার করে, এই মাখনের মতো নরম স্বভাবের মানুষটি যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো আসলে ভুল নয়। মাসুদুর রহমান সাহেব দূর থেকে দেখতে পেলেন, গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে তাঁর দিকে পেছন ফিরে কার সাথে যেন গল্প করছে। সেখানে বেজায় ধোঁয়া উড়ছে, নিশ্চয়ই সিগারেটের। তিনি পায়ে পায়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। শরীফ না? তিনি চিনতে পেরেছেন ছেলেটিকে, রহমত সাহেবের ছেলে শরীফ।

শরীফ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে নাকের সামনে থেকে ধোঁয়ার দঙ্গল সরানোর চেষ্টা করে, হাত উঁচু করে তাঁকে সালাম দেয়। কেমন আছেন চাচা? এই তো, আল্লাহপাক ভাল রেখেছেন। তোমার খবর কী? জি চাচা, আপনাদের দোয়ায় ভাল আছি। এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছি, দোয়া করবেন চাচা। অবশ্যই, অবশ্যই।

মন দিয়ে লেখাপড়া কর, ভাল রেজাল্ট ইনশা-আল্লাহ হয়ে যাবে। তা তোমাকে মসজিদে দেখি না কেন? শরীফ মাথা চুলকোয়। জি, ইয়ে মানে ... ... শোন শরীফ, মাসুদুর রহমান সাহেব শরীফের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ভাল রেজাল্ট করার জন্য লেখাপড়া তো করবেই, কিন্তু আল্লাহপাকের ইশারা ছাড়া যত চেষ্টাই কর না কেন, কোনমতেই কাজ হবে না। কাজেই একটু কয়েক মিনিট খরচ করে নামাযটা পড়। নামায পড়ে দোয়া কর, আল্লাহপাক খুশি হবেন।

জি, আচ্ছা, চাচা। আসরের নামাযে এসো, কেমন? মাত্র তো দশ মিনিটের ব্যাপার। বোঝা মনে কোরো না যেন, খুশি হয়েই যদি পারো, তবে এসো। আচ্ছা চাচা, আমি আসবো। আমি এই বছর আল্লাহপাক চান তো হজ্বে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া কোরো, কেমন? অবশ্যই, চাচা।

আসি তাহলে? সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দাও, এটা সাস্থ্যের ক্ষতি বৈ ভাল করবে না। শরীফ লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে। মাসুদুর রহমান সাহেব তসবিহ টিপতে টিপতে বাড়ির দিকে চলে যান। শরীফ আবার লম্বা করে তাঁকে সালাম দিলো। শরীফের বন্ধু তমাল এবার মুখ খোলে।

লোকটা কে রে? আমাদের পাড়ার, মুরুব্বী। ঐ বাড়িটাতে থাকেন। কি সুন্দর চেহারা দেখেছিস? আর কথাও বলেন খুব সুন্দর করে। ধ্যাৎ, বাদ দে তো। কেন? তুই উনাকে পছন্দ করিস না? পছন্দ করবো? উপরটা দেখেই গলে গেলি? এই লোকটার কাহিনী জানিস তুই? কেন? কী করেছেন উনি? এই লোকটা সরকারী চাকরি করতো, যেই র্যা ঙ্কে চাকরি করতো তাতে তার এই বিশাল বাড়ি হয়? তুই বলতে চাচ্ছিস, উনি ঘুষ খেতেন? খেতেন না, বল্‌ খেতো।

রিটায়ারের আগ পর্যন্ত পেট ভরে ঘুষ খেয়ে এখন লম্বা দাড়ি রেখেছে, তসবিহ টিপতে শুরু করেছে, পাঁচ ওয়াক্ত প্রথম কাতারে নামায পড়ছে, কপালে দাগ ফেলেছে, ছেলেপুলেকে নসিহত করে বেড়াচ্ছে। একটা মানুষ বাঁচেই ষাট-পঁয়ষট্টি বছর, সাতান্ন বছর পর্যন্ত যদি কেউ অন্যায় করে বেড়ায়, তারপর আর ফিরে লাভ কী? বলিস কী? আরও কী বলে গেলো শুনলি না? সে এবার হজ্বে যাবে। হজ্বে গেলে নাকি মানুষ সদ্য জন্মানো বাচ্চার মতো পবিত্র নিষ্পাপ হয়ে যায়। কিন্তু এই লোকটার শরীর তো হারাম টাকায় পরিপুষ্ট, কাপড়চোপড় পর্যন্ত কেনা হারাম টাকায়, সেই টাকায় হজ্ব করলে কী ফায়দা হবে? উল্টো হয়তো আরও কিছু গুনাহ কামাই করে নিয়ে আসবে। দমে দমে জিকির করে সে, আল্লাহপাকের নাম নেয়, কিন্তু ভেবে দ্যাখ্‌, সে কি আল্লাহকেই ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে না? আমরা তো সাধারণ মানুষ, তার ওপরের পালিশ দেখেই ভুলে যাবো, কিন্তু আল্লাহপাক তো সব দেখেন, তিনি তো বুঝবেন যে লোকটা আসলে কী।

হয়তো বলবি, খাস দিলে তওবা করলে হয়তো মাফ পেয়েও যেতে পারে। কিন্তু মাফ পাওয়া, বেহেশত পাওয়া কি এতোই সোজা? দুনিয়াতেই আমাদের এক বেলার খাবার যোগাড় করতে ঠেলা বেরিয়ে যায়, আর বেহেশতের অনন্তকালের খাওয়া-খাদ্য সে ভোগ করবে, কোন হিসাব ছাড়াই? শরীফের বন্ধু চুপ করে যায়। দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষটাকে দেখে সে প্রথমেই শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। মাসুদুর রহমান সাহেব বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেছেন। তিনি ভাবছেন, বাসায় ঢোকার সময় ছোট-বড় সবাইকে সালাম দেবেন তিনি।

এক সালামে দশ নেকী হয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।