প্রাইভেট টিউশনী একটা বিরক্তিকর পেশা। যারা এই পেশার সাথে জড়িত ছিলেন বা আছেন তারা হয়ত আমার সাথে একমত হবেন। বন্ধুবান্ধবের সাথে শান্তিমত আড্ডা দিচ্ছেন...হঠাৎ মনে হল একটু পরেই তো টিউশনীতে যেতে হবে। পেইনফুল একটা ব্যাপার কিন্তু কি আর করা? যেতে তো হবেই! একটা বয়সে বাবা-মার কাছে টাকা চাওয়াটাও আত্নমর্যাদা হানিকর একটা ব্যাপার। আর হাবিজাবি খরচের কি শেষ আছে? গার্ল ফ্রেন্ডের খরচ, মোবাইলের খরচ, চা-বিড়ির খরচ, হেন খরচ-তেন খরচ...বাবা-মার কাছে কত আর চাওয়া যায়? এসব কারনে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে-পেলের জন্য টিউশনী অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়।
বিরক্তিকর হলেও টিউশনীই তাদের জন্য এই টাইপের খরচ মেটানোর একমাত্র উপায় একথা বলাই বাহুল্য। যাই হোক এসব প্যাঁচাল না পেড়ে আসল কথা বলি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর পরই আমি বেশ ভালো একটা টিউশনী পাই। আমার ছাত্র পড়ত ক্লাস সেভেন-এ। সেইরকম জিনিয়াস ছিল ছেলেটা।
পড়িয়ে জোস মজা পেতাম। বান্দার সমস্যা একটাই--তা হল বয়সের তুলনায় একটু বেশী পাঁকনামী করত। কথাবার্তা শুনলে মনে হত কলেজে পড়ে। পড়াশোনায় ভালো ছিল বলে পাঁকা পাঁকা কথা বললেও অনেক সময় হজম করতাম। তাছাড়া আমি কখনোই টিচার সুলভ গম্ভীর আচরন করে অভ্যস্ত না।
তাই হয়ত ছাত্রটাও আমার সাথে কথা বলে মজা পেত। তো একদিন এইকথা সেইকথার ফাঁকে হঠাৎ বলল, “স্যার আপনাকে একটা কথা বললে রাগ করবেন না তো?” আমি ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরস্বরে বললাম, “যদি সত্যিই রাগ করার মত কোনো কথা হয়ে থাকে তাহলে বলার দরকার নাই”। আমার কাছ থেকে এরকম কঁড়া জবাব হয়ত আমার ছাত্র কখনো আশা করেনি। বেলুনের মত চুঁপসে গেল একেবারে। বেচারার বিমর্ষ চেহারা দেখে আমার খুব মায়া লাগল।
তাছাড়া আমি বোধ হয় ওকে একটু বেশীই আদর করতাম। একটা সময় হাসিমুখে বললাম, “আচ্ছা যা বলার তাড়াতাড়ি বল”। অনুমতি পেয়ে ছাত্র তো বেজায় খুশী...।
--“স্যার আপনার ফোন নম্বরটা একজন খুব চাচ্ছে। আপনি পারমিশন দিলে আপনার নম্বরটা উনাকে দিতাম”।
--“আমার নম্বর তোমার কাছে কে চাচ্ছে? আর কেনই বা চাচ্ছে”?
--“আমার পরিচিত এক আপু আছে। আমাদের এলাকাতেই থাকে। খুব ভালো সম্পর্ক আমার সাথে। উনি নাকি আপনাকে খুব পছন্দ করে। সবসময়ই আপনার কথা জিজ্ঞেস করে।
কদিন ধরে খুব করে বলছে আপনার ফোন নম্বরটা দেয়ার জন্য। আমি অবশ্য বলছি, আপনি পারমিশন না দিলে কখনো দিব না”।
--“তোমার আপু তো মানুষ সুবিধার না! এতটুকু একটা বাচ্চাকে মিডিয়া হিসেবে ব্যবহার করতেছে! এনিওয়ে আমার নম্বরটা তুমি তাকে দিও। এরকম মানুষকে দুটা কথা শোনানোর দরকার আছে”!!
আমার হম্পি-দম্পি শুনে আমার ছাত্র একটা মুঁচকি হাসি দিল। আমি যে ভিতরে ভিতরে বেজায় খুশী সেটা কি সে বুঝে ফেলেছিল নাকি? বুঝলেও বুঝতে পারে...যেই পাঁকনার পাঁকনা!!
সেদিনই রাত ১২টার দিকে আননন নম্বর থেকে একটা ফোন আসল।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম এই ফোন কার হতে পারে। ভাব নেয়ার জন্য গম্ভীরভাবে বললাম, “হ্যালো”। উত্তরে মেয়েটা যখন বলল, “হ্যালো নিবিড়(আমার আসল নাম ব্যবহার করলাম না) বলছেন?” মেয়েটার কন্ঠ শোনার পর আমার গাম্ভীর্য যে কোথায় উবে গেল টেরও পেলাম না। আমিও যথেষ্ট নরম সুরে বললাম,
--“জ্বী বলছি। আপনি কে বলছেন প্লিজ”?
--“বলতে ভয় লাগছে।
আমি আবার মানুষ খুব একটা সুবিধার না তো”!
--“হাহাহাহা! ও আচ্ছা আপনি”?
--“আমাকে নাকি আপনি কিছু কথা শোনাবেন? আমি কিন্তু শোনার জন্য রেডী আছি”।
--“না মানে...ইয়ে...এতটুকু একটা বাচ্চাকে বোধ হয় এই কাজে ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।
--“হুম হয়ত বা। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ও ছাড়া আপনার নম্বরটা ম্যানেজ করার আর কোন উপায় কি ছিল বলুন”?
--“ঠিক আছে বুঝলাম।
এখন বলুন আমার নম্বরের জন্য আপনি এত ব্যাস্ত হয়ে উঠেছিলেন কেন”?
--“বলতে লজ্জা লাগছে কিন্তু তাও খোলাখুলিভাবেই বলি...আপনাকে আমার খুবই ভালো লাগে। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে করছিল আপনার সাথে একটু কথা বলতে। আচ্ছা আমি যদি মাঝে মাঝে ফোনে আপনার সাথে কথা বলতে চাই...খুব কি বিরক্ত হবেন”?
--“না না বিরক্ত কেন হবো? আপনার সাথে কথা বলতে বরং আমার ভালোই লাগবে। তাছাড়া আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন”।
--“অনেক অনেক থ্যাংক্স।
আজকে রাখি তাহলে”?
--“আরে শুনুন...আপনার সম্পর্কে তো কিছুই জানা হল না। নামটা অন্তত বলুন...”
--“নিশিকা”।
সেদিন রাতে অদ্ভুত একটা ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছিল। মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে এত সুন্দর মনে হয় কেন, কে জানে? কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একটা সময় বিছানা থেকে উঠে কম্পিউটারের সামনে বসলাম।
আমার খুব প্রিয় একটা রবীন্দ্রসংগীত...“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি” আনমনে শুনতে লাগলাম। মেয়েটার প্রতি তীব্র একটা আকর্ষন অনুভব করছিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল নিজেই একবার ফোন দিয়ে কিছুক্ষন কথা বলি। যদিও সে রাতে আর ফোন দেয়া হয়নি।
পরদিন গেলাম ছাত্রের বাসায়।
আমার পোংটা ছাত্র একটু পরপরই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মুঁচকি মুঁচকি হাসছে। ইচ্ছা করছিল কান দুটা জোরছে মলা দেই। আজকালকার পোলাপান এত পাঁকনা হইছে...!!
--“স্যার, আপুর সাথে কি কথা হইছিল”?
--“তোমার এত কিছু জানার দরকার নাই। অংক করো ঠিকমত”!
--“স্যার লাস্ট একটা কথা বলি? এরপর একদম চুপ...আর একটা কথাও বলব না”।
--“আচ্ছা বল”।
--“আপু কিন্তু দেখতে ভয়াবহ সুন্দরী। আপনি দেখলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবেন”।
কথাটা বলে সে ফেকফেক করে হাসতে লাগল। ঐদিন কান ধরে হেব্বি জোরে একটা মলা দিছিলাম। ফাজিলটার হাসি অবশ্য তারপরও থামাতে পারিনি।
নিশিকার সাথে আমার নিয়মিত কথা হত না। ও হঠাৎ হঠাৎ ফোন দিত। কথাও হত অল্প সময়ের জন্য। একটু কথা বলেই নানা তালবাহানা শুরু করত ফোন রাখার জন্য। আর আমি ফোন দিলে বেশিরভাগ সময়ই ফোন রিসিভ করত না।
কিছুক্ষন পর অবশ্য নিজেই ফোন ব্যাক করত। অত্যন্ত রহস্যজনক আচরন ছিল মেয়েটার। আমি কিছুতেই বুঝতে উঠতে পারছিলাম না সে আসলে আমার কাছে কি চায়! মাঝে মাঝে ওর কথা শুনলে মনে হত-আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। মাঝে মাঝে আবার ওর কথায় আমার প্রতি চরম উদাসীনতাও প্রকাশ পেত। আর সবসময় শুধু আমার কথাই জানতে চাইত।
আমার কি ভালো লাগে, কি মন্দ লাগে...ঘুরেফিরে শুধু নিজের সম্পর্কেই বলতে হত ওর কাছে। অথচ যখনই ওর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইতাম, কৌশলে আমার প্রশ্নগুলা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। অনেক কষ্টে তার কাছে শুধু এতটুকুই জানতে পেরেছিলাম যে সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ে। কিন্তু কোন ডিপার্টমেন্ট, কোন ব্যাচ এমন কি কোন ফ্যাকাল্টি সেটাও আমাকে কখনো বলেনি। প্রায়ই ইউনিভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় ফোন দিত।
ফোন দিয়ে বলত, “আমি তোমাকে দেখছি। তুমি এখন ওখানে বসে বসে চা খাচ্ছো”। আমি চা টা ফেলে দিয়ে পাগলের মত এদিক ওদিক ওকে খুজতাম আর নিশিকা আমার কান্ড দেখে খিলখিল করে হাসত। এভাবে বেশকদিন চলছিল। একটা সময় আমার ধৈর্য্যের অবসান ঘটল।
আমি একদিন কঁড়াভাবে বললাম, “তুমি যদি আমার সাথে দেখা না কর তাহলে তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই”। জবাবে ও হতাশকন্ঠে বলল, “দেখা হলে আমাদের সম্পর্কটা এমনিতেও থাকবেনা”। সেদিন কেন জানি খুব রুঢ় আচরন করেছিলাম ওর সাথে। মুখে যা এসেছে তাই বলেছি। হয়ত ওর রহস্যময় আচরনগুলোর কারনেই ওর প্রতি একটা চাঁপা ক্ষোভ ছিল আমার।
সেদিন ফোন রাখার আগে আমি বলেছিলাম, “তুমি যদি সত্যিই আমার সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে তোমাকে আমার মুখোমুখি হতে হবে। এসব অবাস্তব, অর্থহীন কোনো রিলেশন-এ আমি বিশ্বাসী না”।
ফোন রাখার পর মনে মনে ঠিক করলাম, নিশিকা যদি এরপর কখনো ফোন দেয়ও...রিসিভ করব না। মজার ব্যাপার হল নিশিকা আর কখনো ফোন দেয়নি। ২দিন, ৩দিন, ৪দিন এমন করে সপ্তাহ পার হয়ে গেল কিন্তু ওর কোনো পাত্তা নেই।
আমি কখনো বুঝিনি আমাদের মধ্যে আসলে কি রিলেশন ছিল। তবে ওর সাথে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, আমি ওকে খুব ফিল করছি। মানুষের মন বড়ই আজিব বস্তু...তাই না? এদিকে ঐ ঘটনার পর থেকে আমার ছাত্রও একদম চুপ। ভুলেও নিশিকার কথা কখনো মুখে আনে না।
সেমিস্টার ফাইনালের প্রেসারের কারনে একটা সময় নিশিকার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছিলাম।
তাছাড়া ওর কথা ভাবতে ভাবতে ইতিমধ্যে পড়াশোনার বারোটা বাজিয়ে বসে আছি। পরীক্ষায় কেমনে পাশ করব সেই চিন্তায় মাথা প্রায় নষ্ট হওয়ার জোগাড়। যাই হোক একদিন সকালে ক্যাম্পাসে চা খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় আপু-রিক্তা নাম, হাসিমুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নরমালী মেয়েদের সাথে খুব একটা কথা বলি না।
রিক্তা আপুর সাথেও আগে হাই-হ্যালো ছাড়া তেমন কোনো কথা হয়নি। তবে উনাকে খুব ভালো করে চিনতাম। উনি আমাদের এলাকারই মেয়ে। আমি যে বাসায় টিউশনী করতাম সেই বিল্ডিংটার মালিক রিক্তা আপুরাই। ও আর একটা কথা বলে রাখা ভালো, রিক্তা আপু দেখতে মারাত্নক সুইট ছিল।
--“ভালো আছো, নিবিড়”?
--“জ্বী আপু ভালো। আপনি কেমন আছেন”?
রিক্তা আপু আমার কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল।
--“আমাকে ক্ষমা করে দাও নিবিড়। আমিই সেই নিশিকা। তোমার সাথে আমি মস্ত বড় অন্যায় করেছি।
কেন এরকম করলাম, জানি না”!
রিক্তা আপুর কথা শোনার পর আমি কিছুক্ষনের জন্য অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছিলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। অবাক হয়ে রিক্তা আপুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। একটা সময় লক্ষ করলাম রিক্তা আপু চোখ মুছতে মুছতে প্রায় দৌড়ে আমার সামনে থেকে চলে যাচ্ছে। আমি অবশ্য পরে উনার ফোনে বেশ কয়েকবার ট্রাই করেছিলাম প্রতিবারই বন্ধ পেয়েছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।