"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"
রহস্যময়ী
তার আসল নামটা আজও জানা হয়নি। অসংখ্য নামের মধ্যে কোনটা যে তার আসল নাম তা আমার পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিল না। শুধু দেখতাম আইআরসি’র বিশেষ কিছু চ্যাট রুমে (দেশীচ্যাট, বিডিচ্যাট, বাংলাক্যাফে) একটা নিক এসে অনবরত লিখে যেত, "অনি তুমি কোথায়? তুমি কী আমাকে দেখতে পাচ্ছো? আমি তোমাকেই খুঁজছি। তুমি কোথায়....?"
আমি ঠিকই তাকে চিনে নিতাম। না, নিক দেখে নয়।
তার লেখার কথা ও ধরন দেখেই বুঝতাম সে "অনুরাধা"। এই অনুরাধা নিকেই তার সাথে নেটে প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে কখনই সে একই নিকে সব সময় লগিন করতো না। তার আইওএল আইপি আর লেখার ধরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিত সে অনুরাধা ছাড়া আর কেউ নয়। রুমে সে অন্য কারও সাথে কথা বলতে আগ্রহী ছিল না।
অনেকেই তার নিক দেখে "হাই", "হ্যালো" বলতো, কিন্তু সে কোন রেসপন্স করতো না। তার লক্ষ্য শুধু একজনই, আমি। যে নিকগুলো সে ব্যবহার করতো তার কোনটাই তার আসল নিক বা নাম নয়। এমন কী ফিক্সড্ কোন নিক'ও নয়। সবই আনরেজিস্টারড্ নিক।
অন্য কেউ তার মতো নিক নিয়ে এলে প্রায়ই কনফিউজড্ হতাম। নক করে কথা বলার পর বুঝে ফেলতাম সে "অনুরাধা" নয়, অন্য কেউ। যেহেতু সে বিভিন্ন নিক ব্যবহার করতো তাই আমার কাছে সে চেনা হয়েও কেমন যেন অচেনা ছিল।
আমি তাকে কখনও সেভাবে চেনার চেষ্টা করিনি। তবে তার উপস্থিতি আমার ভাল লাগতো, আমাকে আনন্দ দিত।
ভাল লাগতো তার ছেলেমানুষী চপলতা, উচ্ছলতা। আসলে সে কে জানতে পারিনি। সে কী 'সুমি' নাকি 'মৌসুমী', 'বীথি' নাকি 'ছায়াবীথি', 'মিতা' নাকি 'মৌমিতা', 'অপ্সরা' নাকি 'অধরা', 'রাধা' নাকি 'অনুরাধা', 'মালবিকা' নাকি 'মল্লিকা', 'চৈতী' নাকি 'চৈতালি', 'পল্লবী' নাকি 'মাধবী', 'পুষ্পিতা' নাকি 'সুস্মিতা'- আমি তার কিছুই জানিনা। জানতাম সে অসংখ্য নিক ব্যবহারকারী একজন নারী। আপাত বসত আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে।
সে মানবী কী দেবী তা নিয়ে কোন সংশয় ছিল না। কারণ তার সাথে আমার নিয়মিত কথা হতো টেলিফোনে, মুঠোফোনে। তার কথা বলার ইচ্ছে হলেই সে আমাকে কল করতো। অফিসে কিংবা বাসায়, দুপুরে কিংবা রাতে, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে সে আমাকে নিয়মিত ফোন করতো। আমি নিজে কখনো তাকে কল করিনি।
কল করার সুযোগ ছিলনা। কারন সে আমাকে তার ফোন নম্বর দেয়নি। তাই কল করার সুযোগ হয়নি। সে বলেছিল, তার বাড়ীর পাশেই পাবলিক বুথ। সেখান থেকেই সে কল করে স্বল্প খরচে।
তাই আমাকে তার ল্যান্ড-ফোন বা সেল-ফোন কোন নম্বর দেবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। তাকে আমি একবার এই ব্লগের লিংক দিয়েছিলাম। নাম রেজিস্ট্রি না করেই আমার লেখা নাকি সে পড়েছে। হয়তো আবার কখনো সামহয়্যারইনে লগিন করলে এই লেখাটাও হয়তো সে পড়বে। আমি নিশ্চিত তখন সে বুঝে যাবে এই লেখাটা তাকে নিয়েই লেখা।
সে বাংলাদেশী। পুরো মাত্রায় সে বাঙ্গালী। মনে প্রাণে সে বাংলা ভাষাকে ভালবাসে। তার ভাষা সুন্দর, তার কন্ঠস্বর সুন্দর। সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
ফোনে তার সাথে বহুদিন কথা হয়েছে। একটা কার্ডের পুরো টকটাইম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে কথা বলেই যেত। সে খুব সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে বলেছিল তার বাবার নিজের একটা বাড়ী আছে ধানমন্ডিতে। তার অজস্র বন্ধু-বান্ধব ছিল।
তার বাবা তার এই বন্ধু প্রিয়তা মোটেও ভালভাবে নিতে পারেনি। প্রায়ই লেগে যেত বাবার সাথে। তাই একদিন বাবার সাথে প্রচন্ড অভিমান করে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল তার বড় ভাইয়ের কাছে। এক যুগেরও বেশী সময় সে দেশের বাইরে। বাবার উপর তার ভীষণ অভিমান।
মায়ের সাথে তার ফোনে কথা হয় নিয়মিত বিরতিতে। অথচ প্রতি মিনিটের কথায় তার জিজ্ঞাস্য থাকে একটাই- "মা, বাবা কেমন আছে? বাবা কী আমার উপর এখনো রাগ করে আছে? মা, তুমি বাবার দিকে একটু খেয়াল রেখো। বাবার জন্য খুব কষ্ট হয়। তাঁর মনে কষ্ট দিয়ে আমি একটুও সুখে নেই মা। তুমি আমার জন্য দোয়া করো"।
ভালবেসে সে এক আমেরিকা প্রবাসী বাঙ্গলাদেশীকে বিয়ে করেছিল। বিয়ে টেকেনি। ছাড়াছাড়ি হবার পরই নেটে তার সাথে আমার কথার সূত্রপাত। কথা প্রসঙ্গে বলেছিল তার নাকি একটা ছেলে আছে। আমার মোটেও বিশ্বাস হয়নি।
তার পেছনে অনেক কারণ আছে। একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় বলেই লিখতে মন চাইলো না। তাই সেই প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানলাম।
তারপর হঠাত দু'বছর তার কোন খবর নেই। আমিও আইআরসি'র রুমগুলোতে যাইনা প্রায় কয়েক বছর হলো।
ব্যক্তিগত পরিচয় আছে যাদের সাথে নেটের এমন কিছু বন্ধু মাঝে মাঝে আমাকে বলতো একটা নিক মাঝে মধ্যে এসে আমার নাকি খোঁজ করতো। যারা আমার পরিচিত তাদের প্রাইভেট মেসেজ দিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করতো। এর বেশী কিছু না। হঠাত একদিন তার একটা মেইল পেলাম। তার বাবা নাকি মারা গেছেন।
সেই সুবাদে ঢাকা এসেছিল দু’দিনের জন্য। ব্যক্তিগত অসুবিধার কারনে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কিন্তু আমার ধারনা, তার অজানা কিংবা গোপন এমন অনেক কিছু কথা আছে যা আমাকে জানাতে সে কোনদিনও জানাতে চায়না সেগুলো আমি জেনে যেতে পারি ভেবেই সে আমাকে না জানিয়েই ঢাকা ত্যাগ করেছিল।
বেশ কিছুদিন পরে তার আরও একটা মেইল পেলাম। লিখেছিল, "তোমার সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথা বলার মতো সাহস আমার নেই।
তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তোমার সাথে আমি দেখা করতে পারিনি। তোমাকে ফোন করেও বার বার লাইন কেটে দিয়েছি। বাবা মারা যাওয়ার কষ্ট সেই সাথে মনের উপর প্রচন্ড চাপ, কি করে আমি তোমার সামনে দাঁড়াবো। আমি এক চরম মিথ্যেবাদী এটা ভেবে নিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিও। কারন আমার মতো মিথ্যেবাদী তোমার সামনে দাঁড়িয়ে একটাও মিথ্যে কথা বলতে পারবে না।
আমি তোমাকে যেটুকু জেনেছি আর যে সম্মান তুমি আমাকে দিয়েছো, তাতে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলা মানে নিজেকে প্রচন্ডভাবে ছোট করা। এভাবে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইনি বলেই পালিয়ে এসেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো"।
ক্ষমা করার মতো অপরাধ সে করেছে কী না কখনো ভেবে দেখিনি। তবে এক রহস্যময়ীর এভাবে অন্তর্ধান কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি।
তার সাথে আমার চাওয়া পাওয়ার কোন সম্পর্কই ছিলনা। অথচ একবার জানতেও পারলামনা কে সেই নারী? আমার জীবনের এক অপ্রকাশিতব্য সত্য, যে নিজেকে একজন মিথ্যেবাদী ভাবতো। অথচ আমার জীবনে তার উপস্থিতি সুর্যের আলোর মতই সত্য আর রাতের আঁধারের মতই অনুভবে অদৃশ্যমান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।