আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি রাতের কাহিনী

কবে যাবো পাহাড়ে... কবে শাল মহুয়া কণকচাঁপার মালা দেব তাহারে....

কুপির আলো এত কালো হয় কেন কে জানে? আলো দেয় যতটুকু, কালি ছড়ায় তার চেয়ে অনেক বেশি। সে কালি তবু ঘষে ঘষে তুলে ফেলা যায়। কিন্তু দেহে যদি কালি লাগে? দেহ মরলেও সে কালি ঘোচেনা। আগুনে পুড়লেও সে কলঙ্ক মরেনা। ভ্যাম্পায়ারের মত নেকড়েরাও নিশাচর।

শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়ে তবে এদের তৃষ্ণা মেটে। পেছনে ছেড়ে যায় একরাশ কালো কালি। কমলার সারা গায়ে। বিধ্বস্ত, বিত্রস্ত ক্লান্ত কমলা সামলে ওঠার জন্য মিনিট পাঁচেক সময় পায়। এক শরীরে আর কত রক্ত থাকে? এক রাতে আর কয়বার সে দেহের সব রক্ত খুইয়ে ছিবড়ে হতে পারে? কুপির আগুন থেকে কালো ধোঁয়া ঘরের বদ্ধ বাতাসের গা বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে অনবরত।

ধোঁয়ার ছায়া পড়ছে দেয়ালে। সে ছায়া প্রতিনিয়ত রূপ বদলায়। একেকবার সে হয়ে যায় কোন এক শান্ত সমাহিত মানুষের মুখ, কখনো স্বাধীনচেতা নদী, কখনো বা বাড়ির পেছনের পেয়ারা গাছটা। প্রতিরাতে দেয়ালের গায়ে নিত্যনতুন মহাকাব্য লিখে চলে সে ছায়া। ধোঁয়ার ছায়া।

একদৃষ্টে সে ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কমলা। খুঁজতে থাকে কোন রোম্যান্টিক ফ্যান্টাসীর অন্ত্যমিল। কিন্তু, হঠাৎ ছায়াগুলো নেকড়ে বাঘের আদল নেয়। ভাঁটার মত গণগণে মদ্যপ চোখ, কামতৃষ্ণায় লালায়িত লকলকে লাল জিহ্বা, বিষাক্ত তীক্ষ্ন দাঁত আর দাঁতের ফাঁকে লেগে থাকা কাঁচা মাংস। ভয়ে শিউরে ওঠে কমলা।

দেয়ালের গায়ে কোন স্বপ্নের প্রেমকাহিনী দেখতে চায় সে। নিজের ক্লেদাক্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়! ধীরে ধীরে উঠে বসে সে। শরীর থেকে জানোয়ারের লালা মুছে ফেলতে খানিকটা সময় নেয়। তারপর একটা একটা করে আবরণে ঢাকতে থাকে নিজেকে। খানিক বাদেই আবার একটা একটা করে খসে পড়বে সেগুলো।

আবার সে নিরাবরণ হবে। পুঁতিগন্ধময় লালার মধ্যে ডুবে গিয়ে নিঃশ্বাসের জন্য ছটফট করবে আবার। চামড়ার ওপর আরেক পরত কালি জমা হবে। প্রতিটা রাত একেকটা মহাকাল। একেকটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।

বহুযুগ পর যখন ভোরের আভা আস্তে আস্তে পুবদিগন্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন কমলার ছুটি হয়। চোখে-মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে বিগত রাত্রির দুঃস্বপ্নকে ভুলে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এবার সে ঘুমোবে। সত্যিকারের ঘুম। ছোট্ট একটা শান্তির ঘুম।

সে ঘুমে কোন দুঃস্বপ্ন থাকবেনা। বরং হয়তো দু’একটা সুখস্বপ্ন থাকতে পারে। স্বপ্নে ছাড়া সুখ আর মেলে কোথায়? জানালার বদ্ধ পাল্লার ছোট্ট ফুটো দিয়ে বাঁধভাঙা জোছনার আলো এসে পড়ছে ঘরের ভেতর। সে আলোয় কুপির আগুন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে এক সময় নিভে যায় সে আলো।

সারা ঘরে এখন পূর্ণিমার মেলা। পুরু কাঠের কপাট ভেদ করে সব কিছু ছাপিয়ে দিচ্ছে সে আলোর বন্যা। ভেসে যাচ্ছে কমলা। একটু একটু করে শরীর থেকে গলে গলে পড়ছে প্রায় দু’দশক ধরে জমে থাকা জমাট কালি। ধুয়ে মুছে মিলিয়ে যাচ্ছে পরতের পর পরত।

শরীর তার ফিরে পাচ্ছে অনেক আগের ভুলে যাওয়া রং। যে রং দেখে নাকি পিসী তাকে চাঁদের সাথে তুলনা দিয়েছিল। যে রঙের ত্বকে সে লেপটে থাকত বাবার বুকের সাথে। চাঁদের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে, মিটমিট চোখে তবুও কমলা চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে।

এ চাঁদ সেই চাঁদ! যাকে দেখত সে দাওয়ায় বসে- মা যখন তার চুলে নারকেলের তেল মেখে বিলি কেটে দিতেন। অনেকদিন আগে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া চাঁদ। কিংবা,... এ কি সত্যিই সেই চাঁদ? সে চাঁদের আলো তো কখনো তার চোখে ছুরির মত বেঁধেনি! আর পারেনা সে তাকিয়ে থাকতে। ধড়ফড় করে উঠে বসে। পড়ন্ত বিকেলের মুমূর্ষু সূর্যের শেষ কিরণটুকু হাত দিয়ে আড়াল করে আড়মোড়া ভাঙে।

শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল-গলার ঘাম মোছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। বেলা পড়ে এসেছে প্রায়... একটু পরেই শুরু আরেকটা রাতের। আরেকটা দুঃস্বপ্নের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.