: না আমি স্কুলে যাবো না ।
: কেনো আব্বু ?
: তুমি খুব পচা আব্বু !
: কেনো আব্বু ? কী করেছি আমি ?
: সবাই কত্তো সুন্দর স্কুল ব্যাগ নিয়ে যায় । আর আমার কোনো স্কুল ব্যাগ নাই !
: আমি আজই তোমার জন্যে স্কুল ব্যাগ নিয়ে আসবো আব্বু; এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো স্কুলে যাও ।
: সত্যি আনবা তো ?
: হ্যাঁ আব্বু ।
রহমান সাহেবের আদরের ছেলে নাদিম ।
সবে মাত্র স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন । এই দু’দিন ঠিকই ছিলো, সমস্যাটা হয়েছে আজ সকালেই । নাদিম তার বাবার কাছে বায়না ধরেছে । তেমন বেশি কিছুর জন্যে নাহ, একটি স্কুল ব্যাগের জন্যে বায়না ধরেছে । এই বয়সে সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ে’দের কাছে নানা রকম বায়না ধরে ।
যেমন খেলনার বায়না, জামার বায়না । এইসবের তুলনায় একটি স্কুল ব্যাগ তেমন কিছুই না । বরঞ্চ এটা ওগুলোর চাইতে শতগুণ বেশি জরুরি । ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একটা স্কুল ব্যাগ এখনো কিনে দেননি । আসলে কিনে দিতে পারেননি ।
কেমন করেই বা দিবেন ? প্রাইভেট একটি ফার্মে স্বল্প আয়ের একটি ছোটখাট চাকরী করেন । এই মাসের বেতনের প্রায় অর্ধেকটুকু দিয়ে গতমাসের বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করেছেন । যা ছিলো তার অনেকটুকুই গেছে স্কুল ভর্তি, স্কুলের বই-খাতা আর স্কুল ড্রেসের পেছনে । একটা স্কুল ব্যাগ যে অপ্রয়োজনীয় ঠেকেছে রহমান সাহেবের কাছে, তা নয় । কিন্তু তার পকেটের যে অবস্থা ! ভেবেছিলেন কিছুদিন পরই দেবেন ।
নিজের অবস্থা নিজে বুঝেন ঠিকই, কিন্তু একটা শিশুকে বুঝাবেন কী করে ?
কিছু পলিথিন পাওয়া যায়, সাদা রঙের উপর কালো ডোরাকাটা । রহমান সাহেব প্রথম দু’দিন সেই পলিথিনে বই-খাতা ঢুকিয়ে দিয়ে তার আদরের সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন । প্রথম দিন কাঁধে পলিথিন ঝুলিয়ে অনেক আনন্দ নিয়েই স্কুলে গিয়েছিলো নাদিম । সবার ব্যাগের সাথে তার সাদা-কালো ব্যাগটার পার্থক্য প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিলো । ঐদিন বাসায় এসেই একটা ব্যাগের জন্যে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিয়েছিলো ।
দ্বিতীয় দিন কোনো রকমে বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন ছেলেকে । কিন্তু আজ ? আজ অবশ্য ছেলেকে একরকম প্রতিশ্রুতিই দিলেন যে আজই অফিস থেকে ফেরার পথে ছেলের জন্যে একটা ব্যাগ নিয়ে আসবেন । রহমান সাহেব জানেন, তিনি এটা পারবেন নাহ । তারপরও তার তো কিছু করার নেই । তিনি যে নিরুপায় ।
পেটে দিলে পিঠে সয়না, আবার পিঠে দিলে পেটে সয়না । এটাই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের চিরাচরিত নিয়ম ।
দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে নাদিম । বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই খেলতে চলে গেলো । কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ঘরে ফিলো ।
ফরিদা বেগম আরও খেয়াল করলেন, ছেলে গোমড়া মুখে ঘরে ফিরে এসেছে । ছেলেকে কাছে ডেকে বুকে টেনে নিলেন ফরিদা বেগম ।
: কী হয়েছে আব্বু ? খেলতে যাওনি ?
: হু ।
: তো চলে এলে যে ?
: ওরা আমাকে গরীব বলেছে ।
: কেনো আব্বু ?
: আমি একটা পলিথিন নিয়ে স্কুলে যাই, তাই ।
: থাক আব্বু, ওদের সাথে খেলতে যাওয়ার দরকার নেই ।
: আচ্ছা আম্মু, গরীবরা কি খুব খারাপ ?
: না তো আব্বু ।
: আমরা গরীব কেনো আম্মু ?
ফরিদা বেগম তার ছেলেকে এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবেন ভেবে পেলেন নাহ । শুধু বললেন, “যাও আব্বু, পড়তে বসো গিয়ে । আমি আসছি ।
”
মাগরিবের নামাজটা পড়ে ছেলেকে নিয়ে বসলেন ফরিদা বেগম । ডায়েরী খুলে বাড়ীর কাজগুলো করাচ্ছিলেন । ছেলের মেধা ততোটা ভালো না হলেও অন্তত খারাপ নয়, অল্পতেই পড়া বুঝে নিতে পারে । ছেলেকে কাজগুলো করতে গিয়ে ফরিদা বেগম আপন মনেই কিছু একটা ভাবছিলেন । ছেলের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন ।
: আম্মু শেষ ।
: সব ?
: হ্যাঁ আম্মু ।
: কই দেখি ?
ফরিদা বেগম ছেলের খাতা দেখছেন ।
: আম্মু, আব্বু কখন আসবে ?
: কিছুক্ষণ পরই আসবে ।
: আজ কি আব্বু ব্যাগ আনবে ?
: আনবে আব্বু, অবশ্যই আনবে ।
আব্বু, তুমি এখন এই পড়াগুলো একটু পড় তো । আমি আসছি ।
ছেলেকে পড়তে বসিয়ে ফরিদা বেগম রান্না ঘরে এলেন । ছেলের পিঠে ব্যাগ উঠুক বা না উঠুক, পেটে অন্তত কিছু পড়তে হবে । ছেলেকে কিছু মুড়ি দিয়ে আবার রান্না ঘরে চলে এলেন ।
রাতের উদরপূর্তির বন্দোবস্ত করতে হবে । ‘উদরপূর্তি’ শব্দটা বোধহয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে একদমই বেমানান । শব্দটা শুনলেই কেমন জানি মনে হয়ে এর সাথে ঐশ্বর্য জড়িত । ঐশ্বর্য যেমন ঐ উঁচু আসন ছেড়ে কখনো নিচে নেমে আসবে না, এই শব্দটিও তেমনি ঐ জাঁকজমক পরিবেশ ছেড়ে এই সাদামাটা, চুন খসে পড়া চার দেয়ালের মাঝে আসবে নাহ ।
মানুষটা সাধারণত রাত ন’টার মাঝেই চলে আসে ।
দশটা বেজে গেলো, এখনো মানুষটি আসার নাম-গন্ধও নেই । কোথায় যে গেলো ? কাজের চাপ কি খুব বেশী ? নাকি খারাপ কিছু ঘটলো ? ছি ! ছি ! এইসব আমি কী ভাবছি ! আল্লাহ্, তুমি মানুষটাকে সহিহ সালামতে ফিরিয়ে আনো । ফরিদা বেগমের অশান্ত মনের বিক্ষিপ্ত চিন্তায় ছেদ পড়ে ছেলের ডাক শুনে ।
: আম্মু, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ।
: ঘুমিয়ে যাবে ?
: না আম্মু, আব্বু এলে ঘুমাবো ।
: ঘুমিয়ে পড় আব্বু, কাল সকালে স্কুল আছে ।
: আর একটু অপেক্ষা করি ।
: না আব্বু । এখনি ঘুমিয়ে পড় ।
মায়ের চোখ রাঙানোয় আর কিছু বলার সাহস পেলো না নাদিম ।
বাধ্য ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়লো ।
মানুষটা যে কী ! সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো, এখনো আসছে নাহ । কোনো ভাবে যে একটা খোঁজ পাবে, তার উপায়ও নেই । এমনি ভাবতে ভাবতেই আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন ফরিদা বেগম ।
সকাল সাড়ে ছয়টা ।
নাদিমের ঘুম ভাঙলো তার মায়ের ডাকাডাকিতে । নাদিম কোনোরকমে চোখটা খুলে চারপাশে তাকালো । প্রথমেই নজর গেলো টেবিলের দিকে । অনেক আশা নিয়ে তাকিয়েছিলো সে । না, ওখানে কোনো ব্যাগ নেই ।
ঘুম থেকে উঠেই মনটা প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেলো নাদিমের । হঠাৎ বিছানায় তার পাশে তাকিয়ে দেখলো তার বাবাও নেই ! খানিকটা অবাক হলো । তাহলে কি বাবা কাল রাতে আসেনি ? মা’কে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে, ওমনি দরজায় তাকিয়ে দেখে তার বাবা ঘরে ঢুকছে, হাতে নীল রঙের কী জানি একটা । ভালো করে তাকিয়ে দেখতো পেলো ওটা একটা স্কুল ব্যাগ । ওমনি মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে বাবার কোলে উঠে গেলো নাদিম ।
রহমান সাহেবও পরম আদরে ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “যাও আব্বু, মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নাও । দেরি হয়ে যাচ্ছে । ”
রহমান সাহেবের এলাকায় একটা ব্যাগের দোকান আছে । কাল রাতে ফিরতে দেরি হয়ে যাওয়াতে দোকানটা বন্ধ পান । তাই আজ সকালেই বের হয়ে তার আদরের ছেলের জন্যে একটা ব্যাগ কিনে নিয়ে আসলেন ।
আসলে বাবা-মা’রা কখনোই চাননা যে তাদের সন্তানের কোনো ইচ্ছা অপূরণ থাকুক । কিন্তু সবার তো আর একরকম সামর্থ্য নেই । অনেকেরই সাধ থাকে, থাকে না সাধ্য । রহমান সাহেব তাদেরই একজন । অফিসের এক সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে ছেলেকে ব্যাগটা কিনে দিয়েছেন ।
টাকা ধার করতে যেয়ে হয়তো আত্মসম্মানে বেধেছে, তারপরও চেয়েছেন তার ছেলে অন্তত হাসি-খুশি থাকুক । এটাই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মা’দের একমাত্র চাওয়া ।
নাদিম পিঠে নীল ব্যাগটা ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে । ব্যাগটা তার খুব পছন্দ হয়েছে । রহমান সাহেব আর ফরিদা বেগম নাদিমের গমন পথের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ।
কেউ খেয়াল করেনি যে তাদের দু’জনের চোখ দিয়েই টপ টপ করে পানি পড়ছে । এই অশ্রু দুঃখের অশ্রু নয়, এই অশ্রু একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের আনন্দের অশ্রু ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।