পথচারী
মিডিয়া আজ সর্বত্র সর্বব্যাপী। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মিডিয়া প্রবল প্রতাপে বিবর্তমান আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চর্চাগুলোর ভিতর মধ্যস্তততায় লিপ্ত আছে, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পরিচয় নিমার্ণ করছে, আমাদের জীবনযাত্রার নকশা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তাই মিডিয়া হচ্চে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। গণমাধ্যম বা মিডিয়ার ক্ষমতা অনেক। কিন্তু সে ক্ষমতার প্রয়োগ সে নিজে করতে পারে না।
অর্থাৎ গণমাধ্যমের নিজের স্বাধীন কোন সত্তা নেই। দৃশ্যত যে গণমাধ্যম ক্ষমতা আমরা দেখি তার অন্তরালে রয়েছে পুঁজির রাজনৈতিক সামাজিক শক্তি, অথ্যাৎ ক্ষমতা কাঠামোর শক্তি। যা এখন দেশীয় সীমানা থেকে বিশ্ব পর্যন্ত বি¯তৃত হয়েছে। যা এখন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাতে এবং মুনাফার স্বার্থে গণমাধ্যম কথা বলে এবং অন্যদেরকে কথা বলায়। সহজ কথায় বলতে গেলে, মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে মিষ্টিমুখ করার মত অবস্থা।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে গণমাধ্যম এবং এর মালিকানার ধরন পুরোপুরি বধলে গেছে। রেডিও, টিভি বা সংবাদপত্রের মালিক হচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলের লোক, ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী বা গ্র“প অব কোম্পানি। কোন মহৎ উদ্দেশ্যে মহান এ পেশায় অবদান রাখা বা সমাজের উন্নয়ন, সমাজের মানুষ গুলোর উন্নয়নের চিন্তায় নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ কিংবা কোম্পানির অন্য ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বের হচ্ছে নতুন নতুন সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল। গণমাধ্যম নিজেই পরিনত হচ্ছে গ্র“প অব কোম্পানিতে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আর পূজিপতিদের ক্ষমতা লিপ্সা এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার বেড়া জালে যেমনি আটকে গেছে আমাদের রাজনীতি তেমনি তাদের মুনাফা কেন্দ্রীক ধ্যান, জ্ঞান আর নিজ পক্ষীয় রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহৃত হচ্ছে গণমাধ্যম।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান আমলেই বর্তমান বিটিভির যাত্রা শুরু হয়। ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের অপর শক্তিশালী গণমাধ্যম রেডিওর যাত্রা শুরু হয়েছিলো আরও আগে তবে সরকারী মালিকানাধীনে থাকার কারণে এবং স্বায়ত্তশাসন না পাওয়ার কারনে এ মাধ্যম দুটো শুরু থেকেই সরকারের হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করছে। উদাহরণ হিসাবে বিটিভির উদ্ধোধনের দিনটির কথা বলা যায়, উদ্ধোধন করেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ঐদিন ঢাকায় আইয়ুব বিরোধী বিশাল মিছিল হয়। বিটিভি সেই দিনের অনুষ্ঠানের খবরটি ব্লাক আউট করেছিলো।
দুঃখজনক যে আজ পর্যন্ত বিটিভি তার ঐতিহ্য থেকে একটুও দূরে সরে আসেনি। এক তরফা সরকারি খবর প্রচার করে এবং বিরোধী দলের খবর বাদ দেয়। যেমন জিয়ার আমলে ছিল জিয়া টিভি, তারপর এরশাদের আমলে সাহেব বিবি গোলামের বক্স, বিএনপি আমলে জাতীয়তাবাদী টিভি, আর আওয়ামী লীগ আমলে আওয়ামী টিভি হয়ে যায়। অর্থাৎ বিটিভির মূল আদর্শ নিরপেক্ষতা নয়। সরকার ও সরকার সমর্থিত দলের গুণকীর্তন এর মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেরশর সংবাদ পত্রের সঙ্গে রাজনীতির সর্ম্পক অত্যান্ত ঘনিষ্ট। স্বাধীনতা পূর্ব, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এবাং বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতিফলন ঘটছে সংবাদপত্রে। কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে অনেক রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের পেছনেও ছিল সংবাদপত্র।
৯০ এর গণ অভ্যত্থানের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে ব্যবসায়ী শিল্প পতিরা সরাসরি রাজনীতিতে চলে আসে। রাজনীতি হয়ে পড়ে পূজিপতি গোষ্ঠীদের নয়া উপার্জনের নীাত।
আবির্ভাব হয় পশ্চিমা ধাঁচের কর্পোরেট মিডিয়া। গণমাধ্যমের শক্তি কে রাজনৈতিক দলের শক্তি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য গণমাধ্যম মালিকানায় চলে আসে রাজনৈতিক দলের লোক। সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায় জিনিসটার মূল কায়দা কনুনের জায়গায় আর দশটা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের কোন পার্থক্য থাকেনা। পার্থক্যটা হয় ভঙ্গিতে এর মালিক রীতিমতো দেখেশুনে বাছাই করে কর্মচারী নিয়োগ দেন।
কর্পোরেট মিডিয়াগুলো শুরু থেকেই নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সুশীল সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে রাজনীতি বিরোধী সংবাদ পরিবেশন এবং রাজীনীতিকে জনগণের সামনের খারাপভাবে উপস্থাপন করা শুরু করে। যদিও রাজনৈতিক সংবাদ এদের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বিজ্ঞাপনের মোড়কে সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সুক্ষভাবে পাঠকদের মগজ ধোলাই করে পত্রিকাগুলো দেশের প্রধান পত্রিকা হয়ে যায়। পূজির দাপটে মেধা কে পদতলিত করে, করেছে হলুদ সাংবাদিকতার জয় জয়কর ধ্বনি।
উল্লেখ্য ৯০ এর আগে সংবাদপত্র ছিলো রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পক্ষে কিন্তু কর্পোরেট মিডিয়া গুলো রাজনৈতিক সচেতনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। “বদলে যাও বদলে দাও” সুশীল সমাজ গঠনের আহবানে বিভিন্ন সভা সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে দেশে কিছু নতুন বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করে। যারা শুধু সরকার, রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা থেকে শুরু করে প্রধান দল গুলোর মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী সংবাদ ছাপনো, বাংলাদেশের রাজনীতিতে, নতুনত্ব আনা, রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র চর্চা, এসব বিষয়ে সংবাদ পরিশেনে এদের ভূমিকা এগিয়ে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম আলোর ভূমিকা ছিলো রাজনীতির অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ, সংবিধান বর্হিভূত সরকারকে প্রথম আলোর সমর্থন দান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ’মাইনাস টু’ ফরমূলাকে সমর্থন এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, প্রথম আলোকে অনেক সমালোচিত করেছে।
এখানে আরেকটি বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৯০ এর দশকে রাজনৈতিক দলীয় পত্রিকা (মালিকানায় দলের লোক যার ফলে দল কেন্দ্রীক বা প্রভাবিত) পত্রিকার সংখ্যা বেড়ে যায়। যারা সরকারী দলের মুখপত্র হিসাবে কাজ করে। কোন গুলো আওয়ামী, কোনগুলো বিএনপি, আবার কোন গুলো জামায়াত সমর্থিত পত্রিকা তা সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। যদিও দলীয় পত্রিকাগুলো পাঠক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিজ দল বা সমর্থিত দলের গুণকির্তন এবং বিরোধী দলের দোষ খুঁজে বেড়ানোই যেন এদের প্রধান কাজ।
২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে কোন জোট জয়ী হবে এ বিষয়ে জনগণের মাঝে মতামত জরিপ চালায় দেশের পত্রিকাগুলো। দেখা গেছে মহাজোট বা আওয়ামী কেন্দ্রীক পত্রিকা গুলো দেখিয়েছে মহাজোট এগিয়ে আর চারদলীয় জোট তথা বিএনপি জামায়াত কেন্দ্রীক পত্রিকা গুলো জরিপে দেখিয়েছে চারদলীয় জোট এগিয়ে। এভাবে আরো কিছু ইস্যু নিয়ে বলা যায় যেমন, টিপাইমুখ পানি চুক্তি, ট্রানজিট, এশিায়ান হাইওয়ে, প্রধান মন্ত্রির ভারত সফর, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, মানবতা বিরোধী অপরাধ, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কে তার কেন্টনমেন্ট এর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, হরতাল, দেশ পরিচালোনা ইত্যাদি । প্রত্যেকটি আওয়ামী কেন্দ্রীক পত্রিকা এই ইস্যুগুলো কে আওয়ামীলীগ সরকার যেভাবে চেয়েছে ঠিক সেভাবে ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করেছে আবার চারদলীয় জোট কেন্দ্রীক পত্রিকা গুলো নেতিবাচকভাবে বা আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
কর্পোরেট পূজির লিপিস্টিক লেপ্টানো টিভি মিডিয়া বর্তমানে পৃথিবীর অন্য সব দেশের মত আমাদের দেশেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে।
টেলিভিশনের এ জনপ্রিয়তাকে পুজি করে বাড়ছে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা। গত এক যুগে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ও ট্রারিস্ট্রিয়াল মিলিয়ে মোট ২৭টি টিভির পর্দায় দেখায় গেছে। এদের এক তৃতীয়াংশ অনুমোদনহীন। অবশ্য সরকারের হস্তক্ষেপে অনুমোদনহীন চ্যানেলের স¤প্রচার বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সরকারী চ্যানেল বিটিভির পাশাপাশি স¤প্রচারে রয়ে ১২টি বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেল।
এগুলো হলো এটিএন, এনটিভি, চ্যানেল আই, বাংলা ভিশন, একুশে টিভি, দিগন্ত টিভি, বৈশাখী টিভি, ইসলামীক টিভি, দেশ টিভি ও মাই টিভি, এটিএন নিউজ, মোহনা টিভি ইত্যাদি।
বিগত জোট সরকারের আমল ছিল বাংলাদেশ বেসরকারী মালিকানা টেলিভিশন চালুর স্বর্ণসময়। এসময় ৭/৮টি বেসরকারী টিভি চ্যানেল বিটিভির ও একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল চালু হয় এবং বর্তমান মহাজোট তথা আওয়ামী সরকার আরো ১২টি নতুন বেসরকারী চ্যানেল অনুমোদন দিয়েছে। প্রত্যেকটি চ্যানেল এর মালিকানায় রয়েছে মন্ত্রী, সাংসদ ও তাদের বন্ধু বান্ধব এবং তাদের দলীয়লোক। একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো এ টিভি চ্যানেল গুলোর মালিকানায় কারা এবং কেনই বা বেছে বেছে নিজ দলের বা পছন্দের লোকদের টিবি চ্যানেল চালু করার অনুমতি দিয়েছেন বর্তমান সরকার এবং বিগত সরকার।
প্রচারেই প্রসার এবং মুনাফা কেন্দ্রীক চিন্তা ধারায় আমাদের বড় রাজনৈতিক দু’টি দল বেসরকারী টিভি চ্যানেল চালুর করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়েছে। বিটিভির খবর ও অনুষ্ঠানের একপেশে রাজনীতি নিয়ে অহরহ সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু প্রাইভেট/বেসরকারী টিভি চ্যানেল গুলোর সংবাদ ও অনুষ্ঠান এর চেয়ে ভাল কিছু হচ্ছে কি? প্রাইভেট টিভি চ্যানেল গুলো আধেও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রীগণ, সংসদীয় কমিটি, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিবের ব্রিফিং, সভা সেমিনার এবং নিজ রাজনৈতিক ব্যানারকে সংবাদে গুরুত্ব দেয়া।
দলীয় করনের বেলায় মিডিয়াকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে রাজনীতিবিদগণ। অথচ আধুনিক গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে মিডিয়ার কাজ সরকার ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চোখে চোখে রাখা তাদের ভুলচুক-ত্র“টিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া।
মনীষীরা বলেন, সমাজ জীবনের ঢেউ, চমক, স্পন্দন, আর অনিয়ম নিয়েই গণমাধ্যমের অস্তিত্ব। মানুষ প্রত্যাশা করে সরকারী, বেসরকারী, বহুজাতিক বা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজের সাথে জনগণের স্বার্থ জড়িত গণমাধ্যম তাদের কাজের উপর নজরদারি রাখবে, জনবিরোধী বা কোন অন্যায়, অনিয়ম, দূর্নীতি হলে সেসবের সমালোচনা করবে। মিডিয়াকে তাই ‘আই অন গভর্নমেন্ট’ বলে। কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়া মালিকরাই যদি হন রাজনৈতিক দলের নেতা,দলের লোক এবং ব্যবসায়ী। মুনাফা আর দলীয় সমাচারই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য তবে মিডিয়া কিভাবে আই অন গভর্নমেন্ট এর গুরু দায়িত্ব পালন করবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।