বিরাট একটা শুন্য
‘পায়ের ব্যথায় আর হাঁটতে পারছিলাম না। তখন তালেবান সদস্যরা আমার পায়ের কাছে গুলি করে। মারধর শুরু করে। কোনো উপায় না দেখে আবার হেঁটেছি। অন্ধকার রাতে তারা আমাদের হাঁটিয়েছে।
এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে পানির পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল। কোথাও পানি নেই। মনে হচ্ছিলো মরেই যাব। এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ’
আফগানিস্তানে অপহৃত সাত বাংলাদেশির মধ্যে যে দু’জন মুক্তি পান তাদের একজন টাঙ্গাইলের মুজিবর রহমান।
এভাবেই নিজের বন্দি অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। মুজিবর অপহরণকারীদের তালেবান বললেও এখন পর্যন্ত কেউ অপহরণের দায়িত্ব স্বীকার করেনি। সূত্র: http://www.banglanews24.com
মাঝরাতে যখন পাহাড়ের ঢালে গুহার মত একটি জায়গায় জিম্মিদের নিয়ে তালেবানরা থেমে যায় মুজিবরের মনে হয়েছিল ‘এই বুঝি আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে’। দীর্ঘ রাত একসঙ্গে হাঁটিয়ে নিলেও সাত বাংলাদেশিকে নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলতে দেয়নি তালেবান।
মুজিবর বলে চলেন, ‘ভোর চারটায় পানি আনবে বলে তালেবানরা আমাকে তিন-চারশ ফুট উঁচু পাহাড়ে ফেলে রেখে যায়।
ওরা আর আসেনি। জ্ঞান ফিরে দেখি কুমিল্লার আবুল খায়েরও আমার সঙ্গে আছে। আমাকে দেখা-শোনার জন্য তালেবানরা আবুল খায়েরকে রেখে যায়। ’
‘আবুল খায়েরকে বলি পিপাসার যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না। পাথরের আঘাতে আমাকে মেরে ফেলে তুমি পালিয়ে যাও।
সে আমাকে ফেলে যায়নি। ’
বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অপহৃত বাংলাদেশিদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মুজিবর রহমান সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। অপহৃত অন্য বাংলাদেশিদের পরিবার-পরিজনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মুজিবুরকে সহকর্মীরা দেশে পাঠায়।
গত ১৭ ডিসেম্বর আফগানিস্তানের বলখ প্রদেশের রাজধানী মাজার-ই-শরীফের বাইবোগা নামক স্থান থেকে তালেবানরা সাত বাংলাদেশিকে অপহরণ করে। ঘটনাস্থলে আলতাফ হোসেন নামের একজন বাংলাদেশি প্রকৌশলীকে গুলি করে হত্যা করে।
এখনো তাদের হাতে পাঁচ বাংলাদেশি জিম্মি অবস্থায় আছেন।
মুজিবর বলেন, সেদিন ছিল শুক্রবার। রাত সাড়ে সাতটা-আটটার মত হবে। এশার নামাজ শেষে আমরা ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছি। বাইরে হঠাৎ ভয়াবহ গোলাগুলি শুরু হয়।
আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরাও গুলি ছোড়ে। এভাবে ১০-১৫ মিনিট গোলাগুলি চলে। এক পর্যায়ে তালেবান সদস্যরা দু’টি রকেট লঞ্চার ছোড়ে।
‘আমি, শফিউল আলম, লাবলু রহমান ও আবুল খায়ের এক রুমে ছিলাম। এক পর্যায়ে তিনজন অস্ত্রধারী আমাদের কক্ষে প্রবেশ করে ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর’ বলে স্লোগান দেয়।
আমরাও তাদের সঙ্গে নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর বলি। একই সঙ্গে কালেমা পড়তে শুরু করি। এরপর তালেবানরা আমাদের হাত-পা বেঁধে ফেলে। আমাদের টাকা, মোবাইলসহ যা পায় নিয়ে নেয়। ’
মুজিবর বলে যান-- ‘আমাদের ক্যাম্পটা দুই পাহাড়ের মাঝখানে সমতল জায়গায়।
আমাদের নিয়ে ওরা পাহাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আমাদের নিয়ে একটা পাহাড়ি গুহায় রাখে। এরপর ওদের অন্যান্য সদস্য এবং আরও তিন বাংলাদেশিকে (আমিনুল ইসলাম, মাহবুব আলী ও ইমাম উদ্দিন) নিয়ে সবাই ওই গুহায় আসে। এক পর্যায়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। ’
‘ওরা মোট ১৭ জন ছিল।
সাত বাংলাদেশিকে মাঝে রেখে সামনে-পিছনে-ডানে-বামে ভাগ হয়ে তারা হাঁটতে থাকে। প্রায় মাঝরাতে তালেবানরা ভাগ হয়ে যায়। আমাদের নিয়ে চলে আটজন। এভাবে ভোর চারটা পর্যন্ত হাঁটালো। ’
মুজিবরের ধারণা সারারাত তারা অন্তত আট থেকে ১০ কিলোমিটার হাঁটেন।
তিনি বলেন, এক পর্যায়ে ওরা আমাদের পাহাড়ি ঢালে গুহার মত একটি জায়গায় নিয়ে হাঁটা বন্ধ করে দেয়। তখন মনে হয়েছিল ওরা আমাদের মেরেই ফেলবে। সেখানে আগুন জ্বালিয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করে।
‘আমি স্যান্ডেল পরা ছিলাম। পাহাড়ি পথে পাথরের আঘাতে আমার পায়ে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে যায়।
আমি আর হাটতে পারছিলাম না। এক সময় পায়ের ব্যথায় আমি আর দাঁড়াতে না পেরে পড়ে যাই। এজন্য ওরা আমার পায়ের কাছে গুলি করে। আমাকে মারধর করে। জীবনের মায়ায় আবুল খায়েরের কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটেছি।
শেষ পর্যন্ত আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ’ মুজিবর বলেন।
‘জ্ঞান ফিরে দেখি আমার সঙ্গে আবুল খায়ের আছে। তালেবানরা পানি আনবে বলে চলে গেছে। ওরা আর আসেনি।
তখন ভোর চারটা। আমরা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে হাঁটতে থাকলাম। ’
‘এভাবে সকাল ১০ পর্যন্ত হেঁটেছি। কোথাও কোন বাড়ি ঘর বা মানুষ পাইনি। আরও কিছুক্ষণ হাটার পর দূরে ভেড়া চরানো অবস্থায় জ্যাকেট পরা তিনজন আফগানের দেখা পাই।
আমরা ভয় পেয়ে যাই। ভেবেছি আবারও অপহরণকারিদের সামনে পড়েছি। ’
‘এ পর্যায়ে আবুল খায়ের ভয়ে পাহাড়ি ঢালু রাস্তা বেয়ে অন্য দিকে চলে যায়। পিপাসায় আমার প্রাণ তখন যায় যায়। তাই বাধ্য হয়েই আমি তাদের কাছে গিয়ে বলি---ভাই আমি একজন মুসলিম।
বাড়ি বাংলাদেশ। পিপাসায় মরে যাচ্ছি। আমাকে পানি খাওয়াও। ’
‘ওরা তখন দূরের ঝর্ণা থেকে পানি এনে আমাকে খাওয়াল। তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ গাধার পিঠে চড়িয়ে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল।
অনেক সেবা শুশ্রুষা করে আমাকে সুস্থ করে তুলল। এরপর সব ঘটনা শুনে স্থানীয় পুলিশকে ফোন করলে পুলিশ আমাকে আমাদের ক্যাম্পে দিয়ে যায়। ’
পরে বিকাল পাঁচটার দিকে আবুল খায়ের ক্যাম্পে ফিরে আসেন। পুরোটা পথ হেঁটে তিনি ক্যাম্পে আসেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।