আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাতক

বৃথা হয়রানি

কতোদূরে আছি জানো। আকাশ দেখিনা, মাটির গন্ধ পাই মাসে-দুমাসে আর ভালোবাসি একদিনÑ এক বছরে। হাসছো? তোমাদের গলির মুখে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় যে টিনশেডের বাড়িটা, প্রতিদিন সাতসকালে দেখো একটা মানুষ তাড়া-খাওয়া-বিড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে পড়ে, ত্রিসন্ধ্যায় ক্লান্ত মুঠের মতো কাঁধের ঝোলাটা টেনে কোন প্রকারে বাড়ি ফেরেÑ ভাবছো আমাকে! ধুর, এ আমি নই। তুমি তখন বয়:সন্ধির মধ্যগগনে; ঠিক দুপুরের রোদের মতো ঝলমল করছ, হাবুডুবু খাচ্ছো আয়নায়Ñ নিজের রূপে নিজেই। হঠাৎ কি ভেবে পাড়ার এক বখাটে ছোঁড়াকে ডেকে এনে তার হাতে গুঁজে দিলে গোলাপ নয়, প্রেমপত্র নয়- জীবন্ত একটি মানুষের হৃদপিণ্ড।

ছোঁড়াটা ঐ বাসায় থাকত। তার দস্যিপনায় তোমাদের সবার ওষ্ঠাগত প্রাণ। রাত-বিরাতে ওর খোঁজে পুলিশ এসে হানা দেয়। ভয় নেই, শংকা নেই। দড়িছেঁড়া মোষের মতো কেবল ছোটে আর ছোটে।

মাঝরাতে ঘুম না এলে জানালায় এসে দাঁড়িয়ে দেখো কারা যেন বড়ো রাস্তার ফুটপাতে বসে চিকা মারছে। তুমি বেশ বোঝো, কালো লিকলিকে যে ছেলেটা স্বৈরাচারীর দীর্ঘ ই-কারে রং চাপাচ্ছে সে আর কেউ নয়, তোমারই মনোভূমির জমিন্দার। ততদিনে হাওয়ায় তোমার সুরভি ভাসে। ভিনদেশী বণিকেরা এসে ভিড়ে তোমাদের ঘাটে। ছেলেটা তোমাকে আগলে রাখে বুকের ভেতরে।

অন্যপাড়ার ছেলেরা এলে জর্দার কৌটো মেরে উড়িয়ে দেয়। কী সাহস- তুমি মুগ্ধ হও। তুমি আরো মুগ্ধ হয়েছিলে ছেলেটার ঠোঁটে প্রথম তামাকের শলাটি দেখে। তোমাকে তন্দ্রায় ডুবিয়ে দিয়েছিল নি:শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসা গোল গোল শুভ্র ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তুমি এ্যাডভেঞ্চার বড়ো ভালো পাও।

তোমার দেশের রাজা তখন একজন কবি। বড়ো ভালো মানুষ(!) তিনি। তাকে দেখে সবাই জয়ধ্বনি দেয়। কেবল ঐ ছেলেটার মতো কয়েকটা ‘রেজিল পোলাপাইন’ তাকে নিয়ে মশকারি করে। মিছিল হয়, দেয়ালের পর দেয়াল লক্ষ লক্ষ শ্লোগানে আর্তনাদ করে ওঠে, পথে পথে জলকামান, ভোর হয় পত্রিকায় রক্তাক্ত লাশের উৎসব ছড়িয়ে।

সে বড়ো ভয়াবহ দিন। কবিরাও তো মানুষ। তাদেরও রাগ আছে, ক্ষোভ... লিপ্সা... কাম...। রাজা ক্রুব্ধ হোন। এক সকাল কিংবা ভোরে রাজার লাঠিয়াল এসে ধরে নিয়ে যায় ছেলেটিকে।

এরিমধ্যে তোমার কন্যাদায়গ্রস্ত ভীরু কৈরাণিক পিতা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। এমন রাজকন্যার মতো মেয়েকে আগলে রাখার মতো শক্তি তার নেই। একদিন তোমাদের বাসায় সানাই বেজে উঠল। টুকটুকে এক কিশোরী বধূ ছোট্ট গাড়িটার উইন্ডশিল্ডে নাক ঠেকিয়ে চলে যায়। ভুতুর দোকানের সামনে থানার গাড়ি এসে থামে।

একটা আধ ন্যাংটা ছেলেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশে। কী হয়েছিল তোমার? বছর না ঘুরতেই চলে এলে একদিন। আমি তখন রোজ দুপুরে দুজনের কোলে চেপে বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গাটুকুতে এসে বসি। রোদে একটু একটু করে পা-পিঠের ঘা শুকায়। তুমি ব্যালকনির গ্রিল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকো।

আমি তাকিয়ে থাকি মাটির দিকে। যন্ত্রণার নদীগুলিতে ধীরে ধীরে ভাটা লাগে। শুকিয়ে আসে কবির মাংস খুঁটিয়ে তোলা বর্নমালাগুলি। শুকিয়ে যাই আমিও। শুকোতে শুকোতে নিঃশেষ....।

আমার পড়ে থাকা দেহে আরেকটি পরজীবি সত্ত্বা এসে বাসা বাঁধে। সেও দীর্ঘপথ হেঁটে এসেছে, বড়ো তৃষ্ণার্ত এখন। একফোঁটা জল হবে? তোমার ঠোঁটে আগে কতো বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা লেগে থাকত। রোজ বিকেলে একটা চাতক পাখি এসে চুষে চুষে খেতো। আজ হবে একফোঁটা জল? জানুয়ারি ২০০৩


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।