ব্লগের একটি জনপ্রিয় বিষয় হচ্ছে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক। এই বিতর্ক বেশ উপভোগ্যও। এই ধরণের বিতর্ক সাধারণত একটা প্যাটার্ণ মেনে চলে। আমার দৃষ্টিতে ব্লগে এই বিতর্কের ফ্লো ডায়াগ্রাম অনেকটা এরকম:
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পোস্ট যুক্তি- পাল্টা যুক্তিতে আটকে থাকে। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য।
কিন্তু সেই উপভোগ্য ব্যাপারটাই কদাকার রূপ ধারণ করে যখন এটা গালাগালির চক্রে গিয়ে পড়ে। যুক্তি-পাল্টা যুক্তির চক্র হতে কাঙ্খিত ফলাফল ছিল যুক্তিপূর্ণ উপলব্ধি। কিন্তু সেটা যখনই গালাগালির চক্রে আবদ্ধ হলো, কাঙ্খিত ফলাফলের আশাও তিরোহিত হল। এখান থেকে আর যুক্তিপূর্ণ উপলব্ধিতে ফিরে আসা সম্ভব নয়। এই চক্র হয় অনবরত চলতে থাকবে, না হয় এর ওপর ভিত্তি করে আরো হাফ ডজন কাউন্টার পোস্ট আসবে।
কিন্তু কাঙ্খিত ফল আর পাওয়া যাবে না। আমার অবলোকন করা প্রতি ১০০ টা বিতর্কের অন্তত ৮০ টা নষ্ট হয়েছে গালাগালির কারণে।
আমার আজকের পোস্ট এই বিতর্কের একপক্ষ, মানে নাস্তিকদের নিয়ে। বিতর্কে তাদের আচরণ নির্মোহভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো এখানে। আরেকদিন আরেক পোস্টে আস্তিকদের নিয়ে লিখবো।
নাস্তিকরা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন কারণে। অনেক সময় তাদের পোস্টেই বিতর্কের সূত্রপাত। আবার অনেক ক্ষেত্রে আস্তিকদের (তাদের মতে) কুযুক্তির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
নাস্তিকরা যেসকল বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এই লড়াই চালিয়ে যান তার একটা লিস্ট দেয়ার চেষ্টা করবো (ব্রাকেটে [ ] তাদের এই বিশ্বাসের ব্যাপারে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত তুলে ধরবো)
ক. ধর্মই সকল কু-সংস্কারের মূল [মূল না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই সহায়ক। তবে মনে রাখতে হবে, ধর্ম না থাকলে যে সমাজে কুসংস্কার থাকতো না এটা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না]
খ. ধর্ম যুক্তিবিরোধী, অযৌক্তিক অন্ধ-বিশ্বাস [অবশ্যই সত্য।
ধর্মের ভালো ফলাফল পেতে হলে আপনাকে অযৌক্তিকভাবেই ধর্মের মূল ধারণাগুলো বিশ্বাস করতে হবে। এর ব্যাপারে সন্দেহ চলে এলে আপনি ধর্মের সুফলগুলো থেকে বঞ্চিত হবেন। ধর্মের কুফল-সুফল সম্পর্কে আমার ধারণা পরে ব্যাখ্যা করছি]
গ. ধর্ম/ধর্মবিশ্বাসী না থাকলে পৃথিবী আরো বেটার প্লেস হতো [আর ইউ শিওর?]
ঘ. ধর্মসমূহ প্রগতি ও বিজ্ঞান বিরোধী [অনেকাংশে সত্য। নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয় এরকম প্রগতি বা জ্ঞান ধর্ম সহ্য করতে পারে না। সে নিজেকে মানুষের জন্য সবচেয়ে কল্যানকর মনে করে এবং যেই তার বিরোধীতা করে তাকে মানুষের জন্য অকল্যাণকর, শয়তানের কাজ বলে মনে করে]
ঙ. ধর্ম মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষের মূল কারণ [ কিছুটা সত্য, বেশিরভাগই মিথ্যা।
হিংসা-বিদ্বেষের দানব মানুষের অভ্যন্তরে অনেক কারণেই জন্মায়। সে এই দানবের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ধর্ম, ভাষা, বর্ণ, পেশা, লিঙ্গ অর্থাৎ এমন কোন বিষয় নেই যা ব্যবহার করে না। ধর্ম যতটা না হিংসা-বিদ্বেষের উৎস্য তার চেয়ে বেশি হিংসা-বিদ্বেষের টুল হিসেবে ব্যাবহৃত। যেসকল দেশে সবাই মুসলিম সেখানেও কিন্তু শিয়া-সুন্নি বিভেদ রয়েছে। ভাষার ওপর ভিত্তি করেও যে বিভেদ জন্মাতে পারে সেটার প্রমাণ তো ৭১ পূর্ব বাংলাদেশের দিকে তাকালেই দেখা যাবে।
]
এবার আসা যাক বিতর্কে নাস্তিকদের কাঙ্খিত ফলাফল কি?
হিটাকাঙ্খী পাগল নাস্তিকদের বাদ দিলে বাকিদের উদ্দেশ্য সম্ভবত এরকম:
১. সবাই ধর্মের ভন্ডামী ধরতে পারবে এবং এর সম্পর্কে সচেতন হবে।
২. কল্পিত ঈশ্বরের ওপর ভরসা না করে নিজের ওপর আস্থা নিয়ে কাজ করবে।
৩.ধর্মের নামে হানাহানি থেকে বিরত থাকবে। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত মনোভাব গড়ে উঠবে।
৪. বিজ্ঞানমনস্ক মানসিকতা গড়ে তুলবে।
৫. ধর্মের নামে যেসকল অমানবিক প্রথা রয়েছে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবে।
৬. যারা ধর্মের নামে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তাদের ফাঁদে পা দেবে না।
এবার আসা যাক বিতর্কের নামে গালাগালি করা কেন অযৌক্তিক সে বিষয়ে।
ক. আপনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আস্তিকদের (আপনার মতে) ভ্রান্ত ধারণ দূর করা। একটু ভেবে দেখুন মানুষ কার মতামত গ্রহণ করে আর কারটা বর্জন করে! আপনার সামনে দুজন ব্যাক্তি, একজন আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু আর আরেকজন আপনার চিহ্ণিত শত্রু।
এদের মধ্যে কার পরামর্শ/মত আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে আর কারটা বর্জনীয় হবে?
একজন আস্তিকের জীবনে ধর্ম একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার ধর্মবিশ্বাস তার কাছে অনেক ক্ষেত্রে নিজের বা পরিবারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আপনি তাকে দায়ী করতে পারেন না, কারণ ছোটবেলা হতেই তিনি এই বোধ নিয়ে বড় হয়েছেন। যে যেই বিষয়ের জন্য দায়ী নয় সেই বিষয়ের জন্য তার শাস্তি/গালি ও পাওনা নয়।
এখন, আপনি যখনই ধর্মকে গালাগালি করছেন, আপনি তার শত্রুতে পরিণত হচ্ছেন।
শাহরুখ খানের ফ্যানদের সামনে তার সম্পর্কে বাজে কথা বললে তারা যেমন কষ্ট পান এবং ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, একজন ধর্মবিশ্বাসীর কাছে তার ধর্ম সম্পর্কে বাজে কথা বললে তিনি এর চেয়ে অনেকগুন বেশি কষ্ট পান, আরো বেশি ক্ষিপ্ত হন, আপনাকে শত্রু ভাবতে শুরু করেন। আর যারা আপনার কাজের প্রতিবাদ করছেন তাদেরকে পরম বন্ধু মনে হয়। এরপর আপনি যত অকাট্য যুক্তিই দিন না কেন আপনার যুক্তিকে তার কাছে দুষ্টের ছল ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। আপনার উদ্দেশ্য অন্তত এই দফা ব্যার্থ।
খ. অনেকসময় কিছু যুক্তি-তর্ক পুরোটাই উদ্দেশ্যহীন।
মনে করুন, কেউ একজন পোস্ট দিলেন, "মুহাম্মদ (সা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি। " আর আপনি তার যত (আপনার দৃষ্টিতে) অপকর্ম আছে সবগুলোর ফিরিস্তি দিয়ে ইচ্ছামত গালাগালি করলেন। বললেন, তিনি যুদ্ধবন্দী ধর্ষণ করতেন, বাচ্চা মেয়ের সাথে যৌনকর্ম করতেন, পুত্রবধুকে কায়দা করে বিবাহ করেছেন ইত্যাদি। আপনার কথা হয়তো পুরোপুরিই সত্য। এখন দুজন আস্তিকের কথা চিন্তা করেন।
একজন, যে এই ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক মনে করে। তার কাছে এগুলো গালি মনে হবে না। কারণ এগুলো তার কাছে যৌক্তিক মনে হবে। সে কখনো আপনার কথার প্রতিবাদও করবে না। মনে মনে ভাববে এগুলো খুবই পূন্যের কাজ, নবীর সুন্নত।
আপনার কথার প্রতিবাদ করবে কে? যার কাছে এই কাজগুলোকে ঘৃণ্য মনে হবে। নবীর যে ইমেজ তার মনে রয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচিত হওয়ায় সে ইমেজ রক্ষার্থে বিভিন্ন যুক্তি দিতে থাকবে। আর আপনিও তার যুক্তি খন্ডন করতে গিয়ে গালাগালিতে জড়িয়ে পরলেন। ব্যাপারটা কি সেম সাইড হয়ে গেল না? আপনিও বিশ্বাস করেন কাজগুলো খারাপ; সেও বিশ্বাস করে কাজগুলো নবী করে থাকলেও হয়তো বিশেষ কারণ করেছে, এখনকার নৈতিকতা অনুসারে কাজগুলো খারাপ। দুজন যেহেতু এই বিষয়ে একমত, তাহলে তর্কেরই তো কোন প্রয়োজন নেই, গালাগালি তো দুরের কথা।
গালাগালির পরিবর্তে গলাগলিই বেশি যুক্তিযুক্ত।
গ. আমার এবারের যুক্তিটা সবচেয়ে মোক্ষম। গালাগালি করে হয়তোবা বাচ্চাদের আচরণ পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক কারো মনোভাব পরিবর্তন করা যায় না। তার মনোভাব পরিবর্তন করার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে তার আস্থা অর্জন করতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে আপনার বিশ্বাস/যুক্তির কথা উপস্থাপন করতে হবে। জোড় খাটালে আপনার মিশন ব্যর্থ।
নাস্তিকদের কিছু কিছু আচরণ অযৌক্তিক ই নয়, অমানবিকও বটে। মানুষ মাত্রই মনে কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হয়, নিজের উৎস্য, গন্তব্য, অস্তিত্ব নিয়ে। ধর্ম সত্য-মিথ্যা যাই হোক এই প্রশ্নের একটা জবাব তাকে সরবরাহ করে। যারা বিজ্ঞানমনস্ক, তারা উত্তর খোঁজে বিজ্ঞানে। তবে সবাইকে যে বিজ্ঞানমনস্ক হতেই হবে এরকম লিখিত দলিল করে তো সবাই পৃথিবীতে আসেনি।
সাড়ে ছয় কোটি লোকের সাড়ে ছয় কোটি ধরণের মানসিকতা। একটা বড় অংশই বিশ্বাসের মাঝেই মুক্তি খুঁজে বেড়ায়। এখন এই সামান্য অপরাধে তাকে/তার বিশ্বাসকে গালাগালি করাটা কতটা মানবিক? এই লোক যদি আজ ঈশ্বরে অবিশ্বাস শুরু করে, তবে কাল থেকেই বিপদে আপদে আশ্রয় খুঁজে পাবে না। সে তো আপনার মত আত্মবিশ্বাসী নয়। তার জন্য ঈশ্বরই সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
আপনার কি অধিকার রয়েছে তার সেই নিরাপদ আশ্রয় কেড়ে নেয়ার?
নৈতিকতা নির্মানে ধর্মের আবশ্যকতা বা কার্যকারিতা বিষয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে একটা বিষয়ে সকল মনোবিদ-চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একমত। সেটা হলো বিশ্বাসের প্লাসিবো ইফেক্ট। আপনি বিজ্ঞান-মনস্ক, যুক্তিমনস্ক। আপনার বিশ্বাস বিজ্ঞান ও যুক্তিতেই আপনার মুক্তি।
এটাই আপনার মনো-দৈহিক সমস্যায় প্লাসিবো ইফেক্ট হিসেবে কাজ করে। যে ব্যাক্তি ধর্মবিশ্বাসী তার জন্য ধর্ম অন্তত এই একটি কারণেই দরকার। এটাই তার আত্মবিশ্বাসের উৎস্য।
৭১ এ আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নাম-মাত্র অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে খোদা-ভগবানের ওপর বিশ্বাস নিয়ে যুদ্ধ করেই দেশ স্বাধীন করেছে। ঈশ্বর তাদের সাথে আছেন, শুধুমাত্র এই বিশ্বাসই তাদের শত প্রতিকুলতার মাঝে সাহস যুগিয়েছে।
আসুন সবার বিশ্বাসের ওপর সম্মান রাখি। যুক্তি-তর্ক-বিজ্ঞান সবই দিতে পারে, কিন্তু মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে না। সেটার জন্য আপনার দরকার বিশ্বাস, হোক সেটা বিজ্ঞানের শক্তির প্রতি, হোক সেটা কল্পিত ঈশ্বরের প্রতি। একজন যুক্তিবাদী হিসেবে বিশ্বাসের শক্তির বিষয়টি মেনে নিন। যুদ্ধ করুন ধর্মের নামে অধর্মের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, মানুষের নির্দোষ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।