আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি জাতীয় নদীও চাই, কি বলেন?



জাতীয় নদী? যদিও মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে; যদিও জাতীয় ফুল-ফল, মাছ-পাখি রয়েছে; নদীর প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন বিলক্ষণ উঠতে পারে। কারণ জাতীয় নদীর ধারণাটা একেবারে সীমিত। স্বীকার করে বলি, আম বৃক্ষের মর্যাদা বৃদ্ধির খবর পেয়েই মূলত জাতীয় নদীর বৈশ্বিক চিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে থাকি। আগেই জানতাম, গত বছর বহুল আলোচিত গঙ্গাকে ভারত জাতীয় নদী ঘোষণা করেছে। আরও বিস্তারিত জানতে গিয়ে দেখা গেল, ওই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে রীতিমতো আনুষ্ঠানিকভাবে।

গত ৪ নভেম্বর নয়াদিলি্লতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বাড়তি দায়িত্বে থাকা মনমোহন সিংয়ের সভাপতিত্বে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা কেবল নয়, এ উপলক্ষে পালিত হয়েছে ধর্মীয় আচারও। নদীটি যদিও গোটা গতিপথে অবস্থিত ২৯টি নগরী, ৭০টি শহর ও হাজার হাজার গ্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৩০ কোটি লিটার মানববর্জ্য, ২৬০ মিলিয়ন লিটার শিল্পবর্জ্য এবং বিভিন্ন তীর্থস্থানের পূজার বর্জ্য নিয়ে বয়ে চলছে; এর পানি ভক্তদের কাছে পরম পবিত্র বিবেচিত। পবিত্র নদী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার পর ৯ নভেম্বর বারানসিতে বিশেষ প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়। তাতে অংশ নেয় হাজার হাজার পুণ্যার্থী।

আমাদের অনেক উদ্যোগের মতো গঙ্গাকে জাতীয় নদী ঘোষণা করেই ভারত সরকার খালাস হয়নি। এর 'মর্যাদা' রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে প্রধান এবং যেসব রাজ্যের ওপর দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছে, সেগুলোর মুখ্যমন্ত্রীকে সদস্য করে একটি কমিটিও গঠিত হয় একই সভায়। ধারণা করেছিলাম, পরমাণু অস্ত্র থেকে ক্রিকেট খেলা- সব বিষয়ের মতো জাতীয় নদীর ক্ষেত্রেও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান পাল্লা দেবে। চোখ বুজে এটাও বলে দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে সিল্পুব্দই হবে দেশটির প্রথম পছন্দ। ধারণা ঠিকও হয়েছে।

কিন্তু বিষয়টি ভারতের মতো স্পষ্ট নয়। নেট ঘেঁটে দেখা গেল, পাকিস্তান সিল্পুব্দকে 'কওমি দরিয়া' বা জাতীয় নদী ঘোষণা করলেও আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা নেই। তবে তারা একধাপ এগিয়ে সিল্পুব্দ দিবস ঘোষণা করেছে। এ বছর ২৪ জানুয়ারি সূচিত ওই দিবস এখন থেকে প্রতি বছর পালিত হবে। জাতীয় নদী ঘোষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু পাকিস্তানের বেলায় যদিও ধারণার সঙ্গে বাস্তবতা মিলে গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় গিয়ে অনেকটা আক্কেল গুড়ূম হওয়ার অবস্থা। একটি দেশে কত নদী থাকতে পারে? নদীর সংখ্যা নিয়ে আমরা আকসার গর্ব প্রকাশ করি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আইডি নম্বরধারী নদীর সংখ্যা ৩৩০। সংখ্যাটিকে বাড়িয়ে কেউ কেউ সাতশ' কিংবা হাজারও বলেন। আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় ৬৭ গুণ বড় যুক্তরাষ্ট্রে নদীর সংখ্যা কত? আড়াই লাখ! প্রথমে বিশ্বাস হতে চায়নি।

চেক-ক্রসচেক করে দেখেছি, আড়াই লাখই। পরে মানচিত্র দেখেছি, নদীতে নদীতে নীল। চিরুনির মতো নদী। হতে পারে সব নদী দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সমান নয়। কিন্তু মোট দৈর্ঘ্য দেখা যাক- ৫৬ লাখ ৩২ হাজার ৭০৪ কিলোমিটার।

নদীবহুল যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নদী নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো একটি নয়, বিভিন্ন বিবেচনায় পাঁচটি প্রবাহকে জাতীয় নদী ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালে বাফেলো রিভারকে প্রথম জাতীয় নদী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৮ সালে প্রণীত হয় 'ওয়াইল্ড অ্যান্ড সিনিক রিভার অ্যাক্ট'। এর ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে আরও চারটিকে জাতীয় নদী হিসেবে ঘোষণা করা হয়_ মিসিসিপি, বিগ সাউথ ফর্ক, নিউ রিভার ও ওজারাক।

জাতীয় নদীগুলো নির্বাচিত হওয়ার কারণও ভিন্ন ভিন্ন_ কোনোটি সবচেয়ে দূষণমুক্ত, কোনোটি সবচেয়ে প্রাকৃতিক, কোনোটি সুদৃশ্যতম, কোনোটি আবার প্রবাহিত হয়েছে ঐতিহাসিক সব স্থানের মধ্য দিয়ে। আবার বাফেলো ছাড়া বাকি চারটি নদীর পুরো অংশ 'জাতীয়' ঘোষণা করা হয়নি। যে অংশ নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে পড়েছে, শুধু সেটুকু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র- এ তিনটি দেশের বাইরে আর কোথাও খুব সম্ভবত জাতীয় নদী নেই, অন্তত আমার জানামতে। জাতীয় নদী ঘোষণার প্রয়োজনীয়তার বিপক্ষে যুক্তিও রয়েছে।

শত শত নদীর দেশে একটি নদীকে আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন কী? এও বলা যেতে পারে যে, একটি নদীকে জাতীয় ঘোষণা করে বাকিগুলোর ব্যাপারে কী হবে? কোনো কিছুকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানের সাধারণ কারণ হচ্ছে, সেটার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া। তাহলে বাকি নদীগুলোর ব্যাপারে কি আমরা কম মনোযোগী হবো? হতে পারে কোনো একটি নদীকে যদি জাতীয় ঘোষণার আলাদা তাৎপর্য নেই; কিন্তু এই প্রশ্ন তো ফুল, ফল, বৃক্ষ, পাখি- জাতীয় ঘোষিত সবকিছু সম্পর্কেই তোলা যেতে পারে। এটাও ঠিক যে, আমাদের জাতীয় পশু বাঘ এখন বিপন্নপ্রায়, জাতীয় ফল কাঁঠাল নীতিনির্ধারকদের অগোচরে নিজগুণে উৎপাদিত হয়ে চলছে। ব্যাপক আকার ও ফলনের এ ফলের পুষ্টি ও বাজার সম্ভাবনা একেবারেই খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। কিন্তু সেটা আমাদের কপালের ফের।

ভারতে দেখা যাচ্ছে, বিপন্ন ময়ূরকে জাতীয় বিহঙ্গ ঘোষণা করে সেটা রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। গঙ্গাকে জাতীয় নদী ঘোষণার পর সেটাকে পুনরুদ্ধারে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে 'ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি'। তার মানে কোনো কিছুকে জাতীয় ঘোষণাই শেষ কথা নয়; আসল হচ্ছে কাজ করা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য যে বিষয়টি কঠিন হতে পারে তা হচ্ছে, কোন নদীকে 'জাতীয়' ঘোষণা করা হবে? কারণ আমাদের নদীগুলো ছড়িয়ে আছে জালের মতো।

আক্ষরিক অর্থেই। কর্ণফুলীর মতো দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি নদী কোনো না কোনোভাবে আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বে আরও বদ্বীপ অববাহিকা আছে- অনেক বড় আমাজন কিংবা ঘরের পাশে ইরাবতি। কিন্তু গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মতো তিনটি প্রধান নদী এক মোহনায় এসে মিশেছে- এমন দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়টি নেই। জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাহগুলো এ তিনটি বৃহৎ নদীধারারই শাখা-প্রশাখা কিংবা শিকড়।

কোনটা ছেড়ে কোনটিকে স্বতন্ত্র ধরে 'জাতীয় নদী' ঘোষণা করা হবে? ভারত ও পাকিস্তান তাদের প্রধান প্রবাহ যথাক্রমে গঙ্গা ও সিল্পুব্দকে জাতীয় নদী ঘোষণা করেছে। আমাদের প্রধান তিনটি নদী- পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা কি এমন মর্যাদা পেতে পারে? মুশকিল হচ্ছে, তিনটি নদীর উৎপত্তিই আমাদের দেশের বাইরে। পদ্মা তো গঙ্গারই অপর নাম। যমুনাও বিভিন্ন নামে- সাং পো, ডিহং; ব্রহ্মপুত্র- তিব্বত, অরুণাচল, আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মেঘনার উৎপত্তিও দেশের বাইরে।

বরাক নদীর বিভক্ত ধারা সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফের মিলিত হয়েই আসলে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। তারপরও মেঘনাকে এগিয়ে রাখা যায়। কারণ দেশীয় প্রবাহ পথের দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এটা সবচেয়ে বড় এবং মোহনার কাছে দেশের প্রায় সব নদীকে ধারণ করে সাগরে মিশেছে। দেশের ভেতরেই উৎপত্তি ও পতন- এমন নদী যদি বেছে নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে কর্ণফুলী থাকবে সবার শীর্ষে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপন্ন ১৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীতে যদিও অতি সামান্য পরিমাণে সীমান্তের ওপারের পানি মিশেছে, তা ধর্তব্য নয়।

যে কারণে ৫৭ আন্তর্জাতিক নদীর তালিকায় কর্ণফুলীর নাম নেই। বিতর্ক এড়ানোর জন্য আমরা ভারতের বদলে মার্কিন মডেলের অনুসরণে একাধিক জাতীয় নদীও ঘোষণা করতে পারি। মোট কথা, জাতীয় নদী ঘোষণা করা হবে কি-না, সেটা সবচেয়ে জরুরি। নীতিগত সিদ্ধান্ত হলে উপযুক্ত উপায় খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। দশক দশকের অবহেলায় আমাদের স্বচ্ছতোয়া নদীগুলো তো মরতেই বসেছে।

সন্দেহ নেই, এগুলোকে সচল ও স্বাস্থ্যবান করতে হলে কেবল জাতীয় নদী ঘোষণা নয়, আরও অনেক কাজ করা দরকার। কিন্তু এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় আর কিছু না হোক, নদীর ক্ষতি হবে না। নদী বিষয়ক চিন্তা ও তৎপরতায় উৎসাহই বরং বাড়বে। সমকাল, ডিসেম্বর ৮, ২০১০

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.