আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাপিত জীবন

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

আয়োজন করে গল্প বলতে বসেছি। আমার ধারণা, আমার গল্প বলা খুবই বাজে ধরনের। কথায় আঞ্চলিকতার টান, গলার স্বরও ফ্যাসফেসে। তাই গল্পের আসরে কোনভাবে পাত্তার ধারে কাছে আমি থাকি না। তবে বিন্তার কাছে আমি জগৎ শ্রেষ্ঠ গল্প বলিয়ে।

সে একদিন তার মায়ের সামনে বলেছে বড় হয়ে চাকরি-টাকরি করে টাকা-পয়সা জমলে আমার জন্য মেডেলের ব্যবস্থা করে দেবে। তাও যে সে মেডেল নয়, একেবারে স্বর্ণের । আজকাল নাকি এইসব মেডেলে খাঁটি স্বর্ণের পরিমান কম থাকে। মেডেলের কথা শুনে স্থানীয় এক স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। আমি গল্প বলায় কতোটা অগোছালো তা নিশ্চয়ই আপনি এতোক্ষণে বুঝে গেছেন? কী করবো বলেন, গল্প বলা শুরু করলে নানা প্রসঙ্গ মাথায় চলে আসে।

গুরুত্বের ক্রম ঠিক করতে করতে হয়রান হয়ে নানামুখী বিষয়ের অবতারণা করে ফেলি। দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন । আপনি যে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন তা আমি জানি। আপনিও নিশ্চয়ই গল্প বলার সাথে অল্পবিস্তর পরিচিত। আর জানেনই তো গল্প বলা মানেই এক ধরনের আর্ট।

আর্ট ফার্টে একটু আধটু অগোছালো ভাব থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এজন্যই নাকি চিত্রকররা চিত্রকর্মের মধ্যে তুলি দিয়ে মাঝেমধ্যে অগোছালো টান দিয়ে দেন। আমরা দর্শকরা চিত্রপ্রদর্শনীতে গিয়ে সেই ছবি মুগ্ধ হয়ে দেখি। যতো বেশি পরাবাস্তব ছবি ততো বেশি দামে বিকায়। এই কথাগুলো অবশ্য আমার না।

আমার জুনিয়র বান্ধবী লামিয়ার কথা। লামিয়া চারুকলার ছাত্রী। হুটহাট আমার চিলেকোঠার বাসায় এসে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ গল্প করে, নিজ হাতে চা বানিয়ে খেয়ে আমাকে না জানিয়েই বিদায় নেয়। লামিয়ার কাছ থেকে জলরংয়ের পাঠ নিচ্ছি।

কাজ হচ্ছে, রঙ নিয়ে ঘষাঘষি। আগে নাকি রঙয়ের ভাষা বুঝতে হবে। আমিও অপেক্ষা করছি, কোন একদিন গোলানো রং কথা বলে উঠবে, হ্যালো স্যার আপনার তুলিতে আমাকে জড়িয়ে অগোছালো একটা টান দেন। সরলরেখার ওপর নব্বই ডিগ্রি কোণে আরেকটা রেখা। তারপর কিছু বৃত্ত।

আমিও রঙয়ের ভাষা মান্য করে পরাবাস্তব চিত্রকর্মের শিল্পী হয়ে উঠবো। অবশ্য আমার ভাবনাগুলো লামিয়া জানতে পারলে খবরই আছে। শিল্প নিয়ে ফাজলামি সে খুবই অপছন্দ করে। শিল্প নিয়ে হাসির কিছু বলতে গেলেই চোখ বড় বড় করে বলে- নো অং বং। এই অং বং এর মানে উদঘাটনে আমি ব্যর্থ।

লামিয়ার সাথে আমার পরিচয়ের ঘটনাটি বেশ মজার। শীতের রাতে বাসায় ফিরছিলাম। সেই রাতে হঠাৎ করেই বৃষ্টি নেমে আবার থেমে গেল। রাস্তায় লোকজনের সংখ্যা খুবই কম। ভয় নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম।

কিছুক্ষণ পরই অনিন্দ্য সুন্দরী এক তরুণীর দেখা। দেখেই আমার ভয়াবহ অবস্থা। হার্টবিট বেড়ে গেছে। হার্টবিট যেন বলছে, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই! থাক, আপনাকে নানামুখী আলাপ করে বিরক্ত করতে চাই না। পরিচয়ের এই গল্প মেলা বড়।

অনেকেরই কাছে এই গল্প বলে ফেলেছি। আপনাকে পুরনো একটা বিষয় বলবো এমনটা যেন ভুলেও ভাববেন না। গল্পটা প্রতিবার বলার সময়ই নতুন নতুন বিষয় মনে পড়ে। তাই এক ধরনের আনকোরা ফ্লেভার পাবেন। আসল কথায় ফিরে আসি।

বলছিলাম, আয়োজন করে গল্প বলতে বসেছি। আমি নিজেকে বস্তাপচা ধরনের গল্প বলিয়ে মনে করলেও বিন্তা মনে করে আমি খুবই ভালো গল্প বলি। গল্পের হিপনোটিজমের গুন নাকি আমার মধ্যে আছে। আফ্রিকার কিছু মানুষ নাকি হিপনোটাইজ করে দূর থেকে চামচ বাঁকিয়ে ফেলতে পারতো। আর আমি নাকি গল্প বলে মানুষের মন বাঁকিয়ে দিতে পারবো।

অবশ্য মন বাঁকানোর ব্যাপারটি নিয়ে বিন্তার সাথে খোলাখুলি আলাপ হয় নি। এই মেয়েটার কথার কোন সেন্সর নেই। কখন আবার কী বলে ফেলে এই ভয়ে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করি না। একবার হুট করে আমার রুমে এসে বলে বসলো- আমার আম্মাজান তো মাইনকা চিপায় পড়েছে। মুরুব্বী একজন মানুষকে নিয়ে এই ধরনের কথা শুনে আমি রীতিমতো হতভম্ব।

এই হতভম্ব অবস্থা কাটতে কাটতেই পুরো ঘটনা শোনা গেল। টিভির রিমোট হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেছে। যার ফলে বিন্তার মা ইচ্ছামতো যখন তখন চ্যানেল পরির্বতন করে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে পারছে না। এটাকেই বিন্তার কাছে মাইনকা চিপা মনে হয়েছে। বিন্তা মাঝেমধ্যেই খাবার টাবার নিয়ে আসার বাহানায় ছাদের রুমে আসে।

দুই রুমের বাসা। আলাদা রান্নাঘর। এক রুমে আমি আরাম আয়েশ করে থাকি, আরেক রুমে কেবল বই আর বই। কোন বুকসেলফ নাই, চেয়ার টেবিল নাই। ওই রুমে বই পড়তে হলে ফ্লোরে বসে পড়তে হয়।

সবার জন্যই একই নিয়ম। এমনকি কখনো যদি প্রধানমন্ত্রীও এই রুমে বই পড়তে আসেন তাকেও ফ্লোরে বসে বই পড়তে হবে। একটা ছোটখাটো ভুল হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর আগে মাননীয় শব্দটা বলতে ভুলে গিয়েছি। সময় খুবই খারাপ।

বিন্তার ভাষায় মাইনকা চিপাময়। দেখা গেল হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আমার নামে রুল জারি হয়ে গেছে। ‘প্রধানমন্ত্রীর নামের আগে মাননীয় যোগ না করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না?’ এই মর্মে সাতদিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ চলে আসলো। ছাদের চিলেকোটায় বেশ ভালো আছি। আইনি ঝামেলায় জড়াতে চাই না।

কথায় আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ৩৬ ঘা আর আইনে ছুঁলে ৭২ ঘা। কথাটা অবশ্য কিছুটা উল্টা পাল্টা হতে পারে। তো যা বলছিলাম, আয়োজন করে গল্প বলতে বসেছি। গল্পের শ্রোতা বিন্তা। আমার জন্য আমের শরবত নিয়ে এসেছে।

আমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে সে আমের শরবত নিয়ে এসেছে, বিষয়টা এমন নয়। তাকে দিয়ে আনানো হয়েছে। মানে তার মা রেহেনা আক্তার আমের শরবত বানিয়ে আমার জন্য পাঠিয়েছেন। একবার ওনার বানানো আমের শরবত খেয়ে প্রশংসা করেছিলাম। তারপর থেকে যখনই উনি আমের শরবত বানান তখনই আমাকে পাঠান।

আমের শরবত বানানোর প্রক্রিয়া বেশ সহজ। আমি বিন্তার মার কাছ থেকে শিখে নিয়েছি। প্রথমে দুই তিনটা কাঁচা আম নিতে হবে। কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে হবে। কয়েকটা কাঁচা মরিচও সঙ্গে কুচি কুচি করে কাটতে হবে।

মিষ্টি ফ্লেভার পেতে চাইলে দুই চামচ চিনি মেশানো যেতে পারে। পরিমাণমতো লবণ মেশাতে হবে। এইসব উপকরণ ব্লেন্ডার মেশিনে দিয়ে আমের শরবত করে ফেলা যায়। পরিবেশনের আগে অবশ্যই ফ্রিজে রাখতে হবে। যাদের ফ্রিজ নাই তাদের দুর্ভাগ্য।

ঠাণ্ডা আমের শরবতে একটু বিট লবণের গুঁড়া দিলে অন্যরকম টেস্ট আসে। অবশ্য বিট লবণের গুঁড়া দেওয়ার বিষয়টি বিন্তার মার রেসেপিতে ছিল না। আমি যোগ করে নিয়েছি। ফলাফল নিজেই টেস্ট করেছি। ভালো।

বিন্তার মায়ের বানানো শরবতে চুমুক দিয়ে বিন্তার দিকে তাকালাম। তখনই বিজলি চমকালো। আলোর কিছুটা অংশ হয়তো ঘরেও চলে আসলো। সেই আলোয় বিন্তাকে দেখে অন্যরকম মনে হলো। এইখানে আসার আগে সে বেশ সেজেগুছে এসেছে।

আমের শরবতে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখার আগেই ঝুম করে বৃষ্টি নেমে গেল। বিন্তা উচ্ছ্বসিত হয়ে বাইরে গিয়ে বৃষ্টি ধরে আবার ফিরে আসলো। এসেই বললো- মারুফ ভাই, আমি নিজেই এইবার মাইনকা চিপায় পড়ে গেছি। কিছুক্ষণ পর এইচবিওতে ফাটাফাটি একটা মুভি শুরু হবে। গত কয়েকদিন ধরে প্রমো দেখাচ্ছে।

নামটা ভুলে গেছি। মুভিটা মিস করতে যাচ্ছি। মেয়েটাকে শব্দ ব্যবহার বিষয়ক জ্ঞান দেওয়া বৃথা মনে করে হাই তুললাম। বললাম- কেন, রুম থেকে বের হয়ে চাইলেই তো নীচতলায় চলে যেতে পারো। বৃষ্টিতে তেমন ভিজবে না।

বিন্তা তখন বললো- পাগল হয়েছেন আপনি, এই বৃষ্টিতে আমি নিচে যাবো কীভাবে? তাছাড়া যুবতী মেয়েদের হুটহাট বৃষ্টিতে ভেজা উচিত না। দেখা গেল পাশের বাসার ছাদ থেকে কেউ ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকবে। আমি হেসে বললাম, তুমিতো পিচ্চি মেয়ে, মাত্র পড়ো ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে। এখনই নিজেকে যুবতী ভাবা শুরু করেছো? আপনি কিছুই জানেন না বলে বিন্তা চোখ মটকালো। কিন্তু মুভিটা দেখা উচিত।

যেন মুভি দেখতে না পারার দহনে জ্বলছে মেয়েটি। আমি চুপ করে রইলাম। নিরবতা ভেঙে বিন্তা বললো- তারচেয়ে আপনার গল্প শুনি। বলেই চেয়ারে দুই পা তুলে বসে পড়লো বিন্তা। আমি মনে মনে বললাম- পড়েছো মোঘলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।

বিন্তার সাথে যারা পরিচিত তারা জানেন, মেয়েটা যা বলে তা করে ছাড়ে। সুতরাং গল্প বলা বিষয়ক বিতর্ক সৃষ্টি করা অনর্থক। আমি গল্প বলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। একদিন হঠাৎ করেই আমার রুমে এসে বিন্তা প্রশ্ন করে বসলো- আচ্ছা আপনি কি কখনো প্রেম করেছেন? হুম। একবার প্রেমে পড়েছিলাম।

অনেকটা হুড়মুড়িয়ে পড়ার মতো। আমার হুড়মুড়িয়ে পড়া শুনে বিন্তা চেয়ার টেনে আরেকটু কাছে এসে বসলো। আমিও দ্বিগুন আগ্রহ নিয়ে বলা শুরু করলাম- আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। কারণে অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াই। বিকাল নামলেই টিএসসিতে চলে আসি, কোনো কোনো বিকালে হাকিম চত্বরের পাশের খালি জায়গায়।

চুটিয়ে গল্প করি। গল্পের বেশিরভাগ বিষয়বস্তু সমকালীন সাহিত্য। ক্রিয়েটিভ কিছু হচ্ছে না এই আফসোসের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছি আমরা আড্ডাবাসীরা। এর মধ্যেই হঠাৎ করে আমি একটা উপন্যাস লিখে বসলাম। তাও যে সে উপন্যাস নয়, তরুণ বয়সের রোমান্টিক উপন্যাস।

মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্পের নায়িকাকে তৈরি করলাম। নাম দিলাম মৌমিতা। উপন্যাস আড্ডবাসীদের বেশ প্রশংসা কুড়ালো। তারপরের কয়েকবছর আমি আর নতুন কিছুই লিখতে পারলাম না। আড্ডার প্রত্যেকেই তখন একের পর এক ক্রিয়েটিভ লেখা লিখে যাচ্ছে।

আমি আটকে থাকলাম সেই মৌমিতাতেই। নতুন গল্প যে লেখার চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু যতোবারই নায়িকা চরিত্র সৃষ্টি করতে যাই ততোবারই সামনে এসে ধরা দেয় মৌমিতা। অনেকটা অস্তিত্বে এসে ধরা দেওয়ার মতো। আমার সাহিত্য জগৎ মৌমিতাময় হয়ে গেল।

নতুন কোন কবিতাও লেখা হলো না। যদিও মাঝেমধ্যেই রোমান্টিক কবিতার লাইন আমায় মাথায় ঘুরপাক খেত। কাগজে তা আশ্রয় পেত না। কিংবা হয়তো মৌমিতা চাইতো না কবিতাগুলো অন্য কেউ পড়ুক, অন্য কেউ শুনুক। সাহিত্য জগৎ থেকে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত জীবনকে গ্রাস করতে লাগলো মৌমি।

একটা বিষয় বলা হয়নি, আমি তখন মৌমিতাকে আদর করে মৌমি নামে ডাকা শুরু করেছিলাম। ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমিকা মনে করতে লাগলাম মৌমিকে। ক্যাম্পাসে হাতে হাত ধরে ঘুরি, ডাকসুর ক্যাফেতে খেতে বসলে পাশের চেয়ার মৌমির জন্য খালি রাখি। আমার এই পরিবর্তন দেখে সহপাঠীরা মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করে, কি রে নতুন প্রেমে পড়েছিস নাকি? প্রতিউত্তরে আমার মুখে হাসি ঝুলানো দেখে তারা রহস্যে ভোগে। নাম জিজ্ঞেস করতেই রহস্য বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলি- মৌমিতা।

তারা তখন বায়না ধরে, ভাবির সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দিস। আমি মুচকি হেসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাই। তবে দিন দিন অবস্থা ভয়াবহ হতে লাগলো। ক্যাম্পাসে কোন জুটিকে হাতে হাত ধরতে দেখলেই মনে হতো আমার সামনে মৌমিতার বাড়ানো হাত। আমাকে তখনই স্পর্শ করতে হবে।

মাঝেমধ্যে মৌমিতার দেখা পেতে লাগলাম। মৌমিতায় আক্রান্ত ঘোর কাটলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে এসে। কার্জন হলের মাঠে এক বিকালে পরিচয় হলো এক উচ্ছ্বল তরুণীর সাথে। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী তরুণী। সে এক বিশাল কাহিনী।

এখন অবশ্য তা বলতে ইচ্ছা করছে না। বিন্তা এতোক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলো। আমি মনে মনে ধারণা করছিলাম সে একটি প্রশ্ন করবে, প্রশ্নটি কি তাও আমি ধারণা করতে পারছিলাম। হয়তো মনে করছেন আমার ইএসপি পাওয়ার বেশ ভালো। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।

মৌমিতার গল্প আমি যাকেই বলেছি সেই এই প্রশ্নটা করেছে। ‘মৌমিতার সাথে কি আপনার এখনো দেখা হয়, কথা হয়?’ বিন্তাও যথারীতি একই প্রশ্ন করলো। জবাবে আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। বিন্তা আর কথা না বাড়িয়ে নিচতলায় চলে গেল। এভাবেই চলে যাচ্ছিল সময়।

মাঝেমধ্যে বিন্তা খাবার নিয়ে চিলেকোঠায় আসতো, গল্প করতো, হাসাহাসি করতো, তারপর আবার চলে যেতো। এক বিকালে ছাঁদে বসেছিলাম। বিন্তা ছাঁদে উঠে কোন কথা না বলেই আমার পাশের চেয়ারটিতে বসে পড়লো। গম্ভীর মুখে বললো- আপনার জীবনের একটা ঘটনা শোনান। গম্ভীর মুখে হঠাৎ এই গল্প শোনানোর আবদার শুনে ভিমড়ি খেলাম।

বিন্তার স্বভাবের সাথে পূর্বপরিচিত বলে গাইগুঁই না করে গল্প বলা শুরু করলাম। তখন আমার ফুফুর বিয়ে। গ্রামের বিয়ে। আশেপাশের বাড়ির সবাই চলে এসেছে বিয়েবাড়িতে। বাড়িভর্তি মানুষ।

আত্বীয়স্বজনদের অনেকেই এসেছে। মেহেদি দেয়া হলো, গান হলো, একপ্রস্থ নাচও হলো। কিন্তু বিপত্তিটা বাঁধলো রাতে ঘুমাতে গিয়ে। রুম সংকটের কারণে একই বিছানায় অনেককে চাপাচাপি করে ঘুমাতে হবে। আমার এক মামাতো বোন ও আরেক খালাতো বোন তখন তাদের সাথে আমাকে থাকার প্রস্তাব দিয়ে বসলো।

সঙ্গে সঙ্গেই আমার মা তা অনুমোদন করে দিলেন। অন্য কোন ব্যাপার যেন মাথাতেই আনলেন না। মামাতো বোনটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড় আর খালাতো বোন তিন বছরের বড়। অবশ্য একসাথে থাকতে চাওয়ার বিষয়টা খানিক পরে টের পেলাম। আমাকে হাসির গল্প শোনাতে হবে।

সে না হয় হলো। সমস্যাটা হলো গল্প শেষে ঘুমানোর পর। গল্প ভালোমতো শোনার স্বার্থে আমাকে দুইজনের মাঝখানে জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। ঘুমানোর সময় দেখা গেল যেদিকেই ফিরি সেদিকেই বোনেরা। মহা সমস্যায় পড়েছিলাম।

বলেই হা হা করে হাসতে লাগলাম। বিন্তা গম্ভীর হয়ে বললো- এই আপনার গল্প? তুমি এতো সিরিয়াস মুডে কথা বলছো কেন? এইটা আমার ছোটবেলার কাহিনী। ছোটবেলায় এইরকম ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে। কেন তোমার এমন কোন ঘটনা নেই? কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বিন্তা বললো- হ্যাঁ আছে। একবার বাড়িতে কি একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি মানুষ।

আমার বয়স তখন বারো। বাড়ি ভর্তি মানুষের কথা ভুলে গিয়ে নিজের রুমে গিয়ে কম্পিউটারে গেম খেলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই রুমে ঢুকলো আমার চেয়ে সাত বছর বড় এক চাচাতো ভাই। ঢুকেই বললো, কিরে তুই একা একা এই রুমে বসে আছিস কেন? তারপর নিজেই নিজেই খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলেন। আমার দিকে এগিয়ে এসে বুকের জামার ওপর হাত দিয়ে বললেন, তোর জামার ডিজাইনটা দারুণ, কে করে দিয়েছে রে? হাত ক্রমশ ভারী হচ্ছে।

আমি ভয়ে জমে গেলাম। চিৎকার দিতে গিয়েও গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। এইটুকু বলে থেমে গেল বিন্তা। আমি অপেক্ষা করছি তখন সে বাকিটুকু বলা শুরু করবে। কিন্তু প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে সে বলা শুরু করলো- আমার জীবনটাই কেমন যেন অগোছালো।

কখনোই হিসাব রেখে চলতে পারি না। সামনে পিছে কিছু না ভেবেই এমন একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি যার বয়স আমার চেয়ে দশ বছর বেশি। আমি নিজেও জানি না, আমার বাবা-মা এই সম্পর্ক মেনে নেবে কিনা। এমনকি বোকা মেয়েটা জানে না যাকে সে তীব্রভাবে ভালোবাসে সেই পুরুষটি তাকে ভালোবাসে কিনা। দশ বছরের পার্থক্যের কথা শুনে কিছুটা ধাক্কা খেলাম।

আমার আর বিন্তার দশ বছরের বয়স পার্থক্যের ব্যাপারটি নিয়ে গত কয়েকমাসে আমরা বেশ কয়েকবার গল্পচ্ছলে আলাপ করেছি। তারপরেও ধাক্কা খাওয়ার ব্যাপারটি লুকিয়ে বললাম-সেই পুরুষটিকে তুমি জানিয়ে দাও। জানলেই কি সে আমার অনুভূতি বুঝতে পারবে? হয়তো বুঝতেও পারে, পরমুহূর্তে টু্ইস্ট করা জন্য বললাম, আবার নাও বুঝতে পারে। আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। বলেই বিন্তা আমার হাত ধরে ফেললো।

চোখের নোনা জল এসে পড়লো আমার হাতের ওপর। শক্ত করে ধরা হাত যেন কিছুতেই ছাড়বে না। সেই মুহূর্তটিতেই উপলব্ধি করলাম, সহজ সরল এই মেয়েটিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি এক হাত দিয়ে বিন্তার চোখের জল মুছে দিতে লাগলাম। বিপত্তি বাঁধলো কিছুক্ষণ পর।

বিন্তার মা ছাদে এসে দেখতে পেলেন একমাত্র মেয়ে গভীর মমতায় একজনের হাত ধরে বসে আছে। আবার ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। রেহেনা আক্তার বেশ বুদ্ধিমতী। তিনি এদিকটায় আসলেন না। ছাদ থেকে নেমে গেলেন কিছুক্ষণ পর।

বিন্তা টেরই পেল না স্বল্প সময়ের মধ্যে কতো ঘটনা ঘটে গেল! এক সন্ধ্যায় আমার চিলেকোঠার বাসায় আসলেন বিন্তার মা রেহেনা বেগম। দীর্ঘ দিন এই বাসায় থাকছি। অথচ হাতে গোনা দুই একদিন তিনি আমার রুমে এসেছেন। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। নতুন একটা মুভি দেখছিলাম।

তা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। রেহেনা বেগম নরম গলায় বললেন- বাবা মারুফ, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। জ্বী খালাম্মা, বলেন। না আসলে, তুমি তো অনেকদিন ধরেই এই বাসায় আছো। তুমি বেশ ভালোভাবে থাকছো, আমাদেরও কোন সমস্যা হচ্ছে না।

কিন্তু বাবা, তোমাকে কয়েকদিনের মধ্যে বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? ছাদের এই রুম দুইটা আমাদের দরকার হয়ে পড়েছে। এইটুকু বলেই তিনি আমতা আমতা করতে লাগলেন। আমি তখন বললাম- খালাম্মা, সত্যি করেন বলেন তো কী হয়েছে? বাবা তুমি তো বিন্তার বাবাকে চেনো না। উনি পারেন না এমন কোন কাজ নেই।

সেদিন তোমার আর বিন্তার কথা ওনাকে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি ছেলে হিসেবে ভালো। ভালো রেজাল্ট। লেখালেখি করছো। এতোদিন ধরে আমাদের সাথে থাকছো।

হয়তো মানুষটা তোমার আর বিন্তার সম্পর্ক মেনে নেবে। কিন্তু তোমাদের কথা শুনতেই সে ক্ষেপে গেছে। বলে দিয়েছে প্রয়োজনে মেয়েকে এবং তোমাকে খুন করে ফেলবে। বাবা প্লিজ, তুমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাও। আর কখনোই বিন্তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না।

তুমি রাজি থাকলে তোমার জন্য নতুন বাসা ঠিক করে দেওয়ার কথা বলেছেন বিন্তার বাবা। জিনিশপত্র নিয়ে যাওয়া নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। বিন্তার বাবাই সবকিছুর ব্যবস্থা করবেন। এতোসব কথার বিপরীতে আমি কোন কথাই খুঁজে পেলাম না। তারপর বেশ কয়েকদিন বিন্তার দেখা মিললো না।

অনেক চেষ্টা করে খবর বের করতে পারলাম, বিন্তা বেড়াতে তার ছোট মামার বাড়ি চলে গেছে। বেশ কয়েকদিন পরে ফিরবে। এক সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। ক্যালেন্ডারের হিসেবে মাসের ৩১ তারিখ। গেটেই দেখা হলো বিন্তার মার সাথে।

অনেক অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, তোমার সব জিনিশপত্র নতুন বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই নাও নতুন বাসার চাবি। বাসা ভাড়া এই বাসার মতোই। তবে রুম মোট তিনটা। একটা অনুরোধ, দয়া করে তুমি আমার মেয়ের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবে না।

জানি তোমার খুব কষ্ট হবে, আমার মেয়েটাও হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু এর বাইরে আমার কিছুই করার নেই। আমি মাথা নিচু করে থাকলাম। কেবল বললাম- খালাম্মা বিন্তার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে? শেষবারের মতো? বিন্তা তার ছোটমামার বাসা থেকে এখনো ফেরেনি, উত্তর আসলো। তারপর দুজনেই চুপ করে গেলাম।

সিড়ি ভেঙে উঠে গেলাম চিরপরিচিত চিলেকোঠায়। বাতি না জ্বালিয়েই কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকলাম। সন্ধ্যার পর যোগাযোগের সূত্র বিচ্ছিন্ন করে বেড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়। হাঁটছি আর হাঁটছি। হাতে নতুন বাসার চাবি।

মাঝরাতে বৃত্তাকার চাঁদ উঠছে। কী অদ্ভূত মায়াকাড়া আলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, চন্দ্রাহত বালকের অভিমান বোঝে না চাঁদ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।