মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। তা হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন
ঠিক কবে থেকে জীবন যাপন উপভোগ করতে শিখেছি মনে নেই। কখন থেকে যে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি আনন্দের মনে হয় সেটার হিসেবও জানা নেই। হয়তো ছাপোষা মধ্যবিত্ত বলে এত এত উপলক্ষ্যের ভিড়ে হারিয়ে গেছে সবচেয়ে বড় এই উপলক্ষ্যটা। কিংবা একটু ঘুরিয়ে বললে মধ্যবিত্তের ছাপোষা মনোবৃত্তিতে এটা আসলেই কোনো উপলক্ষ্য নয়।
তারপরেও যতদুর মনে পড়ে মধ্যবিত্তের লেবেলে আমার এই যাপিত জীবনের প্রায় প্রতিটি দিনই কোনো না কোনো ভাবে 'আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান' এই বোধটা ক্ষনিক আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে এসেছে। সেই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপলক্ষ্য নিয়েই যাপিত জীবন।
শুনেছি পড়াশুনার নাকি শেষ নাই। শিক্ষার বয়স মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। কিসের কি ঘোড়ার ডিম।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই মাথায় গামছা বেধে নেমে পড়লাম কামলা গিরিতে। সেই যে নেমেছি, আজ কাল প্রায় মনে হয় এ যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। পড়াশুনাটা আর আদৌ আর করা হবে কিনা কে জানে? বন্ধুরা সব একে একে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অল্প কিছুদিন পর ওরা ফিরে আসবে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে। আর আমি? কদিন পর পর ওদের বিদায় দেয়ার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত।
আর মাস শেষে ব্যাংকে জমা হওয়া টাকার বিন্যাস নিয়ে হাবুডুবু খাওয়া। মাঝে মাঝে হিসেব মেলে না। তাতে কি? দিনতো চলেই যাচ্ছে। ভালো মন্দ মিলিয়ে। মন্দ না থাকলে ভালো কি ভালো থাকে? তাই মন্দের সাথে সহবাস করেই ভালো বুঝতে শেখার নির্মম প্রয়াস।
দিন শেষে রুমের বাতি নিভিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমুতে যাবার সময় কোনো অতৃপ্তি বোধ করি না। এই বেশ ভালো আছি, এই বোধের নামই বোধহয় মধ্যবিত্তবোধ।
চাকরীতে ঢোকার পর থেকে একটা নিয়মিত রুটিন হলো, প্রতিদিন রাত আটটার মধ্যে বাসায় একবার ফোন দেয়া। মাঝে মাঝে একটু দেরী হয়ে যায়। তখন আম্মা ছটফট করতে করতে নিজেই ফোন দিয়ে বসেন।
এখানেও একটা নিয়ম আছে। আম্মা যদি রাত আটটার পরে ফোন দেন, এর মানে হলো এটা স্বাভাবিক কল। আমার দিতে দেরী দেখে কল দিয়েছেন। এটাকে দুশ্চিন্তার কলও বলতে পারেন। মায়েরা একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করে।
আর যদি কোনোদিন আটটার আগেই কল করে বসেন, এর মানে মোটামুটি ইমার্জেন্সি কল। এমন একটা কিছু হয়েছে যেটা আমাকে বলার জন্য উনি মুখিয়ে আছেন। প্রতিদিন নিয়ম করে এই কাজটা করতে কখনো ক্লান্ত লেগেছে মনে পড়ে না। বরং দিনের ক্লান্তিটা মুছে যায় হাসিমুখে দুইটা কথা বললে। প্রতিদিন কি আসলেই ফোনে একমিনিট বলার মতন কথা থাকে? আজকে রাতে বাসায় গিয়ে কি কথা বলবো? মজার ব্যাপার হলো এখন ভেবে কিছু খুঁজে না পেলেও ফোন করলেই হড়বড় করে কথা বলতে থাকি।
তবে আম্মা মনে হয় আরো বেশি কথা বলেন। ওনার কথা বলার বিষয়ের কোনো শেষ নেই। এই যেমন গতকাল একটা ইমার্জেন্সি কল করলেন, খুব ইন্টারেস্টিং একটা বিষয়ে কথা হলো। আমাদের বাসার ব্যবহারের কাঁচের জগটা ভেঙ্গে গেছে। আব্বা নতুন একটা জগ কিনে আনলেন।
একটা কিনলে একটা ফ্রী এই দৌরাত্ন্যে জগের সাথে একটা টেবিল ঘড়ি ফ্রী পাওয়া গেল। ঘড়িতে এলার্ম দেয়া যায়। আমাদের বাসায় ইতিমধ্যে দুইটা এলার্ম দেয়ার যোগ্য টেবিল ঘড়ি আছে। একটা আব্বা ব্যবহার করে। আরেকটা ছোট বোন।
আমার ছোট ভাই দাবী করে বসলো তার নাকি এই টেবিল ঘড়িটা খুব দরকার। (প্রসঙ্গত বলে নিই, ঠিক এই মুহুর্তে তার ঘুমানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। কলেজ বন্ধ। নতুন ইয়ারের ক্লাস শুরু হতে দেরী আছে। ) কিন্ত ইদানিং নাকি আমার ছোট বোনের টেবিল ঘড়িটা ঠিক মতন সার্ভিস দিচ্ছে না।
তাই আম্মা তাকে বললো এটা যেন মুমু (আমার ছোট বোনের নাম) কে দেয়া হয়। ব্যস লেগে গেল লংকা কান্ড। আমার ছোট ভাই রেগে মেগে আগুন। তার কথা আম্মা নাকি সবসময় সব কিছু মুমুকে দিয়ে দেয়। তাকে কিছু দেয় না।
এবং ক্ষেপে গিয়ে সে দুপুর থেকে আম্মার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আম্মা আমাকে ফোন করে তার এই বিশাল সমস্যার কথা জানালো। এবং এর সমাধান চাইল। আমি এত দূরে বসে সমস্যার সমাধান করবো কি? হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলাম। আমিও হয়তো ওদের সাথে ঘড়ির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে একটা লড়াই করতে পারতাম।
তা না এই জঙ্গলময় শহরে বসে রিমোট সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আম্মার ফোন কেটে ছোট ভাইকে ফোন দিলাম। আমার ফোন পেয়ে আমি কিছু বলার আগেই বেচারা থতমত খেয়ে বললো ভাইয়া দিয়ে দিছিতো। আমার লাগবে না। আমি হাসতে লাগলাম আর আরো একবার মনে হলো এটাই বোধহয় মধ্যবিত্তবোধ।
চলবে
(কারো কারো কমন পড়তে পারে, এই দোষ আমার না)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।