রাস্তায় বের হলে আমার সঙ্গে এক বোতল জল রাখার অভ্যেস অনেকদিনের । কিন্তু এখানে সেটা নেয়া হয়নি। ফলে বাসে উঠার আগে পাশের পানের দোকান থেকে ভাবলাম এক বোতল জল নিয়ে নেই। সেই মত এক দোকানদারকে বললাম-'ভাই একটা জলের বোতল দিনতো' । বলেই বুঝলাম বলাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি ।
আবার ঠিক করে বলতে গিয়ে বললাম-' একটা পানির বোতল দিন'। দ্বিতীয়বারেরটা শুনে লক্ষ্য করলাম মাঝবয়সী দোকানদার মুচকি মুচকি হাসছে । আর হাসতে হাসতেই জলের বোতলটা আমার হাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-'আইছুইন কবে'? যেন অনেকদিনের পরিচয়, জানেন আমি কোথা থেকে এখানে এসেছি । আমার উত্তর শুনে আমাকে ছেড়ে দিলেন না । বাস ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত গল্প করলেন ।
গল্পের বিষয় 'ইন্ডিয়া' । যেহেতু আমি পঃবঙ্গ থেকে গেছি আমাকে তাই ইন্ডিয়ার সব বিষয়েই মতামত এবং তথ্য সরবরাহের জন্য উপযুক্ত ভেবে নিলেন । তবে ঘুরে ফিরে একটা কথাতেই তিনি বারবার চলে আসছিলেন যে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের অবস্থাত খুব খারাপ । আমি জন্মভূমে দু'দিনের জন্য বেড়াতে গেছি । ফলে এমন কোন উত্তর দিতে চাইনি যাতে আমাকে বাস ছেড়ে দিয়ে বিতর্কে জড়াতে হয়।
সুদীর্ঘ বিচ্ছেদের পর স্বজনসকাশে থাকার অনুভুতিটা কোন ভাবে ক্ষুন্ন হয় তাও চাইনি। বাসে উঠার আগে বিনয়ের সঙ্গে তাকে একটা কথা বলে আসলাম যে 'বেশি দূর ত নয়, আপনি একবার ইন্ডিয়ায় আসুন, নিজের চোখেই দেখে আসুন অন্ততঃ পঃবঙ্গে তারা কেমন অসুবিধার মধ্যে আছেন'।
এবার প্রায় তেইশ বছর পর গেছি। ওপারে থেকে যাওয়া দিদির ঘর সংসারে এবারে দেখি অনেক নতুন মানুষ। তাদের মধ্যে ছোটরা আমাদের নাতি নাতনী আর তাদের মা'য়েরা আমাদের বৌমা ।
তারা আমাদের দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে । ঘোমটা দেয়া মহিলা দেখার অভ্যেস নেই অনেক দিন । বললাম 'আমাদের সামনে ঘোমটার প্রয়োজন নেই' । কিন্তু ঘোমটা দেয়াটা আমাদের যতই মনে হউক যে তাদের পক্ষে এটা ইচ্ছে নিরপেক্ষ এক কর্তব্য, বাস্তবে লক্ষ্য করা গেল যে বিষয়টা তা নয়, এটা তাদের কাছে মান্য আচার । লক্ষ্য করলাম তারা জল'কে 'পানি' বলছে ।
কানে লাগছে । সকালের খাবারকে 'নাস্তা' বলছে । সবচে অবাক লাগল খাবার'কে 'খানা' বলা শুনে। কানে লাগলেও কোনটাই অশুদ্ধ নয়, বা বলাটাও কোন অন্যায় নয় । সময়ান্তরে বা দেশান্তরে এমন হওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
পরিবারের অভ্যন্তরেও ভাষার বা আচারের এই পরিবর্তনটা স্বাভাবিক হলেই ভাল ।
আগেরবার তাও প্রায় তেইশ বছর আগে যখন একবার গিয়েছিলাম, নন্দ'কে দেখেছিলাম এক ছিপ ছিপে উদ্যমী তরুণ । ওষুধের ব্যবসা তার । দোকানের নাম ছিল "বিশ্বনাথ মেডিকেল হল" । এবার নন্দ'র সঙ্গে মোহনগঞ্জ বাজারে ঘুরতে ঘুরতে বললাম 'কোথায় তোর "বিশ্বনাথ মেডিকেল হল"?' উত্তরে সে যা বলল তার মর্মার্থ হল যে, একটা ঘটনার পর সাইনবোর্ডটা খুলে রাখা হয়েছে ।
কারণ ঐ নামটাতে বোঝা যায় দোকানটা কোন হিন্দু মালিকের । দেশের কখন কি অবস্থা হয়, ঝামেলা হলে এইসব দোকান লুট করা সহজ । আদরের ভাইপো বিশ্বনাথ এর নামে রাখা দোকানের নাম এখন চেষ্টা করেও বদলানো যাচ্ছেনা । কারন ড্রাগ লাইসেন্সটা ঐ নামেই করা হয়েছিল । তাই দোকানটা আপাততঃ বন্ধই আছে ।
ধর্ম নিরপেক্ষ একটা নাম ঠিক করা আছে, চেষ্টা চলছে নতুন একটা লাইসেন্স বের করার ।
সেদিন একবোতল জল ওরফে পানি কিনে নিয়ে বাসে যেতে যেতে ভাবছিলাম এইযে মেনে নেয়া, আপোষ করা, উপায়হীনতার কারণে বাধ্য হওয়াটা কতটা স্বাভাবিক আর কতটা চাপজনিত । ভাবছিলাম দেশে একদা বহমান দুটো ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির কথা । পাশাপাশি বহু বছর থাকা সত্বেও ভিন্নতাই চোখে পড়ত । ভিন্নতা বা বহুত্বের ভিতর ঐক্যের কথা শোনা গেছে ।
কিছু কিছু ভিন্নতাত বিলীন হওয়ারই কথা ছিল । তা না হলে ঐক্যই বা হয় কী করে । কিন্তু ভিন্নতা ভেঙ্গে ফেলার চাপের মধ্যে কোথায়ও যেন একটা পরোক্ষ আগ্রাসনের ছাপ থাকে না কী !
অস্বীকারের উপায় নেই আমাদের এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর বিতর্ক অনেক পুরণো । রাজনীতির অন্যতম প্রধান উপজীব্য । তার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা অনেক তত্ব রয়েছে ।
আর তার অনেকটা জুড়েই আছে যার যার ধর্মের চোখে বিষয়টাকে দেখার প্রয়াস । ফলে তার প্রয়োগ এর ফল ভাল হয়নি । একবিংশ শতকে এসেও ধর্মের চোখ দিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে দেখার অপচেষ্টা জারী আছে ।
একটি কালিক কথন/২
ছোটবেলা শামছুদ্দিন বলেছিল 'তরা গরুর দুধ খাছ,মাংস খাছনা ক্যান রে' । ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শামছুদ্দিনের এই কথার জবাব দিতে না পারলেও খোটাটা হজম করতে কোন অসুবিধে হয়নি ।
কারণ, ১) শামছুদ্দিন তখন থেকেই আমার অকৃত্রিম বন্ধু । ২) গরুর দুধ বলতেই মনে পড়ে গিয়েছিল আমাদের মায়াবী চোখের একমাত্র গাই'টার কথা । আর তার মাংস ! ভাবা যায়না ।
ইস্কুলের ভাল ছাত্র ছিল শামছুদ্দিন । কিন্তু ভীষণ গরীব ।
নীল রঙের একটা ছোট লুঙ্গি আর ময়লা একটা জামা পড়ে সে ইস্কুলে যেত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে । যাওয়ার পথে আমরাও তার সঙ্গী হতাম । অবশ্য আমাদের বাল্য বন্ধুত্ব বেশী দিন স্থায়ী হয়নি । প্রায় ঐ বয়সেই আমার দেশছাড়ার কারণে তার সঙ্গে আমাদের পরস্পরের মধ্যে জাত ধর্ম বিষয়ে আর তেমন মত বিনিময় হয়নি ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার বয়স হয়, হয় শামছুদ্দিনেরও ।
ছোটবেলাকার যুক্তি বুদ্ধির কথা বড়বেলা মনে পড়লে আমার মত শামছুদ্দিনেরও নিশ্চই হাসি পেত। তার সঙ্গে যদিও স্বাভাবিক কারণেই কোন যোগাযোগ ছিলনা আমার । কিন্তু কী কারণে যেন তাকে আমি ভুলতে পারিনি । সেই কারণেই প্রায় বছর তেইশ পর আবার ছোট বেলাকার গ্রামটিতে যখন পা' রাখলাম তখন শামছুদ্দিনের সেই ম্লান বাল্যমুখটা মনে পড়ে গেল । আমার যেতে হয়নি, একদিন পর শামছুদ্দিনের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় আমাদের পুকুরপাড়ে ।
খবর পেয়ে সে নিজেই এসেছে ।
লোকমুখে শুনে সে এসে আমাদের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়েছিল অনেক আগে থেকেই । বন্ধুর জন্য উপহার হিসেবে সে নিয়ে এসেছিল এক প্যাকেট সিগারেট । এইসব সাক্ষাৎ সাধারণতঃ অনির্বচনীয় হয়ে থাকে । কুশল বিনিময়ের পর একসময় ভীড় থেকে একটু আলাদা হয়ে আমরা দু'জন এক জায়গায় বসে সেদিন অনেক ক্ষণ গল্প করলাম ।
এক সময় সে তার জীবনের নানা বিপর্যয়ের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল । কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও আমি তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম । তার সব বিপর্যয়ের মূলে সেই দারিদ্র, যা ছোটবেলাতেই আমি দেখে এসেছিলাম ।
উপায়ান্তর না দেখে সে একসময় ডাকাতির পেশাও বেছে নিয়েছিল । তার ফলে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল ।
আর এসব কারণে জনসমাজের চোখে তার ইমেজ আপাততঃ ভাল নয়, তা সে নিজেই স্বীকার করল । তবে সে এখন ভাল হওয়ার চেষ্টা করছে । কারণ এর মধ্যে সে বিয়ে করেছে । সন্তানাদিও হয়েছে । আমিও তাকে যথাসাধ্য উৎসাহ দিলাম ।
লক্ষ্য করলাম এই পরিণত বয়সে, এত ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও তার সারল্যে কোন ঘাটতি হয়নি । তার কাছ থেকে সেদিন বিদায় নেয়ার সময় আমারও অশ্রু সংবরণ করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল ।
কিন্তু শামছুদ্দিনের সঙ্গে সেই দেখা যে আমার শেষ দেখা হবে তা কে জানত! এবারও তেইশ বছর পর যখন আবার আমি যাই সেই জন্মভূমে, গিয়ে শুনি শামছুদ্দিন আর নেই । ভাল হওয়ার চেষ্টা নাকি সে খুবই করেছিল । কিন্তু দারিদ্রের সঙ্গে পেরে উঠেনি।
চরম কষ্টের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল । শুনে মনটা ভীষণ দমে গিয়েছিল । তার সঙ্গে আমার সামান্য বাল্যস্মৃতি নিয়ে এবারো পুকুরপাড়ে গিয়েছি । একা একা ভেবেছি আর কষ্ট পেয়েছি । বলতে গেলে তার সঙ্গে বড়বেলায় আমার সেই একবারই দেখা ।
আর সামান্য কিছু কথা । আর এই সামান্যটুকু দিয়েই শামছুদ্দিন কেমন করে যে আমার মন জুড়ে আছে ভেবে পাইনা । (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।