থেমে যাবো বলে তো পথ চলা শুরু করিনি।
প্রথম আলো প্রতি শুক্রবারে ধর্ম নিয়ে সম্পাদকীয় পাতায় একটা লেখা ছাপায়। হজ্বের মৌসুম এসেছে বিধায় এখন হজ্ব সম্পর্কিত লেখা প্রকাশ করছে। গেল শুক্রবার [ ৫ই অক্টোবর, ২০১০ ] তেমনই একটা লেখা বেরিয়েছে, যার শিরোনাম 'হাজরে আসওয়াদের ইতিকথা'’। যথারীতি লেখাটির লেখক প্রথম আলোর 'বান্ধা' লেখক ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুনিম খান।
লেখাটির ভেতরে তিরমিজি থেকে উদ্বৃত একটি হাদিস আর অনেকগুলো ‘সর্বজন স্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমত’–এর সূত্র ধরে অনেক ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন লেখক। ইতিহাসগুলোর কোন ভিত্তি আছে কিনা তাই নিয়ে আমার সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিস্তারিত দেখুন Click This Link
১। তিরমিজি থেকে বলা হচ্ছেঃ
এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোকনে আসওয়াদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেশতের দুটো ইয়াকুত পাথর। ’ (তিরমিজি)
২।
এরপরেই এসেছে
"সর্বজনস্বীকৃত ও অধিকাংশের অভিমতে বলা হচ্ছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে কাবাঘরের পুনর্নির্মাণকাজ শেষ করেন, তখন একটি পাথর ঘরের কাজে না লেগে অবশিষ্ট থেকে যায়। অবশিষ্ট এ পাথরটি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলেছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি কী অপরাধ করেছি যে আমার সঙ্গী-সাথিরা তোমার ঘরে স্থান পেয়েছে, কেবল আমি তা থেকে বঞ্চিত হলাম। ’ আল্লাহ তাআলা তার ফরিয়াদের প্রতি-উত্তরে হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদনুযায়ী এ পাথরটিকে কাবাঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয় এবং তাওয়াফকারীকে এ পাথরে চুম্বন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এমনিভাবে কাবাঘরের মধ্যে যেসব পাথর স্থান পেয়েছিল, কালো পাথরের মর্যাদা তাদের সমতুল্য রাখা হয়। "
৩।
আরেকটি বর্ণনা থেকে
"বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর নাজিল হওয়ার সময়ে হাজরে আসওয়াদও বেহেশত থেকে নাজিল হয়েছিল। হজরত আদম (আ.)কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তাআলা এ পাথরটিকে কাবা শরিফের স্থানে রেখে দিয়েছিলেন। তখন কাবাঘর ছিল না। জমিন ছিল পবিত্র, এতে কোনো গুনাহ সংঘটিত হতো না। হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনের সময় যখন সবকিছু ডুবে গিয়েছিল, তখন হজরত জিব্রাইল (আ.) পাথরটি আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মিত হলে তাওয়াফ শুরু করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল (আ.) একটি পাথর তালাশ করার সময় হজরত জিব্রাইল (আ.) ওই পাথরটি এনে দেন"।
৪। হাদিস-এ উল্লেখ করা হয়েছে [ সুত্র অনুল্লেখিত ]
"হাজরে আসওয়াদ [হজরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে] জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়। তখন তা দুধের চেয়েও সাদা ছিল; কিন্তু আদম সন্তানের গুনাহ একে কালো করে দিয়েছে"।
আমার অবজারভেসানগুলা এখন বলছি।
লক্ষ্য করুন, একবার পাথর প্রার্থনা করল যেন তাকে কা’বা-র অংশ করা হয়। আরেক বর্ণনায় বলা হচ্ছে, আদম (আঃ ) আর এই পাথর এক সাথেই ভূমিতে এসেছে। প্রশ্ন জাগে, আদমের মত কি পাথরও কি দোষে দুষ্ট ছিল? নাকি তা ভূমিতে আল্লাহর ঘরের চিহ্ন হিসাবে এসেছে?
আরেক বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে যে নূহ (আঃ ) –এর সময় ঘটে যাওয়া প্লাবনের সময়ে ফেরেস্তা জিব্রাইল পাথরটিকে আবু কোবাইস পাহাড়ে লুকিয়ে রাখেন। ব্যাপারটা পরিস্কার হয় না। বানের পানিতে ডুবে যাবে বলে এইটাকে মানুষের মত করে লুকিয়ে রাখার কি দরকার পড়ল? মহ্যমূল্যবান পাথর এত দিন খোলা আকাশের নীচে থাকল, কোন সমস্যা হল না, কয়েক বছর পানির নীচে থাকলে তো আরোই সমস্যা না হবার কথা ছিল।
লক্ষ্য করুন, ফেরেস্তার কাজটা ঠিক যেন মানুষের মত হয়ে গেল না? আমরা মানুষেরা গায়েবী সমন্ধে জানি না, তাই মূল্যবান ধন-সম্পত্তি ইত্যাদি বিপদ-আপদের মুখে লুকিয়ে রাখি। কিন্তু গায়েবী জানেন যাঁরা, তাদের তো এমন ‘মানুষ্য’ আচরন করা খাটে না।
যেহেতু বলা হয়ে থাকে সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, তা সবই নির্ধারিত। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে কেন এই পাথর নিয়ে খেলা? যদি আগের বর্ণনা মতন বিশ্বাস করি যে কা’বা ঘরের স্থান এই পাথর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হলে এই পাথর সরিয়ে নিয়ে গেলে নবী ইব্রাহিম আর তার পুত্র কি ভাবে কা’বা ঘর সঠিক স্থানে নির্মান করলেন? বলবেন যে আল্লাহ’র হুকুমে। তা হলে এইখানে ঐ পাথরের গল্পের অবতারনার কি দরকার ছিল?
এরপরে ঘটনার ক্রমানুসারে দেখা যায় যে পাথরটি লুকানো অবস্থায় ছিল, নবী ইব্রাহিমের কা’বা ঘর তৈরীর আগ পর্যন্ত।
এর পরে তা আবার জন সম্মুখে আনা হয়। আর তা আনা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। আর তা হল তওয়াফ শুরুর স্থান নির্ধারন করার জন্য।
আল্লাহ নবী ইব্রাহিমকে বললেই পারতেন যে দেখো গিয়ে অমুক যায়গায় মরুর বুকে একটা/দুইটা/তিনটা খেজুর গাছ আছে। সেখান থেকে অমুক পাহাড়ের দিকে একশত এগারো কদম [ বিভিন্ন বর্ণনায় এমন সব বে-জোড় সংখ্যারই তো উল্লেখ পেয়েছি আজ পর্যন্ত ] হেঁটে যাও।
এর পরে দক্ষিন-পূর্ব দিকে ফিরে দেখবে একটা বড় পাথর আছে। সেই পাথরকে কোনায় রেখে ওত কদম বাই ওত কদম হেঁটে যে যায়গা পাবে সেখানেই আমার ঘর বানাবে।
তা হলে এর আগে যে বলা হল, পাথরটি ঘর বানাবার পরে উদ্বৃত্ত থেকে গিয়েছিল, এবং পাথরের দোয়া মঞ্জুর হওয়াতে তাকে কা’বা ঘরের কোনায় স্থাপন করা হয়।
আমরা কোন বর্ণনাটাকে সহিহ [ সঠিক ] বলে মানবো? ধর্ম নিশ্চয়ই এক ঘটনার ব্যাপারে দুই-তিন ধরনের বয়ান দিতে পারে না। ঐশ্বী ধর্মে তো তা হতেই পারে না।
যদি তা হয়ই, তাইলে ধর্মের উপরে আমাদের বিশ্বাস কমে আসবে, আর তার থেকেও বড় দুঃসংবাদ হবে যে ইসলাম হয়ে যাবে বাইবেলের মত – লোকের বর্ণনার উপরে ভিত্তি করে প্রণীত। তাতো হতে পারে না।
তাই, মনে হয় না একই পাথরের দুই-তিন বার বা দু-তিন জনের হাত ধরে কা’বা-তে আসা হয়েছে। যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হয়েছে মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়, আর তাঁর হুকুমে। সেখানে মোল্লাদের এমন বানানো কাহিনী আমাদের ভ্রান্ত করে – খুব সহজেই।
মোল্লারা এইসব ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলা যত কমাবেন, ততই আমাদের ভেতর থেকে ধর্মের নামে কল্প কাহিনী দূরীভূত হবে, আমরা একটু একটু করে হলেও ‘আসল’ ধর্মকে চিনতে পারব।
বলা হয়ে থাকে, এবং ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি যে হাজরে আসওয়াদ কাল হয়ে গেছে কেননা তা বান্দার পাপ শুষে নেয়। এই কথাটি এই লেখাতেও এসেছে। তা হলে যারা এখন কাবা গৃহের তত্ত্বাবধায়ক, তারা কেন কালো দিকটা সরিয়ে অন্য একটা পরিস্কার দিক বান্দার দিকে ঘুরিয়ে দেন না? নাকি পুরো পাথরটাই কাল হয়ে গেছে? জানবার খুব ইচ্ছা থাকল।
এই বারে এক্কেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমাদের বাসা প্রবেশের মুখটা এমনই যে আপনি যদি বাসা থেকে বের হতে যান বা ভেতরে প্রবেশ করতে চান, তা হলে আপনাকে অবশ্যই সেই দেওয়ালটা মনের অজান্ত হোক বা জেনেই হোক স্পর্শ করতে হবে। এমন করে স্পর্শ করার ফলে দেওয়ালের একটা অংশ কালো হয়ে গেছে। এমন কাল দেওয়াল হয়ত আপানাদের অনেক বাসাতেই আছে। তা হলে কি দেয়ালটা আমাদের হাতের ময়লার কারনে ময়লা হয়ে গেছে? নাকি পাপ শুষে নিচ্ছে?
আমি মিল অমিল খুঁজছি না। একটা পাথর আর একটা দেওয়াল – এই দুইটার ভেতরে মনুষ্য-স্পর্শের কারনে এদের রঙ বদলের ব্যাপারটা তুলে ধরেছি মাত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।