'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা' শীর্ষক একটি গোলটেবির বৈঠকের আয়োজন করা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল প্রথম আলোর কার্যালয়ে। এখানে গণমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন সমস্যা,স্বাধীনতা,সামাজিক এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং এ ব্যাপারে সরকারের ও গণমাধ্যমগুলোর করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন আমন্ত্রিত বক্তারা । সরকারের তরফ থেকে উপস্থিত ছিলেন তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তাছাড়া উপস্থিত ছিলেন, প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা, ইনডিপেন্ডেন্ট-এর সম্পাদক মাহবুবুল আলম, সমকাল-এর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সাংবাদিক ও কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, নিউজ টুডে-এর সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর, নয়া দিগন্ত-এর সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. গীতি আরা নাসরীন, বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনজুরুল আহসান বুলবুল, আমাদের সময়-এর সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, এবিসি রেডিওর বার্তা ও অনুষ্ঠানপ্রধান সানাউল্লাহ, ভোরের কাগজ-এর সম্পাদক শ্যামল দত্ত, মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান শাহ আলমগীর, এটিএন বাংলার বার্তাপ্রধান জ ই মামুন, এটিএন নিউজের বার্তাপ্রধান মুন্নী সাহা এবং দৈনিক করতোয়া-এর সম্পাদক মোজাম্মেল হক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
তাদের আলোচনায় যে প্রধান প্রধান বিষয় গুলো উঠে এসেছে তা নিচে দেয়া হল এবং এ বিষয়ে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমালোচনা করা হলো:
১. বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা ও স্বাধীনতার পক্ষে। সরকারের ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিয়ে সংবাদপত্র সরকারকে দায়িত্ববান করে। গণমাধ্যমের জবাবদিহি তার পাঠকের কাছে। কাজেই কোনো গণমাধ্যম দায়িত্বশীল না হলে পাঠক বা দর্শক হারাবে।
-------প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান
২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বলেছিল, দেশে এখন সংসদ নেই।
গণমাধ্যম সংসদের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু সেই গণমাধ্যমের ওপর নানা সময়ে নির্যাতন হয়েছে। সাংসদদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে সংবাদ হতেই পারে। তাই বলে এভাবে সমালোচনা হতে পারে না।
-------------------------ইকবাল সোবহান চৌধুরী
৩.সংসদে সেদিন যেভাবে গণমাধ্যমের সমালোচনা হয়েছে, আমি আমার পেশাগত জীবনে তেমনটা দেখিনি।
আমাদের সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। যেভাবে এ ঘটনা ঘটল, স্পিকারও যেভাবে যোগ দিলেন, তাতে সন্দেহ হয়, এটা পূর্বপরিকল্পিত কি না।
--------------গোলাম সারওয়ার
৪. সংসদের ওই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। এটি সরকারের বক্তব্য নয়। কারণ, এই সরকার অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাস করে।
গণমাধ্যমকে সহায়ক শক্তি ভাবে।
-------------------তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ
৫.রাজনৈতিক কর্মীরা সাংবাদিকদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। এটি বন্ধ করতে হবে।
-----------------রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
৬.দেশের মানুষের অধিকারের জন্য গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে। একজন সাংবাদিক হত্যারও বিচার হয়নি।
নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত না হলে সাংবাদিকেরা নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
----------ইকবাল সোবহান চৌধুরী
৭.রাজনীতি ও গণতন্ত্র ঠিকমতো চললে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বিরোধী দল সংসদে যায় না। তাই বিরোধী দলের অনেক কাজ সংবাদপত্রকেই করতে হয়। এতে সরকার মনে করে, গণমাধ্যম বিরোধী দলের হয়ে কাজ করছে।
.............................মনজুরুল আহসান বুলবুল
৮.রাজনৈতিক বিবেচনায় টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া বন্ধের আহ্বান জানান বক্তারা।
৯.কাকে টেলিভিশন ও রেডিওর লাইসেন্স দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে নীতিমালা করতে হবে।
--------রিয়াজউদ্দিন আহমেদ
১০. গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী অস্ত্র। কাকে এই অস্ত্র দেবেন, কাকে দেবেন না, সেটি ঠিক করা দরকার।
--------জ ই মামুন
১১.পুঁজি ও ক্ষমতা নানাভাবে গণমাধ্যমকে কলুষিত করেছে।
-------------------- ----মনজুরুল আহসান বুলবুল
১২.কালো টাকার বিনিয়োগ আসছে মিডিয়ায়। যাঁদের বিরুদ্ধে লেখালেখি হয়, তাঁরাই এখন টাকা নিয়ে সংবাদপত্র বের করছেন। -------------শ্যামল দত্ত
১৩.কালো টাকার অনেক মালিকই গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করতে আসছেন। বুদ্বুদের মতো এই বিনিয়োগ উড়ে গেলে অনেকেই চাকরি হারাবেন।
--------সোবহান চৌধুরী
১৪. ৫৫ বছর আগে যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমাদের আসলে দায়বদ্ধ হতে হবে বিবেকের কাছে।
---- ----প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা
১৫.গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত জনগণের কাছে।
---------------গোলাম সারওয়ার
১৬.সাংবাদিকেরা অনেক সময়ই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন।
দায়বদ্ধতার বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার।
-------------------শাহ আলমগীর
১৭.গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।
কাজেই দায়বদ্ধ আমাদের হতেই হবে। সাংবাদিকদের দায়িত্ব ও নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সংবাদপত্রের কতগুলো নীতিমালা আছে। এই নীতিমালাগুলো মেনে চলা উচিত।
----------------------------- মাহফুজ আনাম
১৮. এ দেশের রাজনীতিবিদেরা দায়বদ্ধ তাঁদের দল ও নেত্রীর কাছে।
কিন্তু গণমাধ্যম দায়বদ্ধ জনগণের কাছে। রাজনীতিবিদেরাও যদি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হতেন, তাহলে এত সমস্যা হতো না।
---------------------মনজুরুল আহসান
১৯.সংবাদপত্রগুলো কী পরিমাণ ভুল সংবাদ প্রকাশ করছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করা দরকার। নিরীক্ষায় (প্রেস ইনস্টিটিউটের পত্রিকা) এসব ভুল নিয়ে প্রতিবেদন হতে পারে। ভালো সংবাদ নিয়েও প্রতিবেদন হতে পারে।
--------------------মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
২০.সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য নীতিমালা হতে পারে। তবে সেটি চাপিয়ে দেওয়া নীতি হলে চলবে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিমালা করতে হবে।
------------ইকবাল সোবহান চৌধুরী
২১. সব বক্তা একমত পোষণ করে বলেন, একটি দৈনিকের সম্পাদককে অবশ্যই পেশাদার সাংবাদিক হতে হবে। একইভাবে টেলিভিশনের প্রধান পদগুলোতেও পেশাদার কাউকে নিয়োগ দিতে হবে।
পেশাদারি অর্জনের জন্য সব বক্তাই সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন।
২২.বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাত্ত্বিক শিক্ষা দেয়, কিন্তু ব্যবহারিক শিক্ষা জরুরি।
-----------------মনজুরুল আহসান
২৩.কেউ কেউ ন্যূনতম জ্ঞান না নিয়ে অনেকের সুপারিশে সাংবাদিকতায় আসেন। এটি ভয়াবহ।
-----জ ই মামুন
২৪.সাংবাদিকের ন্যূনতম মান থাকা উচিত।
প্রশিক্ষণের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউটকে শক্তিশালী করা হবে।
------তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ
২৫.এ দেশে সংসদে নোংরাভাবে গণমাধ্যমের সমালোচনা হয়, আদালত অবমাননার দায়ে বিচারক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে সাংবাদিকদের জেলে পাঠান, নির্বাহী বিভাগও গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন করে। রাষ্ট্রের তিনটি শাখাই যদি এমন করে, তাহলে গণমাধ্যমকে সংকটে পড়তে হয়।
---------------------------- নূরুল কবীর
২৬.কী করলে আদালত অবমাননা হয়, সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
--------------------------গোলাম সারওয়ার
###একটি ফোরাম গঠনের প্রস্তাব
২৭.সাংবাদিকতায় পেশাদারি ও সংকট মোকাবিলায় সম্পাদকদের সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল করা যেতে পারে।
---------------মাহফুজ আনাম
২৮.এই কাউন্সিলের মাধ্যমে আমরা সম্মিলিতভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি।
-----------------মাহবুবুল আলম
২৯. তথ্যমন্ত্রীর উচিত, মাসে অন্তত একবার সম্পাদকদের সঙ্গে বসা।
---- ---------------সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমার বক্তব্য:
১. সরকারের পক্ষ থেকে কোন ব্যাক্তিকে কোথাও আমন্ত্রন করা হলে সবসময় সুবিধাজনক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এই গোলটেবিল বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী গতানুগতিক ধারা বজায় রেখেছেন। সংসদে গণমাধ্যম নিয়ে সুবিধাবাদী সাংসদেরা তীব্র সমালোচনা করলেও সরকারের তরফ থেকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়নি।
অথচ তথ্যমন্ত্রী বলেছেন এটি সরকারের বক্তব্য নয়,সরকার অবাধ তথ্য প্রবাহে বিশ্বাস করে এবং গণমাধ্যমকে সহায়ক শক্তি ভাবে। টিভি চ্যানেল ও পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে এই সরকারের ভূমিকা স্পষ্ট।
২. আলোচনায় সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হত্যার ব্যাপারে বলা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
৩. মিডিয়াতে কালো টাকা বিনিয়োগ এবং যাকে তাকে লাইসেন্সের ব্যাপারে বলা হয়েছে।
এই দুটি কাজ হয় রাজনীতিবিদদের হাত দিয়ে। সাংসদেরা লাইসেন্স নিয়ে বিশাল অঙ্কের ব্যবসায় করেন। যে বেশি টাকা দেয় তাদের দেওয়া হয় লাইসেন্স। ফলে তাদের দায়িত্বশীলতা ও নিরপেক্ষতার জায়গাটুকু থাকে না। একধরনের অসৎ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয় গণমাধ্যমগুলো।
৪.আরেকটি দু:খজনক বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে ,তদবিরের মাধ্যমে বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে সাংবাদিক নিয়োগ। এই বিষয়ে পড়াশুনা বা অভিঙ্গতা না থাকলে কিভাবে সাংবাদিকতার মত দায়িত্বশীল পেশায় নিয়োগ দেয়া হয়?যারা এইভাবে সাংবাদিক হয় জনগণ তাদের কাছ থেকে কি ধরনের সংবাদ আশা করবে?
ব্লগারগণ, আপনাদের সমালোচনামূলক মন্তব্য দিয়ে লেখাটিকে আরও সমৃদ্ধ করুন। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা এবং বস্তনিষ্ঠতা সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য কি?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।