'আমা পানে চাও, ফিরিয়া দাঁড়াও, নয়ন ভরিয়া দেখি'
১. ক)
২০০২ সালের ঘটনা খুব সম্ভবত। নাটোরে গামা হত্যার পর বিএনপির উপমন্ত্রী দুলুর বাহিনী পুড়িয়ে দিলো একটা গ্রাম। সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ আর ছবি তুলতে গেলেন। যদ্দূর মনে পড়ে বগুড়া থেকে ৭ জন আর রাজশাহী থেকে ৯ জন সাংবাদিক সেখানে যান। তাদেরকে ঢুকতেই দিলো না দুলু বাহিনী।
গোপন পথে কয়েকজন ঢুকেছিলেন। তারা ছবি নিউজ নিয়ে ফিরলেন। কয়েকজন সাংবাদিককে দুলুর লোকজন আটকেও রেখেছিলো। জনকণ্ঠ সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুলুর বাহিনী প্রকাশ্যে তাকে পিটিয়েছিলো। ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক মহলে নিন্দা আর প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিলো।
আজকের ইকবাল সোবহান চৌধুরী আর মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলরা সেদিন এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। গিয়াস কামাল চৌধুরী গং ছিলেন নীরব। যেন কোথাও কিছুই ঘটে নি। সাংবাদিক নির্যাতনের সেইসব ঘটনার কোন বিচার বা বিহিত হয়েছে বলে আমরা পরে আর কখনও শুনি নি।
১. খ)
এই সেদিনের ঘটনা।
বনপাড়ায় সানাউল্লাহ বাবুকে হত্যার দিন সাংবাদিকদের পেটালেন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। গুরুতর আহত সাংবাদিকরা এখনো শয্যাগত। চিকিৎসার অভাবে দিন কাটছে। নাটোর প্রেসক্লাবের সভাপতি, যিনি নিজেই কি না আওয়ামী লীগ নেতা, সাংবাদিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের এক সাংসদও ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চেয়েছেন।
মজার ব্যাপার হলো দুলুর অপকর্মের দিনের সোচ্চার সাংবাদিকরা আজ কেন জানি নীরব হয়ে গেছেন। তাদের মুখ তালা আঁটা। অন্যপক্ষ টুকটাক কথা বলেছেন বটে। তবে তা যতোটা না নির্যাতিত সাংবাদিকদের পক্ষে, তার চে বেশি বি্এনপির রাজনীতির পক্ষে। কাজেই কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত সাংবাদিকের আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায় না।
কি বিচিত্র এ দেশ! কি বিচিত্র সাংবাদিকরা! কালো টাকার বিনিয়োগ তো এখানেই জায়েজ! তা মতিউর রহমান-গোলাম সারওয়াররা যতোই গোলটেবিল করুন না কেন।
২.
সাংবাদিকতাও একটা শিক্ষার বিষয়। দিনে দিনে নিজেকে গড়ে তোলার বিষয়। কিন্তু যারা সাংবাদিকতা শিক্ষা দেন, তারা কি করছেন? আজই খবরটা পেলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠা এক সাংবাদিককে অভিনব শিক্ষা দিয়েছেন তার বিভাগের একজন শিক্ষক।
সমস্ত নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যে শিক্ষক প্রশাসনের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের শোধ তুলেছেন, তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক। স্বভাবত ছাত্রটিও একই বিভাগের। শিক্ষক ভদ্রলোক বর্তমান সরকারের আমলে সর্বাধিক ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের একটি দায়িত্বেও রয়েছেন তিনি। আজ ছিলো সেই সাংবাদিকটির শেষ বর্ষের শেষ পরীক্ষা।
শিক্ষকটি ইনভিজিলেটরও ছিলেন না। তারপরও শুক্রবার দিনে তিনি বিভাগে গিয়ে ওঁত পেতে ছিলেন ছাত্রটির শিক্ষাজীবন শিকার করতে। পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে ছাত্রটি টয়লেট সেরে রুমে ঢুকতেই শিক্ষকটি হাতে করে একগাদা নোট নিয়ে রুমে ঢুকে সরাসরি ছাত্রটির উদ্দেশে বলেন, শুয়োরের বাচ্চা সাংবাদিক হইছিস। আর নকল করিস। ছাত্রটির শত অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে তার খাতায় সেইসব নোট সংযুক্ত করে তাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়ার আগে শিক্ষক ভদ্রলোক হুঙ্কার ছাড়েন, আমরা সাংবাদিকতা শেখাই।
আমাদের সঙ্গে লাগতে আসার ফল ভালো হয় না। মজার ব্যাপার হলো বাইরে থেকে যেসব নোটপত্র ওই শিক্ষক নিয়ে আসেন, তার বেশিরভাগই অন্য বর্ষের। দু'টি প্রশ্নের উত্তর ছিলো চতুর্থ বর্ষের। কিন্তু ঘটনার শিকার সেই ছাত্র ওই দু'টি প্রশ্নের উত্তর লিখেনই নি। দু'জন গোবেচারা ইনভিজিলেটর এই সরকারের আমলেই নিয়োগ পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত তারা ওই শিক্ষকেরই ছাত্র ছিলেন। কাজেই তারাও মুখ বুঁজেই দেখেছেন এই নাটক। এই শিক্ষক এর আগে তার গৃহপালিত সাংবাদিকদের দিয়ে নিজে ড্রাফট করে নিউজ করাতেন। সেই নিউজ ছাপিয়ে প্রশাসনের আস্থাভাজন হয়েছেন। এবার প্রশাসনের আরো ঘনিষ্ঠ হতে একজন ছাত্রের শিক্ষাজীবন অবলীলায় নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করে নিজের ক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন।
সাংবাদিকতার সব শিক্ষক অবশ্যই এমন নন। তবে দুঃশ্চিন্তার বিষয় হলো এমন শিক্ষক দু'য়েকজন হলেও আজকাল সাংবাদিকতার শিক্ষা দেন!
ঘটনাগুলো নিয়ে কোন গোলটেবিল হবে না। ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের শাস্তি দাবিতে কেউ হয়তো জেলায় জেলায় পাঠক ফোরামের নামে মানববন্ধনও করবেন না। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, সাংবাদিকতার শিক্ষা থেকে শুরু করে স্বার্থরক্ষাকারী সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই যখন ঘুণপোকা ঢুকে পড়ে, তখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আজ যারা সুস্থ সাংবাদিকতার কথা বলতে চান, তারা বিষয়গুলো মনে রাখলেই মঙ্গল।
না হলে নড়বড়ে গণতন্ত্রের এই দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়ার দিন ক্রমেই পেছাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।