অচেনার মাঝেও নিজেকে চেনার নিঁখুত অভিনয় করি
পরীক্ষার হলে এক অন্যরকম ব্যাপার হলো। এই ধরণের অবস্থায় আগে কখনো পড়ি নি। এক সাংঘাতিক অবস্থা। পরীক্ষা নিয়ে চিন্তার চেয়ে আরো বেশি চিন্তা সেখানে গিয়ে বসা। আমার সিট পড়েছে দরজার সাথে।
আমার ঠিক পাশে একটা মেয়ে। অন্য কলেজের। ঠিক বরাবর সামনে মেয়ে। আর পিছেও মেয়ে। কোথায় পাশে বন্ধু বসলে সমস্যায় তার সাথে কথা বলে লিখবো তা না হয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকা।
কিছু করতে গেলেই কেমন বিব্রত লাগে। আমি বরাবরই বেশি লিখি। হাত ব্যাথা করে। কিন্তু হাত ঝাড়ি না। কি না কি ভাবে এই ভয়ে।
একটা মেয়ের কাছ থেকে না হয় এড়িয়ে থাকা যায় তাই বলে তিনটা মেয়ে!!
সামনের মেয়েটার চুল ফ্যানের বাতাসে আমার টেবিলে এসে পড়ে। আমি বোকার মত সেদিকে খেয়াল করি। দেখি পাশে বসা মেয়েটা মুচকি হাসছে। পেছনের মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, কিরে হাসছিস কেন? আমার পাশে বসা মেয়েটা ফিসফিস করে বলে, মজার ব্যাপার ঘটছে। পরে বলবো।
পেছনের মেয়েটাও ফিস ফিস করে বলে, নিরামিষের কাছ থেকে কি মজার জিনিস খুঁজে পেলি?
আরে এসব কি? কোথায় পরীক্ষা দিবো। তা না। এই তো রীতিমত অপমান। আমি সোজা হয়ে পিঠ টান টান করে বসে রোবটের মত লিখে যাই। আর কিছুর দিকে তাকাবো না।
অযথা হাসির খোরাক হয়ে লাভ নেই। একই সাথে যারা সিট প্ল্যান করছে তাদের এক প্রস্ত বকা দিয়ে দিই। মেয়ে বসানোর আর জায়গা পেল না। আমার পাশে তিনটা বসাতে হবে?
তৃতীয় পরীক্ষা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। আমি লিখে চলছি।
দেড় ঘন্টার মধ্যে মূল খাতা শেষ। লুজ পেজের জন্য দাঁড়ালাম। পাশের মেয়েটা নিজে নিজে বলে, কি এত লিখে আল্লাহ জানে। এত তাড়াতাড়ি খাতা শেষ। আর আমি যে লেখার কিছুই পাই না।
গল্প লেখা শুরু করছে কিনা কে জানে?
আমি কিছু বলি না। নতুন খাতায় লিখে যাই। ম্যাডাম ডাক দেন। এই তুমি বৃত্ত পূরণ করো আগে। তারপর লিখো।
আমি ঠিক আছে বলে বৃত্ত পূরণ করে নিই। নতুন পেইজ নিলে মূল খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় বৃত্ত ভরাট করতে হয়। পাশে সিরিয়াল নাম্বার লিখতে হয়। যতবড় সিরিয়াল নাম্বার তাতে বক্সটাতে আঁটে না। তারপরও জোর করে আঁটাই।
পাশে বসা মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কে রিবজিনস্কির তত্ত্বটি পারো?
আমি মাথা নাড়ি নিচের দিকে। যার অর্থ পারি।
-একটু বলো না।
আশ্চর্য ব্যাপার, এই মেয়ের সাথে আগে কখনো কথা হয় নাই। প্রথম কথাতেই তুমি করে বলছে।
আমি কিছু বলি না। লিখে যাই।
-আরে বাবা। একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। পারে তারপরও বলে না।
কি মুড ধরছে। আরে আমাকে বলে দিলে তোমাকে নম্বার কম দিবে নাকি? বলার ভয়ে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। এত মুড ভাল না।
মেয়েটার দিকে কয়েকবার চোখ পড়ে যায়। এর মধ্যে দুই বার চোখাচোখি হয়ে গেছে।
আমি তো লজ্জায় শেষ। চোখ গুলো ভাসা ভাসা। মুখটা অনেক খানি ফর্সা। হালকা গড়নের। মাথায় কালো রঙ্গের ব্যান পড়েছে।
আমি চোখাচোখি হওয়ার ভয়ে পাশে তাকাই না।
ও বিরক্ত। শেষ বারের মত বলে, তুমি কি বলবা না?
বলা বিপদ জনক। আমি না বলে আমার মূল খাতাটির যে পৃষ্ঠায় ঐ প্রশ্নটা লিখেছি সেটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিই।
ও হাসি মুখে নেয়।
লিখতে থাকে। আমিও লুজ পেইজে লিখে চলি।
-কি লেখারে বাবা। এগুলো কোন সভ্যতার লেখা কে জানে? দুই শব্দ বুঝলে তিন শব্দ বুঝি না।
আমার রাগ হয়।
সাহায্য করছি এজন্য কোথায় ধন্যবাদ দেবে তা না করে হাতের লেখার দোষ ধরছে। আমি ওর লেখার দিকে তাকাই। অনেক সুন্দর। ঝকঝকে।
এদিকে ম্যাডাম বুঝে ফেলেন আমি পাশের জনকে খাতা দিয়েছি এবং সে ঐ খাতা দেখে লিখছে।
ম্যাডাম এসে আমার খাতা নিয়ে যান। অথচ মেয়েটার কিছুই বলেন না। দোষ সব আমার।
আমাকে বলেন দাঁড়াতে।
মাথায় ঝিম ধরে যায়।
ভয় ভয় করে। ধূর কেন যে দিতে গেলাম। -তুমি দাঁড়ায় থাকো। পাশে সুন্দর মেয়ে বসছে এজন্য এভাবে সাহায্য করতে হবে? এটা ঠিক না।
লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যায়।
মেয়েদের সাথে ঠিকমত কথাই বলি না। সেখানে এরকম অপবাদ শুনতে হচ্ছে। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সবাই লিখছে।
আড়চোখে দেখি মেয়েটিও লেখা বন্ধ করে বসে আছে।
বিশ মিনিট পর আমাকে খাতা ফেরত দেওয়া হয়।
পরীক্ষার শেষে বের হচ্ছি। তখন মেয়েটা ডাক দেয়। একটু এদিকে আসো কথা আছে।
কি কথা জিজ্ঞাসা করার চেয়ে আমার সহজ মনে হয় যেদিকে ডাকছে সেদিকে যেতে।
অনেকে তাকাচ্ছে। এরকম সুন্দর মেয়ের সাথে চললে অনেকের চোখ পড়ে। আমার লজ্জা করে। বারান্দার শেষ মাথায় এসে থামে।
-আমি আসলে দুঃখিত।
তোমার পরীক্ষা খারাপ হলো। বিশ মিনিট লিখতেই পারলে না। সরি।
আমি মাথা নাড়ি। আমিই বুঝি না কিজন্য মাথা নাড়ি মেয়েটা কি বুঝবে।
তবে মন খারাপ। এই পরীক্ষাটা ভাল হয় নাই। সামনের বার হয়ত ইমপ্রুভমেন্ট দিতে হবে। বাসায় বললে মা খুব রাগ করবে।
মেয়েটা রাগের সাথে বলে, মাথা অনেক ভারি।
এই মাথার ভারের কারণেই মানুষ সাঁতার কাটতে পারে না।
মাথা ভারি এটা তো জানি। এই মেয়ে আমাকে এটা বলছে কেন? কিন্তু কিছু বুঝি না। আবার মাথা নাড়ি।
-শুনো মাথা নাড়ার চেয়ে মুখে কথা বলা তো অনেক সহজ তাই না?
আমি মাথা নাড়ি।
অথ্যাৎ হা।
আরে এই দেখি আবার মাথা নাড়ে। দাড়াও এরপর যদি কথা না বলো তোমার মাথাটা ভাঙবো। বোবায় ধরছে নাকি তোমায়?
আমি অনুচ্চস্বরে উচ্চারণ করি, নাহ। তবে নিচের দিকে তাকিয়ে।
-আরে এই দেখি কথা বলতে পারে। আমি তো ভাবলাম সত্যিই বোবা। আমি সরি বলছি। তুমি কিছু বলো। চুপ করে আছো কেন? কেউ সরি বললে নাহ ঠিক আছে এজাতীয় ভদ্রতা করে কিছু বলতে হয়।
আমার হাসি আসে। হেসে দিই। অনেক মজার মেয়ে তো। কথা শুনতে ভাল লাগছে।
মেয়েটা বলে, তোমার হাসিতো দেখি সুন্দর।
পরীক্ষা হলে জড় পদার্থের মত হয়ে থাকো কেন?
সবাই চলে যাচ্ছে। আমি সেদিকে তাকাই। আমার তাকানো দেখে বলে ভয় পেয়ো না। তোমাকে আটকায় রাখবো না। ওদের মত যেতে পারবে।
আমিও যাবো।
একটা মেয়ে তেমন পরিচয় নাই। পরীক্ষা হলে শুধু পাশে বসেছে। তাও মাত্র তিনদিন। এই অল্প দেখায় এত কথা বলতে পারে? অন্যরকম মেয়ে।
আমি খুব বক বক করছি তাই না? আমি এমনই। বেশি কথা বলি। তোমার হাসি সুন্দর বলছি। তুমি থ্যাঙ্কু দাও নাই এখনো। ভদ্র হতে শেখো।
শেষের কথাটা অপমানজনক। আমি শুধু বলি, থ্যাঙ্কু।
ঠিক আছে আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে। যাও।
আমি এবার জিজ্ঞেস করি, আপনি যাবেন না?
-হুম যাবো।
ঠিক আছে। ভাল থাকবেন। বলে আমি পা বাড়াই।
-ভদ্রতা ভাল। তবে বেশি ভদ্রতা ভাল না।
আমিও যাচ্ছি।
গেটের বাহিরে তখনও ভীড়। অনেকে রিকসা ডাকছে। গন্তব্যের নাম শুনে কোন রিকসা যেতে চাচ্ছে। কোনটা চাচ্ছে না।
খয়েরী রঙের একটা প্রাইভেট কার আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। নতুন মনে হচ্ছে। লাক্সারী টাইপের। এই গাড়ি দাঁড়ানোর আর জায়গা পেল না। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
ড্রাইভার নেমে আসে। দরজা খুলে দেয়।
মেয়েটা বলে, ঠিক আছে যাই। আবারো সরি। আসলে এভাবে তোমার খাতা নেওয়া ঠিক হয় নাই।
গাড়িতে গিয়ে বসে।
আমি তাকিয়ে থাকি। অপরিচিত মেয়ে এত পরিচিতের মত আচরণ করে গেল। তবে ভাল লাগে। সুন্দর এক অনুভূতি সৃষ্টি হয় মনে।
যা আগে কখনো পাই নি। কি সুন্দর মুখ। কি সুন্দর কথাগুলো।
অন্য পরীক্ষাগুলোতেও কথা হতো। আমারো ভাল লাগা শুরু করে।
শেষ পরীক্ষার দিন আমার ফোন নাম্বার খুঁজে । আমি দিই। যেদিন ফোন নাম্বার দেয় সেদিন রাতেই কল দেয়। অনেকক্ষণ কথা বলে।
জানতে চায়, কয় ভাইবোন?
আমি বলি, ৫ ভাই বোন।
-তোমাদের কি মজা। কত্ত মজা করো। অথচ আমার কোন ভাই বোন নাই। একাই। কোন মজা নাই।
কাজিন যারা আছে তারা সবাই ব্যস্ত। কোন অনুষ্ঠান হলে দেখা হয়। আচ্ছা তুমি এরকম গম্ভীর হয়ে থাকো কেন?
-অপরিচিতের সাথে কি কথা বলবো। তার উপর তিন দিকে মেয়ে গম্ভীর না থেকে উপায় আছে?
-মেয়েদের খুব ভয় পাও তাই না?
- নাহ ভয় পাই না। তবে অপরিচিত হলে আন ইজি ফিল করি।
আর তোমরা তো আমাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছো প্রথম পরীক্ষার দিনই।
-আরে ঐইটা তো প্রথম পরীক্ষার দিনই। আমার ঐ বান্ধবীটা খুব দুষ্ট। ও ওর বয়ফ্রেন্ডকে খুব জ্বালায়। আচ্ছা তোমার গার্ল ফ্রেন্ড নাই?
আমি বলি, হুম আছে।
ও অবাক হয়। চমকে যাওয়া গলায় বলে, সত্যি। তোমার গার্ল ফ্রেন্ড নিশ্চয় তোমার আচরণে খুব বিরক্ত তোমার গম্ভীরতা নিয়ে। এই বয়সে এত গম্ভীরতা ভাল না। আচ্ছা তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের নাম কি?
-আমার গার্ল ফ্রেন্ড হচ্ছে আমার নানু।
তার সাথে অনেক মজা করি। এজন্য আমার কাজিনরা বলে নানুই আমার গার্ল ফ্রেন্ড।
হাসির শব্দ আসে ঐ পাশ থেকে। হাসি যেন থামতেই চায় না। তুমি সত্যিই অনেক মজার।
আমি তো সিরিয়াস ভাবছিলাম তোমার গার্ল ফ্রেন্ড আছে। অনেক মজা পেলাম।
রাত তিনটা বাজে। অথচ দেখি রাখার নাম নেই।
আমি বলি, কাল আমাকে একটু সকাল সকাল একটা জায়গায় যেতে হবে।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। এই দেখো আমার একটুও খেয়াল নাই যে এত রাত হয়েছে। ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়ো।
তৃণার সাথে প্রতিদিন কথা হয়। আমার ঠিকানা জেনে নেয়।
বলে একদিন এখানে এসে আমাকে চমকে দেবে। আমারও ভাল লাগে। যেদিন কল করতে দেরি হয় অস্থিরতায় ভুগি। ওর শর্ত হচ্ছে আমি কল করতে পারবো না। ও ই কল দেবে।
হঠাৎ একদিন দেখি ওর কল আসে না। তৃণার কলের জন্য ছাদে বসে থাকি। রুমে কথা বললে অন্যদের অসুবিধা হবে বলে ছাদে কথা বলতে আসতে হয়। কিন্তু ওর কল আসে না। এদিকে মশার ভো ভো বেড়েই চলে।
নাহ আর কল আসে না। বার বার দিবো ভেবেও ওর মানা করা মনে পড়ে যায় তাই দেওয়া হয় না।
এক সপ্তাহ যায়। প্রতিদিন রাত হলেই কলের অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু কল আসে না।
আর না পেরে ওর মানা করা ভুলে আমি কল দিই সে নাম্বারে। কিন্তু এই কি? নাম্বার বন্ধ। কি মনে করবে এজন্য ওর এড্রেসও জানতে চাই নি কখনো।
মাস কেটে যায় ওর কল আসে না। তারপরও আমি অপেক্ষা করে যাই।
একদিন হয়ত আসবে। এখানে এসে আমাকে চমকে দেবে। আমার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত হয়। কোন ওর আসা হয় না।
আমার বন্ধু জুবায়ের ব্যাপারটা জেনে বলে, দোস্ত বাদ দে।
ধনীর মেয়ে তো। খেয়ালী টাইপের হয়। কখন কি করে ওরা নিজেরাও জানে না। তুই অপেক্ষা করিস না। ঐ মেয়ে আর আসবে না।
আমি কিছু বলি না। তবে ঠিকই অপেক্ষায় আছি। কোন ফোন রিং আসলেই চমকে উঠি। ওই করছে হয়ত। এতবার ভুল ধারণার পরও আমার ভুল ভাঙে না।
কোন কল এলে প্রথমেই ওর কল মনে হয়। হোক না ভুল। এই ভুল সযতনে লালন করে যাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।