সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
চায়না থেকে ফিরেঃ ওর্য়াল্ড এক্সপো সাংহাই-২০১০(২য় র্পব)
প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন নিজের সঙ্গেঃ
চীন নিজেই যেনো নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। সেটি আবারো দেখা গেল সাংহাই এক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, যা প্রমান করে দিয়েছে অলিম্পিকের আয়োজনকেও(উল্যেখ্য যে আমরা উদবোধনী অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখতে পারিনি, কিন্তু প্রতিদিনই ২ বার করে উদবোধনী অনুষ্ঠানটি নতুন ভিজিটরদের বিশাল LED প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে)। মেলা অনুষ্ঠানে একদিকে ইনডোরে চলেছে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের নিয়ে বর্ণাঢ্য সব আয়োজন। অন্যদিকে আউটডোরে চলছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চীনা ঐতিহ্যের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা। হাজার রকম আতশবাজির বর্ণিল খেলা, পানির ওপর আলো-আধারের রহস্যময়তা, আর হুয়াংপু নদীতে ভেসে বেড়ানো এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়োড) বাতি দিয়ে বানানো ছয় হাজার কৃত্রিম মাছ , যা লক্ষ লক্ষ দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছে যাদু বাস্তবতার পরশে।
যেহেতু হুয়াংপো নদীর দুই তীরে মেলার আয়োজন করা হয়েছে-সেই জন্য হুয়াংপো নদীকে মনোরম দুইটি ব্রীজ দ্বারা সংযুক্ত করা হয়েছে। ব্রীজ দুটির নাম যথাক্রমে নাম্পু এবং লুপু।
ওয়ার্ল্ড এক্সপো'র মিডিয়া কর্মকর্তা লু পেং বলেন, "বিরল এই উদ্বোধনীর মধ্য দিয়ে তারা সার্চলাইটের আলোর বন্যা, বর্ণময় আতশবাজি, LED স্ক্রিন কিংবা লাইট শো সব কিছুতেই এক নতুন ইতিহাস গড়েছেন"। সত্যি যেনো রেকর্ড ভাঙ্গার মিশন নিয়ে নেমেছে চীন। মেলা পরিসংখ্যানে সাংহাই এক্সপো ছাড়িয়ে গেছে সর্বকালের সব রেকর্ড।
এক্সপোর শুধু প্রস্তুতি পর্বেই চীন খরচ করেছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এযাবৎ কালের যে কোন আয়োজনের সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। মেলার এই খরচ শেষ পর্যন্ত দাঁডিয়েছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারে। চীনের শিল্পশহর সাংহাইয়ের হুয়াংপু নদীর দুই তীরে ৫.৩৮ বর্গ কিলোমিটারের এই মেলাকে বিশ্বের এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় মেলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মেলার আয়োজন করতে গিয়ে গোটা সাংহাই শহরকেই যেন নতুন করে গড়েছে চীন।
১৯০ দেশ আর ৫৭ প্রতিষ্ঠানঃ
২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন ব্যুরো থেকে ওয়ার্ল্ড এক্সপো আয়োজনের মনোনয়ন লাভ করার পর থেকেই আটঘাঁট বেঁধে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করে চীন সরকার। সাংহাইর বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয় মেলার স্থাপনা নির্মাণের কাজ। শুধু মেলা উপলক্ষেই নতুন করে তৈরি করা হয়েছে বিমানবন্দর, রেলপথ, রাস্তা ঘাট এবং পার্ক। এই মেলার আয়োজন করতে গিয়ে হুয়াংপু নদীর দুই তীর ছেড়ে যেতে হয় ১৮ হাজার পরিবারকে। গুটিয়ে নেয়া হয় ২৭০টি শিল্প কারখানা।
এর মধ্যে দশ হাজার শ্রমিকের কাজের ক্ষেত্রে চায়না ন্যাশনাল শিপইয়ার্ডও রয়েছে। তবে তাদের সবার জন্যই বিকল্প ব্যবস্থা করেছে চীন সরকার। সব কিছু ছাপিয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলো ঝলমলে এক বিস্ময়ের নগরী সাংহাই, আর তার প্রাণকেন্দ্রে থাকা হুয়াংপু নদীর দুই তীর।
বিশ্বের ১৯০টি দেশ এবং ৫৭ টি প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্ভাবনার পসরা জমাতে হাজির হয়েছে সাংহাই এক্সপোতে। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে সাজিয়েছে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান ও দেশের প্যভিলিয়ন।
চোখ জুড়ানো প্যাভিলিয়নগুলোর সামনে প্রতিদিনই থাকছে মানুষের লম্বা লম্বা লাইন। শুধু প্রথম তিন দিনেই মেলায় এসেছেন ৫ লাখ ষাট হাজার দর্শক। এসব দর্শককে পালাক্রমে সামলাচ্ছে ১ লাখ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। মেলার চারপাশে ২৪ ঘন্টা নিরাপত্তা আয়োজনে ব্যস্ত ৪৬ হাজার পুলিশ অফিসার। তারপরও এতো বড় আয়োজন নিয়ে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে মেলা কর্তৃপকে।
সবকিছু মিলিয়ে ১৪/১৫ ডিগ্রী শীতল তাপমাত্রায়ও এখনো উত্তাপের মধ্যেই আছে সাংহাই। চীনের আশাছিল এ উত্তাপে গা ভাসাবে বিশ্বের সাত থেকে দশ কোটি দর্শনার্থী, যা বেইজিং অলিম্পিকের আসা দর্শকের দশগুন এবং সেই প্রত্যাশা পুর্ণ হয়েছে মেলা শেষ হবার এক মাস পুর্বেই।
প্রযুক্তি, ইতিহাস ও প্রকৃতিঃ
উন্নত দেশগুলো তাদের প্যভিলিয়নকে সাজিয়েছে চোখকাড়া সব প্রযুক্তির সমন্বয়ে। চীন তার নিজের প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে ভার্চুয়াল বাঁশবন দিয়ে। স্পেনের প্যাভিলিয়নের সামনে রয়েছ এক বিরাট শিশু, ইলেক্ট্রনিক এনিমেটেড শিশু।
শিশুটিকে দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন দশনার্থীরা। ইলেক্ট্রনিক রডের মাধ্যমে ষাট হাজার বীজ সংরক্ষণের মাধ্যমে সিড ক্যাথিড্রাল সাজিয়েছে যুক্তরাজ্য। ডেনমার্ক তার ঐতিহ্যের প্রতীক সেই মৎস্য কন্যার গোটা ভাস্কর্যটিই তুলে এনেছে চীনের এই মেলায়। রাশিয়া তার প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছে শিশুদের কল্পনায় ভবিষ্যত শহরের ধারণা নিয়ে। আইস ল্যান্ডের প্যাভেলিয়ন যেনো বিশাল এক বরফের পাহাড়!
শুধু ভবিষ্যত প্রযুক্তি নয় ইতিহাসের আর প্রকৃতির উপস্থাপনও গুরুত্ব পেয়েছে কোন কোন প্যাভিলিয়নে।
যেমন নমেডিক যুগের মানুষরা কিভাবে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান বজায় রাখত তাই উঠে এসেছে কিরগিজিস্তানের প্যাভিলিয়নে। চীন বলেই হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ মুহূর্তে এসে মেলায় তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী কিনটনের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ৬ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে ষাট হাজার বর্গফুটের প্যাভিলিয়ন পেতে সমর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। “রাইজিং টু দ্য চ্যালেঞ্জ” থিম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাভিলিয়নে অংশ নিয়েছে শেভরন, সিটি গ্রুপ, জনসন এন্ড জনসন ও পেপসিসহ ৫৬ টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। সিসকো এবং কোকা কোলা আলাদাভাবে অংশ নিয়েছে নিজস্ব প্যাভিলিয়ন নিয়ে।
সবগুলো প্যাভেলিয়নেরই নিজস্ব বার্তা এবং স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলেছে-যা আলাদা করে বলতে/লিখতে গেলে এই সিরিজ বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার "মেঘা ধারাবাহিক" নাটকএর মত হয়ে যাবে। আমি সেই পথে যাবোনা। আমার ভালো লাগা দুটো প্যাভেলিয়ন সম্পর্কে আলাদা করে কিছু না বললেই নয়। এর একটি হচ্ছে সৌদি আরবের প্যাভেলিয়ন আর অন্যটি হচ্ছে বৃটিশ প্যাভেলিয়ন। সৌদী আরবের প্যাভিলিয়নটি যেনো মরুর বুকে একটুকরো সবুজ মরুদ্যান।
সেই মরুদ্যানেও আছে ভিন্ন মাত্রা! সৌদি প্যাভেলিয়ন সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছিলাম। এই প্যাভেলিয়ন সম্পর্কে আলাদাকরে একটুখানি বর্ণনা নাদিলেই নয়! এই প্যাভেলিয়নটি তৈরী করা হয়েছে সম্পুর্ণ ক্রিস্টাল গ্লাশ/পাথর দিয়ে। এর স্পেশালিটি হচ্ছে-সময়ের গতির সাথে সাথে প্যাভেলিয়নের সৌন্দর্য্যের পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন, সকালে যা দেখতে অনেকটা কুয়াশা আবৃত, দুপুড়ে তা হয়েযায় কিছুটা বাদামী রংযের, বিকেলে সোনালী আভায় আর রাতে চাঁদের আলোর মত আলোকিত হয়ে যায়-তা আকাশে চাঁদ থাকুক কিম্বা নাই থাকুক! সব থেকে মজার বিষয় হলো-এই প্যাভেলিয়নের রঙ বদলানোর বিষয়টা মোটেই আর্টিফিশিয়াল লাইটিং নয়-সম্পুর্ণটাই ন্যাচারাল আলোর প্রতিফলনে ক্রিস্টালের পরিবর্তিত ন্যাচারাল রুপ। ক্রিস্টালের খেজুর গাছগুলোও যেন জীবন্ত হয়ে সবুজের কাঁচা রঙ ছড়াচ্ছে! এই প্যাভেলিয়ন তৈরী করেছে একদল বৃটিশ-জার্মান আর্কিটেক্ট।
প্যাভেলিয়ন নির্মানে খরচ হয়েছে মাত্র ১৬.৪০ মিলিয়ন ডলার!
সৌদি আরব প্যাভেলিয়ন
বৃটিশ প্যাভেলিয়নটিও সম্পুর্ণ কৃস্টাল চীপস দিয়ে তৈরী। এই প্যাভেনিয়নে ২ কোটি ৮৮ লক্ষ কৃস্টাল চীপস/শলাকা ব্যবহার করা হয়েছে। এর স্পেশালিটি হচ্ছে-শরত কালে আমাদের দেশের নদীর তীরে কাশবনের সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ক্রিস্টাল চীপসের মাধ্যমে। দেখতে অবিকল কাশ বন। সব থেকে মজার বিশয় হচ্ছে-এই প্যাভেলিয়নটি বাতাসে দোল খায় ঠিক যেমন করে কাশবনে বাতাশ লাগলে ঢেউ খেলানোর দৃশ্য! এই সৌন্দর্য্যের বর্ণনা লিখে বোঝানো আমার কম্ম নয়!
[
বাংলাদেশী প্যাভেলিয়ন
১৮৫১ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে গ্রেট এক্সিবিশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ওয়ার্ল্ড এক্সপোর যাত্রা।
শিল্প বিপবের অন্যতম সূতিকাগার ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে বিশ্বকে জানান দেয়াই ছিল সেই মেলার মুখ্য উদ্দেশ্য। তার পর থেকে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দিতে এ ধরনের বর্ণাঢ্য আয়োজন করে থাকে। চীনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি খুব আলাদা নয়। এখনও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বিবেচিত হলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন এক সমীহ জাগানো নাম। চীনের অর্থনীতির এগিয়ে চলছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে।
অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এমন ব্যয়বহুল মেলায় অংশ নেয়া নিয়েই দোটানায় ভুগতে ভুগতে অংশ নিয়েছে, সেখানে চীন এই মেলার এক প্রস্তুতি পর্বেই খরচ করেছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। মেলা থেকে চীনের লাভ তো দূরের কথা, খরচের অর্ধেক অংশও উঠে আসেনি। এত অর্থ ব্যয় মিতব্যয়ী চীনের স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। তবে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকে ক্রমশ চোখ রাঙ্গানো চীন তার সামর্থ্যরে জানান দিতেই এই অকল্পনীয় আয়োজনে নেমেছিল। চীনের এই আয়োজন ভবিষ্যতের এক্সপো আয়োজনকারী দেশগুলোর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে, বলাই বাহুল।
(মেলা উপলক্ষে সাংহাই সিটির সকল স্টার এবং ফাস্ট ক্লাশ হোটেল সীট খালি নেই। আমরা মাত্র ৫ দিনের জন্য হোটেল বুকিং পেয়েছিলাম-তিন মাস পুর্বে বুকিং দিয়েও! তাই সাংহাইতে ৫ দিন থেকে আমরা চলে যাই শেনচেন। আগামী পর্বে থাকবে শেনচেনের কথা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।