দারুচিনি দ্বীপে যাওয়ার শখ ছিলো অনেক আগে থেকেই, বেশ কয়েকবার কক্সবাজার ঘুরে এলেও দারুচিনি দ্বীপে যাওয়া হয়নি একবারও। তাই এবার বেশ জোরেসোরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দারুচিনি দ্বী্পকে আমরা সবাই সেন্টমার্টিন নামেই চিনি। এর আরো একটি নাম আছে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’, স্থানীয়রা এই নামেই ডাকে। প্রচুর নারিকেল উৎপন্ন হয় এই দ্বীপে তাই এরুপ নামকরন।
এবার ছয়দিনের ছুটি ছিলো। কক্সবাজারের হিমছড়ি,মহেশখালি,ইনানী বীচ চষে বেড়ানো শেষে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দিকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। জাহাজের টিকেট রাতেই কাটা হয়ে গেছে। আমাদের জাহাজের নাম এল,সি,টি কুতুবদিয়া।
আমার স্বামী জাহাজের এক্সিকিউটিভ সুইটগুলো ভাড়া করতে চেয়েছিলো। আমিই না করলাম। ডেকে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার মজাই আলাদা। শেষ পর্যন্ত ওপেন ডেকের বিজনেস ক্লাস সিটের টিকেট কাটা হল। আমাদের গাড়ী টেকনাফের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে।
চারপাশের সবুজ শ্যামলে ঘেরা প্রকৃতি আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে পুরোটা সময়। সবুজ সুন্দরের মাঝে এ এক দারুন ভাললাগা, যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা!প্রকৃতির এই ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে কখন যে টেকনাফ পৌছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। তীরে নোঙ্গর ফেলে যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের জাহাজ। টিকেট চেক শেষ হওয়ার পর উঠে পড়লাম জাহাজে। সিট নাম্বার অনুযায়ী বসতে গিয়ে পড়লাম বিপত্তিতে।
ওমা! একি! আমাদের সিটে আগে থেকেই কারা যেন বসা। কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাইয়া এগুলো তো আমাদের সিট, আপনি কি আপনার টিকেটটা আর একবার চেক করবেন?’
ভদ্রলোক তাদের টিকেট বের করলো। আশ্চর্য আমাদের সিট নাম্বার একই। আমার তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো!আমার হাজব্যান্ড আবার অত্যন্ত কুল ব্রেনের অধিকারি। সে আমাকে শান্ত থাকতে বলে নিচে গেলো ডেকের দায়িত্বে থাকা ছেলেটিকে ডেকা আন্তে।
সে এসে অনেক মাফ টাফ চেয়ে আলাদা দুটো চেয়ারের ব্যাবস্থা করে দিলো এবং ঐ ভদ্রলোককে রিকোয়েস্ট করলো চেয়ারে গিয়ে বসার জন্য, কারন আমাদের সাথে বাচ্চা আছে আর তাছাড়া আমরা টিকেট কেটেছি রাতে আর উনি কেটেছেন কিছুক্ষন আগে, তো আমাদের ই অধিকার বেশী। কিন্তু ভদ্রলোক কিছুতেই সিট ছাড়লো না। অগ্যতা বাধ্য হয়ে আমাদেরকেই চেয়ারে বসতে হল। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন প্রায় দু ঘন্টার পথ। পুরোটা সময় জুড়ে আমার মেয়ে জাহাযে দৌড়ুদৌড়িতে ব্যস্ত ছিলো আর তার বাবা ব্যস্ত ছিলো তাকে নিয়ে।
কেউই বসে ছিলো না, সবাই রেলিঙ্গে ভর দিয়ে দাড়িয়ে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। আমিও তাই।
কিচ্ছুক্ষন পর পাশের ভদ্রলোককে দেখলাম তার সঙ্গীকে নিয়ে উঠে গেলো, রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে দুজন টুকটুক করে গল্প করছে। ঘন্টাখানেক পর আমি উঠে গিয়ে ভদ্রলোককে বললাম ‘কি ভাইয়া, বসার জায়গা নিয়ে তো মারামারি লেগে যাচ্ছিলেন প্রায়!! এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন যে ??’
ভদ্রলোক আমার কথা শুনে হেসে দিলো। আমিও হেসে দিলাম।
শেষমেশ তাদের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমাদের, পুরো রাস্তা গল্প করতে করতে গেলাম।
নাফ নদীর নীল আর বাদামী পানি কেটে কেটে আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে স্বপ্নের দ্বীপ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। জাহাজ থেকেই দেখা যায় মায়ানমারের সীমান্ত। নাফ নদীই তার প্রবাহমান ধারায় ভাগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ও মায়ানমার কে।
তখন বেলা প্রায় ১২ টা।
সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি পৌছে গেছি আমরা। দূর থেকে দ্বীপটিকে দেখে মনে হচ্ছে ঘন নীল সমুদ্রের মধ্যে একটু সবুজের ফোঁটা!জাহাজ থেকে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখছি সবকিছু আর বিস্মিত হচ্ছি। এত সৌন্দর্য! এত সৌন্দর্য!! ঝিমধরা এই নীল সৌন্দর্য যাত্রার সব ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দিয়ে মনটাকে একদম ফ্রেশ করে দিলো। দুপুরও হয়ে গেলো। ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিলো।
একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারটা সেরে নিলাম। মাছ আর শুটকির হরেক রকম পদ। যা খাচ্ছি অমৃতের মত লাগছে!খাওয়া দাওয়া শেষে আবারো ঘুরতে বের হলাম। চারিদিকে শুটকির দোকানের ছড়াছড়ি।
বীচের পাশে সারিসারি নারিকেল গাছ।
সম্পুর্ন বীচেই অসংখ্য প্রবালের ছড়াছড়ি। কিছু কিছু প্রবাল আবার বেশ ধারালো, খালি পায়ে হাটার জো নেই!স্থানীয় এক লোকের সাথে কথা হল, সেন্টমার্টিনে নাকি ধান ও তরমুজের ও ভালো চাষ হয়। দ্বীপের মাঝখানেই ছোট একটা বাজার আছে। মাছ ও শুটকি ছাড়াও সামুদ্রিক শামুক ঝিনুক নিয়ে তৈরী গহনা গাটিও পাওয়া যায় সেখানে। শখের বসেই কিনে নিলাম বেশ কিছু।
ঘুরতে ঘুরতেই চোখে পড়লো ‘সমুদ্র বিলাস’, হুমায়ুন আহমেদের বাড়ী। একদম বীচের পাশেই।
ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বিকেল হয়ে গেলো টেরই পেলাম না। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে এলো তাই জাহাজে উঠে পড়লাম। অপরূপ সৌন্দর্য চোখে নিয়ে আবারো ফিরে এলাম কক্সবাজারে।
ফেরার সময় উপভোগ করলাম নাফ নদীতে সূর্যাস্তের দৃশ্য। মায়াবী আলোয় মনটা ভরে গেলো। অপরূপ মোহনীয় সুন্দর সেই স্মৃতি সত্যিই ভোলার নয়!
বিঃদ্রঃ ১ ও ২ নং ছবি নেটের সৌজন্যে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।