Mahmood Khan
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে গবাদিপশু ও মানুষে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। সব মেরুদ-ী প্রাণী অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগে আক্রান্ত হলেও গবাদিপশুর ক্ষেত্রে এ রোগটি খুবই মারাত্মক। Bacillus Anthracis নামক জীবাণু সংক্রমণের মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে ছাগল ও ঘোড়া কম আক্রান্ত হলেও সংবেদনশীলতার দিক থেকে মানুষের স্থান গরু ও ছাগলের মাঝামাঝি। কিন্তু যেভাবে এই অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়াচ্ছে তার চেয়ে মানুষ বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছে।
একটু সচেতন ও সতর্ক হলে খুব সহজে এ রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গগুলো হচ্ছে উচ্চ তাপমাত্রা (১০৭ ফা.) কাঁপুনি, পেটফাঁপা, শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা ও লাফালাফি করে মারা যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে নাক ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে কালো রক্ত বের হবে। এ ধরনের উপসর্গই প্রমাণ করে অ্যানথ্রাক্স। শতকরা ৯৫ শতাংশ রোগ শুরু হয় চামড়ায়। চামড়ার কোনো সূক্ষ্ম ক্ষত দিয়ে বা চামড়া দিয়েই ঢোকে এই মারণ জীবাণু।
বাকি মাত্র ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ও খাবারের মাধ্যমে ফুসফুস আক্রান্ত হয়। উল্লেখ্য, যে জীবাণুর অনুপ্রবেশ থেকে রোগের বহির্প্রকাশ পর্যন্ত সময় লাগে এক থেকে তিন দিন। চামড়ার মধ্য দিয়ে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটলে প্রথমে জলবসন্তের মতো গুটি হয়। কখনো কখনো তাতে লালচে জলীয় পদার্থ থাকে। পরে সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং জায়গাটা ফুলে যায়।
সঙ্গে থাকে জ্বর, মাথাব্যথা ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নাসিকা-গ্রন্থী ফুলে যায়। ঠিকমতে চিকিৎসা না পেলে এ রোগ সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। তবে সব থেকে মারাত্মক হলো যখন এই জীবাণু সরাসরি শ্বাসের মাধ্যমে ঢুকে শ্বাসযন্ত্র বা মস্তিষ্কে আক্রমণ করে।
তীব্র শ্বাসকষ্ট, ভয়ানক জ্বর, কাশি, বুকে জল জমা ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ।
কখনো এই জীবাণুর সরাসরি আক্রমণের জন্য আবার কখনোবা এই জীবাণু থেকে ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যাদি রক্তে মিশে গিয়ে অতি দ্রুত বিপত্তি ঘটায়। অ্যানথ্রাক্স মারাত্মক মারণ রোগ হলেও বর্তমানে নানা রকমের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এ রোগ সেরে যায়। তবে শ্বাসযন্ত্র বা মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে রোগীকে বাঁচানো শক্ত হয়ে যায়।
অ্যানথ্রাক্স রোগের বিস্তার সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবির) ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, অ্যানথ্রাক্স শুধু গরু মহিষেই নয়, ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া, শূকর, বাঘ, ভালুুক, এমনকি হাতীতেও রোগের সৃষ্টি করে। এ রোগ যেহেতু প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রামিত হয়, সে কারণে একে জোনোটিক ডিজিজও বলা হয়।
সংক্রমণের মাধ্যম তিনটি যথাÑ শ্বাসনালীর মাধ্যমে, খাদ্যনালীর মাধ্যমে এবং সরাসরি চর্মের ক্ষতের মাধ্যমে। মশা মাছি ও রোগাক্রান্ত গবাদিপশু হতে রক্তগ্রহণ পূর্বক মানুষে রোগের জীবাণু প্রবেশ ঘটায়। আমাদের মতো স্বল্পউন্নত দেশে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখা তো দূরের কথা, প্রয়োজনে মুচি মৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ করে বাকি অংশ রাস্তার ধারে, খাল বা জলাধারে ফেলে দেয়। এর ফলে কুকুর, শিয়াল, কাক এবং শকুন মাংস খায়। কুকুর হাড়গুলো নিয়ে বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘোরাফেরা করে মরণব্যাধি অ্যানথ্রাক্সের স্পোরগুলো দুই চার কিলোমিটার ছড়িয়ে দেয়।
উল্লেখ্য, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু মাটিতে ২০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। স্বাভাবিক সুস্থ গবাদিপশু ওই এলাকার ঘাস বা পানি খেলেই পুনরায় আক্রান্ত হতে পারে। এভাবেই বছরের পর বছর একটি মৃত প্রাণীই রোগ ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। এ রোগের প্রভাব বর্ষা মৌসুমেই বেশি। অ্যানথ্রাক্সে মৃত গবাদিপশুর চামড়া ছাড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এ ক্ষেত্রে অসুস্থ গরুর মাংস তৈরিতে নিয়োজিত যেকোনো ব্যক্তির দেহে স্পোর প্রবেশ করতে পারে। বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে এ রোগের মড়কের সময় আক্রান্ত পশুর মৃত্যুর ভয়ের কারণে পশু জবাই করে মাংস খেয়ে ফেলে। এ ক্ষেত্রে মাংস কাটার সময় মানুষের এ জীবাণু সংক্রমিত হয়। এছাড়া মৃত পশুর সংস্পর্শে মানুষের এ রোগ হয়।
অ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আবু হাদী নূর আলী খান জানান, অ্যানথ্রাক্স রোগের ভ্যাকসিন অনেক আগে উদ্ভাবন করা হয়েছিল।
তবে বর্তমানে পাওয়া জীবাণুর সঙ্গে আগে উদ্ভাবন করা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার সামাঞ্জস্য রয়েছে কি না এ নিয়ে গবেষণা দরকার। অ্যানথ্রাক্স রোগটি মারাত্মক বটে; কিন্তু নিয়মিত টিকা দিলে গবাদিপশুকে শতভাগ সুস্থ রাখা সম্ভব। যেসব পশু এরই মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেসব পশুকে নতুন করে ভ্যাকসিন দিয়ে কোনো লাভ নেই। এছাড়া আক্রান্ত পশুকে অবশ্যই সুস্থ পশু ও মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে।
অপরদিকে ড. সিদ্দিক জানান, একই এলাকায় বারবার অ্যানথ্রাক্স রোগ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
একমাত্র টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে সুস্থ পশুকে এ রোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব। আক্রান্ত পশুকে ভ্যাকসিন দেয়া হলে পুনরায় ভ্যাকসিন দেয়ার প্রয়োজন নেই। মনে রাখতে হবে, যেসব পশু ইতিমধ্যেই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে সেসব পশুকে ভ্যাকসিন দিয়ে কোনো লাভ হবে না। ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ রোগ প্রতিরোধক টিকা প্রস্তুত করে। এ টিকার মাত্রা হলোÑ গরু, মহিষ ও ঘোড়ার ক্ষেত্রে ১ মিলিলিটার এবং মেষ, ছাগল ও শূকরের ক্ষেত্রে ০.৫ মিলিলিটার।
টিকা প্রয়োগের সময় টিকার বোতল প্রথমে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। পরে জীবাণুমুক্ত সিরিঞ্জে নির্দিষ্ট মাত্রার টিকা নিয়ে পশুর ঘাড়ের চামড়ার নিচে ইনজেকশন দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন আক্রান্ত এবং মৃত পশুর মাধ্যমে এ রোগ না ছড়ায়। অ্যানথ্রাক্স রোগাক্রান্ত পশুর মৃত্যু হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। এ রোগের স্পোর সৃষ্টির আগেই মৃত পশুর গোয়াল ঘরকে গরম ১০% সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড দিয়ে ধৌত করলে জীবাণুর মৃত্যু ঘটে।
তবে স্পোর সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে ঘন জীবাণুনাশক পদার্থ যেমনÑ ৫% লাইসোল দুই দিন বা ফরমালিন বা সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড ৫-১০% অথবা পারঅ্যাসিটিক অ্যাসিড ৩% এ জীবাণুর স্পোরের বিরুদ্ধে কার্যকর। চামড়া ও পশম গামারেডিয়েশন জুতা প্লাস্টিকের ব্যাগ ইথাইলিন অক্সাইডে ও দূষিত কাপড়চোপড় ১০% ফরমালিনে চুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যায়। এ রোগে মৃত পশুকে ২ মিটার গভীর গর্তে পর্যাপ্ত কলিচুন সহযোগে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে হবে। আক্রান্ত মৃত পশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় পশুর নাক, মুখ, পায়ুপথ ও মলদ্বার তুলা বা কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। আক্রান্ত গরুর গোয়ালঘর কাপড় কাচার সোডা বা ব্লিচিং পাউডার বা পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
রোগাক্রান্ত মৃত পশুর চামড়া ছাড়াবেন না, মৃত পশুটি জরুরি ভিত্তিতে ৬/৭ ফুট মাটির গর্তে পুঁতে রাখুন। মৃত প্রাণীটি গর্তে রেখে দেহের উপরিভাগে চুন বা ঈধষপরঁস ড়ীরফব দ্বারা আবৃত করে মাটিচাপা দিতে হবে। অন্যান্য রক্ত, লালা, দড়িসহ সবই মাটির গর্তে পুঁতে রাখুন। তবে মানুষ হিসেবে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। নিয়মিত ও সঠিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে অ্যানথ্রাক্স রোগ হয় না।
উল্লেখ্য, বিগত বছরগুলোতে এ রোগ স্পোরাডিক ফর্মে ছিল, গবাদিপশু মারাও যেত; কিন্তু মানুষে ব্যাপক আকারে সংক্রমণ এ বছরই প্রথম।
এদিকে আক্রান্ত মানুষকে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে পরামর্শ দিয়েছেন বাকৃবির বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও হেলথ কেয়ার সেন্টারের চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. ফয়েজ আহমদ। তিনি জানান, এ ক্ষেত্রে ফেনক্সিমিথাইল পেনিসিলিন ৫০০ মি.গ্রা. ৬ ঘণ্টা পরপর ১৪ দিন অথবা টেট্রাসাইক্লিন বা ইরাইথ্রোমাইসিন বা সিপ্রোফ্লোক্সাসিন বা ক্লোরাম ফেনিকল প্রস্তুতকারক ও পরামর্শকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না বা এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মানুষদের একঘরে করে রাখা হয়েছে।
প্রচার প্রচারণার কারণে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ছে জেলার পর জেলাতে। বর্তমানে ১৩টি জেলায় পাঁচ শতাধিক লোক অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত। কিন্তু অ্যানথ্রাক্স আমাদের দেশে নতুন কোনো রোগ নয়। আগে বাংলাদেশে গবাদিপশুর, মানুষ এবং হাতির শরীরে এ রোগ ধরা পড়েছিল।
অধিকাংশ সময়ে মড়ক আকারে এ রোগ হয়ে থাকে। তবে অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এর জন্য দরকার সতর্কতা ও সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
সংগ্রহ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।