ভালো আছি নাবালিকা----নাজিব মাহফুজ
− বাবা...
− জি, মামণি।
− আমি আর আমার বান্ধবী নাদিয়া সবসময় একসঙ্গে...
− স্বাভাবিক প্রিয় মেয়ে আমার, কারণ সে তোমার বন্ধু।
− ক্লাসে, অবসরে, টিফিনের সময়...
− চমৎকার। সে খুব সুন্দর মেয়ে। আর ভদ্র।
− কিন্তু ধর্মক্লাসের সময় সে যায় এক রুমে, আর আমি অন্য রুমে ?
তিনি ওর মায়ের দিকে তাকান। দেখেন, ওর মা তার মুচকি হাসছেন। আর নিবিষ্ট মনে বিছানার চাদরে নকশি ফুটিয়ে তুলছেন। এখন এই নকশি কাজটা দেখতে তার বিরক্ত লাগছে । তিনি মেয়ের দিকে ফিরে মৃদু হেসে বললেন :
− এটা তো শুধু ধর্মের ক্লাসে।
− কেন বাবা ?
− কারণ, তোমার ধর্ম একটা, আর তার অন্যটা।
− সেটা কেমন, বাবা ?
− তুমি হলে মুসলিম আর সে খ্রিস্টান।
− কেন বাবা ?
− এখন তুমি ছোট। ওসব অনেক পরের বিষয়। তুমি পরে, বড় হলে বুঝতে পারবে।
− আমি বড় বাবা।
− আসলে তুমি ছোট, প্রিয় মেয়ে..
− কেন আমি মুসলিম ?
তিনি জানেন, তার এখন উদার মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। তবে একই সাথে তাকে সাবধানও থাকতে হবে। তিনি সন্তানের প্রথম অভিজ্ঞতার এই মুহূর্তগুলিকে এড়াতে পারেন না। আধুনিক মানসিকতার দীক্ষা যে অনুষঙ্গকে ঘিরে তৈরি হয়েছে, তাকেও তিনি অস্বীকার করতে পারেন না।
তিনি বললেন:
− বাবা মুসলিম, মামা মুসলিম, তাই তুমিও মুসলিম।
− আর নাদিয়া ?
− তার বাবা খ্রিস্টান, তার আম্মা খ্রিস্টান, অতএব সেও খ্রিস্টান।
− কেমন করে এটা হলো, বাবা ? তার বাবা চশমা পরে তাই ?
− না না, সেটা চশমার কারণে নয়। বরং এমনিই। এভাবে তো তার দাদাও খ্রিস্টান ছিলেন..তার দাদাও..
মনে হচ্ছে, তিনি স্থির করে নিয়েছেন, ‘তার দাদা, তার দাদা’ বলে বলে অনবরত দাদাদের পরম্পরা অনুসরণ করে যাবেন, যতক্ষণ মেয়ের এ প্রশ্ন শেষ না হয়।
বাবার এমন জবাব শুনে মেয়ে খানিকটা বিরক্ত। ফলে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য বিষয় আনলো। মেয়েটি এবার প্রশ্ন করলো :
− কে ভালো, বাবা ?
তিনি একটু ভাবলেন, তারপর বললেন :
− মুসলিমও ভালো, খ্রিস্টানও ভালো।
− কি বলছো ! দু’টোর মধ্যে একটাই তো ভালো হয়ে থাকে। অবশ্যই যে কোনো ‘একটা’ ভালো।
− না, এটাও ভালো, ওটাও ভালো।
− আমি কি তবে খ্রিস্টানদের কাজ করতে পারি ? তাহলে আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকবো।
− কিছুতেই না, মেয়ে আমার। সেটা সম্ভব না। প্রত্যেকে তার বাবা ও মায়ের মতো চলতে থাকবে..
− কিন্তু কেন ?
তিনি ভাবলেন, সত্যিই তো।
আধুনিক শিক্ষাদীক্ষাটা বেশি বাড়াবাড়ি ধরনের ! ছেলেমেয়েরা তেমন শিক্ষা পাওয়ার ফলেই যত আজগুবি প্রশ্ন করে বসে। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন :
− তুমি কি বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না ?
− না বাবা।
− আচ্ছা, তুমি তো স্টাইল বা ফ্যাশন বোঝো। যে কোন ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট স্টাইল গ্রহণ করে থাকে। কেউ কেউ পুরাতন স্টাইলে চলতে ভালোবাসে।
তুমি হলে মুসলিমা আর সে হলো অন্য; তার চালচলন আলাদা। স্টাইর ভিন্ন। এজন্যই তোমাকে মুসলিম থাকতে হবে।
− এর মানে কি নাদিয়া পুরাতন স্টাইলের ?
− আল্লাহই একদিন তোমার আর নাদিয়ার মধ্যে বিচ্ছেদ করে দেবেন।
বাহ্যত: তিনি সাবধানতায় বাধ্য হয়ে ভুল করছেন।
আর তিনি ক্রমশ বিষয়টিকে কাঁচের বোতলের সরু মুখের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বললেন :
− এটা একটা মজার ব্যপার। সবাই তার বাবা ও মায়ের মতো থাকবে..
− আমি কি তাকে বলবো বাবা, যে, তুমি পুরাতন ধ্যান-ধারণার, আর আমি হাল ফ্যাশনের ?
তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্তস্বরে বললেন :
− প্রতিটি ধর্মই ভালো। মুসলিম আল্লাহর এবাদত করে। খ্রিস্টানও আল্লাহর এবাদত করে..
− কেন সে তার এবাদত করে এক রুমে থেকে, আর আমি তার এবাদত করি অন্য রুমে থেকে ?
− বরং তুমি এক ভাবে এবাদত কর, আর সে করে অন্য ভাবে..
− কি পার্থক্য বাবা ?
− আগামী বছর তুমি বুঝবে অথবা তার পরের বছর।
এখন এতটুকু বোঝাই যথেষ্ট যে, মুসলিম আল্লাহর এবাদত করে, খ্রিস্টানও আল্লাহর এবাদত করে।
− আল্লাহ কে বাবা ?
তিনি প্রশ্নটি নিলেন। ভাবলেন কিছুটা সময়। আরো সময় পেতে জিজ্ঞেস করলেন :
− বিদ্যালয়ে ধর্মশিক্ষিকা কী বলেছেন তোমাদের ?
− তিনি সূরা পড়ান, আমাদেরকে নামাজ শেখান। কিন্তু আমি জানি না বাবা, আল্লাহ কে।
তিনি ভাবনায় পড়লেন। এরপর রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বললেন :
− তিনি সারাটা জগত সৃষ্টি করেছেন।
− পুরোটা ?
− সব।
− সৃষ্টিকর্তা অর্থ কি বাবা ?
− যিনি প্রতিটি বস্তু তৈরি করেন।
− কিভাবে বাবা ?
− মহাশক্তির মাধ্যমে..
− কোথায় থাকেন তিনি ?
− জগত জুড়ে..
− আর এই জগত তৈরির আগে ?
− উপরে..
− আকাশে ?
− হ্যাঁ।
− আমি তাকে দেখতে চাই, বাবা।
− সম্ভব নয়।
− যদি টেলিভিশন থাকে ?
− তাও সম্ভব না।
− কেউ তাকে দেখে নি ?
− কখনো না। একবারেই না।
− কিভাবে জানলে তুমি তিনি উপরে আছেন ?
− ওটা এমনিতেই জানা যায়।
− কে জানিয়েছে তিনি উপরে ?
− নবিগণ।
− নবিগণ ?
− হ্যাঁ...যেমন আমাদের নবী মুহাম্মাদ [সাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম]।
− কিভাবে বাবা?
− তাঁর বিশেষ ক্ষমতার মাধ্যমে।
− তাঁর চোখে অনেক পাওয়ার ?
− হ্যাঁ।
− কেন বাবা ?
− আল্লাহ তাকে এভাবে বানিয়েছেন।
− কেন বাবা ?
তিনি জবাব দিলেন তার ফুরিয়ে যাওয়া ধৈর্য্যকে বশ মানিয়ে :
− তিনি স্বাধীন, যা খুশি তা-ই করতে পারেন..
− কেমন দেখেছেন তাকে ?
− অনেক মহান, অনেক শক্তিধর, সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন..
− যেমন, বাবা ?
তিনি কোমল হাসি ছড়িয়ে দিয়ে উত্তর দিলেন :
− তার কোন উপমা নেই।
− কেন তিনি উপরে থাকেন ?
− পৃথিবী তাকে স্থান দেওয়ার মতো প্রশস্ত নয়। তবে তিনি সবকিছু দেখেন।
মেয়েটি একটু দম নিয়ে বললো :
− কিন্তু নাদিয়া তো আমাকে বলেছে, তিনি পৃথিবীতেই থাকেন।
− কেননা, তিনি তো প্রতিটি স্থান দেখেন তাই প্রকারন্তরে তিনি যেন সব জায়গাতেই আছেন।
− ও বলেছে, একদল মানুষ তাকে হত্যা করেছে !?
− বরং তিনি চিরঞ্জীব, মৃত হবেন না।
− নাদিয়া বলেছে, লোকেরা তাকে মেরে ফেলেছে..
− একদমই না, মামণি। তারা মনে করেছে যে, তারা তাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু তিনি জীবিত, মরবেন না।
− আমার দাদুও কি জীবিত?
− তোমার দাদু মারা গেছেন।
− তাকে কি মানুষ মেরে ফেলেছে ?
− না না, তিনি একা একাই মারা গেছেন..
− কেমন করে ?
− অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তারপর মারা গেলেন।
− আমার আপুও তাহলে শীঘ্রই মারা যাবে ? সে অসুস্থ যে !
তিনি খানিকটা কপাল কুচকে দেখলেন। ভিতরের ঘরে সামান্য নাড়াচাড়া দেখে অনুমান করলেন, ওর মা আসছে :
− না না, আল্লাহ চাহে তো সে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
− তাহলে আমার দাদিজান মারা গেলেন কেন ?
− তার অসুখটা বড় ছিলো বলে..
− তুমিও তো বড় অসুখে পড়েছিলে, তারপরও তো মারা যাও নি!
মা এবার ধমকে উঠলেন।
হতবুদ্ধিতায় তার চোখ কপালে উঠেছে ততক্ষণে। বাবা বললেন :
− আমরাও মারা যাবো, যখন আল্লাহ আমাদের জন্য মৃত্যু চাইবেন।
− কেন তিনি আমাদের জন্য মৃত্যু চাইবেন?
− তিনি নিজ ইচ্ছাধীন। যখন যা চান, করতে পারেন।
− মৃত্যু কি খুব মজার, বাবা ?
− না তো, মা..
− তবে আল্লাহ কেন তেমন বিশ্রী কিছু চাইবেন ?
− সেটাও মজাদার হয়ে যেতে পারে, যদি তিনি তা আমাদের জন্য তেমন চান।
− কিন্তু তুমি তো বললে সেটা মজার কিছু নয় ?
− ভুল বলেছি, মামণি..
− তাহলে আম্মি কেন রাগ করলেন যখন আমি তোমার মরে যাওয়ার কথা বললাম !
− পরে তো আল্লাহ সেটা চান নি, তাই।
− সেটা তিনি কেন চান, বাবা ?
− তিনি আমাদের এখানে এনেছেন, আবার তিনি নিয়ে যাবেন।
− কেন, বাবা ?
− যাবার পূর্বে যেন আমরা এখানে সুন্দর ও চমৎকার কাজকর্ম করি।
− তারপর কেন আমরা এখানে থাকবো না ?
− এই পৃথিবী মানুষের জন্য চিরকাল থাকার মতো জায়গা নয়।
− আমরা যে সুন্দর সুন্দর জিনিসগুলো রেখে যাবো ?
− এর থেকে আরো বেশি সুন্দর জিনিসের কাছে আমরা যাবো।
− কোথায় ?
− উপরে।
− আল্লাহর কাছে ?
− হ্যাঁ।
− তাকে দেখতে পাবো আমরা ?
− হুঁ।
− সেটা কি খুব মজার হবে, বাবা ?
− স্বাভাবিক।
− এখনই তাহলে আমরা কেন যাই না ?
− কিন্তু আমরা সুন্দর কিছু করবো, তারপর তো।
− দাদু কি তা-ই করেছিলেন ?
− হ্যাঁ..
− কী করেছেন ?
− ঘর বানিয়েছেন, বাগান করেছেন..
− আর আমার মামার ছেলে তুতু কী করেছে ?
একমুহূর্তের জন্য তার মুখবায়ব ঝলকে উঠলো। তিনি চোরা চোখে একবার ওর মায়ের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন :
− সেও যাবার আগে একটা ছোট ঘর বানিয়েছে..
− কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির লুলু, ও তো আমাকে মারে। আর কোন ভালো কাজও করে না।
− সে একটা বদ ছেলে।
− তবে কি সে কখনোই মরবে না ?
− মরবে, যখন আল্লাহ চাইবেন..
− সে ভালো কোন কিছু না করার পরও মরবে ?
− সবাই মারা যাবে। যে ভালো কাজ করবে সে আল্লাহর কাছে যাবে, আর যে মন্দ কাজ করবে সে যাবে আগুনে।
মেয়ে একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেললো। তারপর একদম নীরব হয়ে গেলো। আর তিনি দীর্ঘক্ষণ বাদে আপতিত বিপদ থেকে মুক্তির অনুভূতি পেলেন।
কেবল জানা গেলো না কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল। প্রশ্নের গতিধারাই ছিলো এমন যেনো অনুসন্ধানের গভীরে জমে থাকা তলানিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি তার প্রশ্নের গতি তখনও সংবরণ করে নি। বললো :
− আমি নাদিয়ার সঙ্গে সবসময় থাকতে চাই, বাবা।
তিনি মেয়ের প্রতি জিজ্ঞাসু নেত্রে চাইলেন।
মেয়ে আবার বললো :
− এমনকি ধর্ম ক্লাসেও !
তিনি উচ্চস্বরে হেসে ফেললেন। তার মাও হেসে দিলো। তিনি হাই তুলতে তুলতে স্ত্রীকে বললেন :
− আমি কল্পনাও করি নি যে, প্রায় বিবাদ বাঁধিয়ে দেয়ার মতো সমানে সমান প্রশ্নোত্তর হবে !
স্ত্রী বললেন :
− মেয়ে একদিন বড় হবে। সে-সময় তুমি সব সত্য প্রমাণ করতে পারবে ?
মেয়েটি মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো তার মায়ের কথার সত্যটুকু উপলব্ধি করা পর্যন্ত। অথবা হয়তো ভাবছে, আবার কোন সুযোগে এমন করে বাবাকে ধরতে পারবে সে।
গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো সবাই।
[লেখক পরিচিতি : আরব দুনিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক নাজিব মাহফুজের সাহিত্যের মূলসুর ছিলো নারী। গদ্য সাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ থাকলেও চলচ্চিত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বহুবার তিনি সমালোচিত হয়েছেন। ১৯৩৯ সালে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণকালে তার প্রথম গল্প আবাথ আল আকদার (মোকারি অব দ্য ফেইটস) প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মিনিস্ট্রি অব ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স-এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এ সময় প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত বই ‘চিলড্রেন অব দ্য অ্যালি’। বইটিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ক্যারেক্টার, যেমন মোজেস, জেসাস এবং মুহাম্মদ ইত্যাদি থাকার কারণে মিশরে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। প্রায় অর্ধশতাধিক উপন্যাসসহ সাহিত্যের প্রায় সব অঙ্গনের শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা মাহফুজ ২০০৬ সালে কায়রোতে তিরোহিত হন। ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মিশরের রাজধানী এই কায়রোর গামালিয়াতেই জন্মগ্রহণ করেন নাজিব মাহফুজ। তবে ১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের পর নাজিবের আত্মজীবনী ‘ইকোস অব অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ আর ছোট ছোট স্বপ্নগাঁথা ‘ড্রিমস অব ইকিউপারেশন’ ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য পাওয়া যায় নি।
এই গল্পটি তার ‘খাম্মারাতুল কিত্ত্বিল আসওয়াদ’ (কালো বিড়ালের সরাইখানা) নামক আলোচিত গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘জান্নাতুল আতফাল’ গল্পের মূলানুগ অনুবাদ। গল্পের ভাষান্তর হয়েছে মূল আরবি থেকে। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।