সুদের ভয়াবহতা
ইতিমধ্যে আমরা সুদের সাথে পরিচিত হলাম এবং উক্ত সুদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী এবং রাসূল সা. এর হাদীস অবগত হলাম। মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী, রাসূল আকরাম সা. এর হাদীস এবং বর্তমান অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে এর এমন একটি ভয়াবহ চিত্র খুঁজে পাই যে, সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর জীবনের ন্যূনতম স্বার্থকতা বলতেও কিছু থাকে না। তাদের চিত্তাকর্ষক রঙ্গিন জীবনের অন্তরালে লুকিয়ে আছে চোরাবালির ন্যায় এক দুর্ধর্ষ মরণ ফাঁদ। যে ফাঁদে আটকে মানুষ কেবল মৃত্যুর মাধ্যমে ধ্বংসই হয়ে যায় না বরং অনন্ত কালের জন্য চরম দশায় নিপতিত হয়ে ধুকে ধুকে জ্বলতে থাকবে অথচ সে নিজে বা তার যন্ত্রণা কিছুমাত্র নিঃশেষ হবে না। সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জীবনের তিনটি পর্যায়ে সুদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে।
সুদ মানুষের তিনটি বিষয়ের উপর চরম আঘাত হানে। প্রথমতঃ মানুষের ঈমানদারীতায়, দ্বিতীয়তঃ পরকালীন মুক্তির বিষয়ে, তৃতীয়তঃ মানুষের ইহকালীন অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। অর্থাৎ সুদের কারণে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার অন্যতম মৌলিক পরিচয় ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হতে বঞ্চিত হয়, পরকালীন জীবনে মেহেরবান আল্লাহর অপূর্ব নিয়ামত জান্নাত লাভের পরিবর্তে জাহান্নামে নিপতিত হওয়াকে নিশ্চিত করে এবং যে দুনিয়ার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভের মাধ্যমে সুখ-সমৃদ্ধি লাভের স্বপ্ন দেখে সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে পরিশেষে দুনিয়ার সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা সুখ-শান্তি হতেও বঞ্চিত হয়। অর্থাৎ তার সব কূলই হয় অপসৃত। কুরআন, সুন্নাহ্ ও সমকালীন অর্থনৈতিক গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সুদ সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে Ñ
একজন ঈমানদার তার মৌলিক পরিচয় হারায়
কোন ব্যক্তি যখন সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে অর্থাৎ সুদ গ্রহণ করে, সুদ দেয় বা সুদের লেনদেনের সহযোগী হয়ে পড়ে তখন সে আর প্রকৃত ঈমানদার থাকে না।
সে হয় বেঈমান, অবিশ্বাসী বা কপট বিশ্বাসী। আমরা নিজের হাত দ্বারা চোখ টিপে ধরে দেখা থেকে চোখকে বঞ্চিত করতে পারি, নিজের কানে আঙ্গুল দিয়ে সাময়িক বধিরতা গ্রহণ করে শ্রবন থেকে বিরত থাকতে পারি, শয়তানী যুক্তিকে গ্রহণ করে বিবেককে করে দিতে পারি পরাভূত। কিন্তু যে মহান আল্লাহ্ পাক নির্ধারণ করবেন কে ঈমানদার আর কে বেঈমান তাঁর কাছে এর কোন কিছু দ্বারাই নিজের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। কেননা ইসলাম ঈমানদারের যে সংজ্ঞা দেয় কোন ব্যক্তি সুদ সংশ্লিষ্ট হলে সে আর উক্ত সংজ্ঞায় পড়ে না।
ঈমানদার বলতে কি বুঝায়, তা জেনে নিয়ে সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত পরিচয়ধারী কি না বিশ্লেষণ করলেই সুদ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঈমানদার হওয়া সম্পর্কে যথার্থ অবস্থা প্রতিভাত হবে।
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস। ইসলামী পরিভাষায় শুধুমাত্র বিশ্বাস করাকেই ঈমান হিসেবে গণ্য করা হয় না। তিনটি অবস্থার সহাবস্থানের নাম হলো ঈমান। এ তিনটি অবস্থা হলো প্রথমতঃ কোন একটি বিষয় দৃঢ়তার সাথে অন্তরে বিশ্বাস করা, দ্বিতীয়তঃ দ্ব্যর্থহীনভাবে উক্ত বিষয়ে মৌলিক ঘোষণা বা স্বীকৃতি দেয়া এবং তৃতীয়তঃ বাস্তব কার্যাদীর মাধ্যমে নিজের বিশ্বাসের বাহ্যিক পরিস্ফুটন ঘটানো। এখন প্রশ্ন হলো কি কি বিষয়ের উপর ঈমান আনতে হবে? এবং এ বিশ্বাস স্থাপনের মর্মার্থ কি এবং এর বাস্তব দাবী কি?
পবিত্র কালামে হাকীমে মহান আল্লাহ্ পাক বলেন ঃ “তোমরা পূর্বদিকে মুখ করলে, না পশ্চিমদিকে মুখ করলে এতে সত্যিকার অর্থে কোনই কল্যাণ নিহিত নেই।
আসল নেকীর ব্যাপার হচ্ছে, একজন মানুষ আল্লাহ্্র উপর ঈমান আনবে, পরকালের উপর ঈমান আনবে, ঈমান আনবে আল্লাহ্্র ফিরিশতাদের উপর, আল্লাহ্্র কিতাবের উপর, নবী-রাসূলদের উপর।
Ñসূরা বাকারা ঃ আয়াত ১৭৭
পবিত্র কালামে হাকীমের উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ্্ তাআ’লা পাঁচটি বিষয়ের উপর ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। এ পাঁচটি বিষয় হলোÑ
(১) মহান আল্লাহ্্ পাকের উপর ঈমান।
(২) পরকালের উপর ঈমান।
(৩) আল্লাহ্্র ফিরিশতাদের উপর ঈমান।
(৪) আসমানী কিতাবসমূহের উপর ঈমান।
(৫) নবী-রাসূল বা রিসালাতের উপর ঈমান আনতে হবে।
এখন আমাদেরকে এ সকল বিষয়ের উপর ঈমান আনার অর্থ কি? ঈমান আনার কারণে আমাদেরকে কোন বিশ্বাস অন্তরে লালন করতে হবে এবং কি ধরনের ঘোষণা দিতে হবে ও কি কি বাস্তব কাজ সম্পাদন করতে হবে তা বুঝে নিতে হবে। সুদ সংশ্লিষ্ট কোন মানুষের এ সকল বিষয়ের উপর ঈমান থাকে কিনা তা বিবেচনা করতে হবে।
আল্লাহ্্র উপর ঈমান
মহান আল্লাহ্্ পাকের উপর ঈমান আনার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহ্্ সম্পর্কে কতিপয় বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করতে হবে এবং সেই সকল বিশ্বাসের মৌখিক স্বীকৃতি দিতে হবে ও নিজের বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রূপদানের মাধ্যমে বাস্তব সাক্ষী হয়ে দাঁড়াতে হবে।
মহান আল্লাহ্্পাক মানব জাতির কাছে পবিত্র কালামে পাকের মাধ্যমে নিজের পরিচয় পেশ করেছেন। একজন মানুষকে মুসলিম হতে হলে মহান আল্লাহ্্ পাকের সেই পরিচয় অনুসারেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, সেই পরিচয়ের মৌখিক স্বীকৃতি দিতে হবে এবং নিজের কার্যকলাপের মাধ্যমে আল্লাহ্কে সেই মর্যাদাই দিতে হবে। তবেই আল্লাহ্্র উপর তার পূর্ণ ঈমানের পরিচয় পাওয়া যাবে। সুতরাং নিজের ঈমানের পরিচয় পাওয়ার জন্য প্রথমে আল্লাহ্্ পাকের পরিচয় জানতে হবে এবং এ সম্পর্কে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের অবস্থা পর্যালোচনা করে ঈমানের অবস্থার পরিমাপ করতে হবে। আল্লাহ্ পাকের গুণবাচক নামসমূহের পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহ্্র পরিচয় জানা যায়।
যেমন ঃ
রব
পবিত্র কালামে হাকীমে সর্বপ্রথমই আল্লাহ্ পাকের এ গুণবাচক নামটি উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী বিশ্বকোষে রব শব্দের যে অর্থসমূহকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলে স্থান দেয়া হয়েছে তা হলোÑ১.মালিক ও মুনিব ২. মুরব্বি, প্রতিপালক, পর্যবেক্ষক ও সংরক্ষনকারী ৩. শাসক, আইনদাতা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। আল্লাহ্্ তাআ’লা এ সবদিক দিয়েই সমগ্র সৃষ্টিলোকের রব্ব। ১ কোন মানুষ যদি সুদ সংশ্লিল্ট হয় তবে সে মানুষের নির্দেশ মেনে নিল ফলে সে আল্লাহ্্র পরিবর্তে সেই মানুষটি বা মানুষগুলোকেই নির্দেশদাতা হিসেবে গ্রহণ করল। ফলে তারা খোদাদ্রোহী হওয়া স্বাভাবিক।
সুতরাং আল্লাহ্্র কাছে তাদের ঈমান আনার দাবী গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সে কপট বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
খালিক
খালিক শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা। এখানে এমন এক সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানো হয়েছে যিনি কোন কিছুর অস্তিত্ব ছাড়াই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষসহ জগতের সকল প্রাণীকূল সৃষ্টি করেছেন এবং মহাবিশ্বের সবকিছুই তাঁর একক সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহ্্র উপর ঈমান আনার পর ঈমানদার ব্যক্তিটিকে বিশ্বাস করতে হবে মহান আল্লাহ্ পাক মানুষসহ সমগ্র জগতের স্রষ্টা, তিনি অতীতে সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলেন, বর্তমানেও শক্তিমান এবং অনন্তর ভবিষ্যতেও তাঁর একই শক্তি পূর্ণমাত্রায় অটুট থাকবে।
সুতরাং মহান আল্লাহ্ই সর্বশক্তিমান। কোন মানুষ যদি প্রকৃতই আল্লাহ্্র এ বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশ্বাসী হয় তবে অবশ্যই সেই মানুষটির বাহ্যিক আচরনেও তা পরিলক্ষিত হবে। কোন মানুষ যদি আল্লাহ্কে এ জগতের স্রষ্টা হিসেবে বিশ্বাস করে এবং এও বিশ্বাস করে যে তিনি কুরআনে বর্ণিত জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করে পুনরায় সেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে সক্ষম তবে অবশ্যই কোন মানুষের পক্ষেই আল্লাহ্্র নাফরমানী করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যারা মহান আল্লাহ্্র নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করতে মোটেও চিন্তিত হয় না, তাদের মনে নিশ্চয় আল্লাহ্্র সৃষ্টি ক্ষমতার বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে বুঝতে হবে। তারা হয়ত মনে করে এ জীবন এক নিছক সৃষ্টি, মৃত্যুর পর যেহেতু দেহ পচে গলে মাটির সাথে নিঃশেষ হয়ে যাবে তা আর নতুন করে জীবিত হওয়া সম্ভব নয়।
আর তাদের এ ধরনের বিশ্বাসের কারণেই মূলতঃ তারা পরকালের ব্যাপারে উদাসীন। আর ট্রেডিশন হিসেবেই আল্লাহ্্র উপর আস্থা থাকার ঘোষণা দেয়। মূলতঃ তারা আল্লাহ্্র সৃষ্টি করার ক্ষমতার উপর ঈমান রাখে না। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই তাদের মুসলিম হওয়ার দাবী যুক্তিসঙ্গত নয়। যেহেতু সুদ আল্লাহর মৌলিক নিষেধাজ্ঞাসমূহের একটি সেহেতু কেউ সুদ সংশ্লিষ্ট হলে আল্লাহর উপর তার ঈমান আছে বলে প্রতিয়মান হয় না।
রাজ্জাক
রাজ্জাক শব্দটির বাংলা অর্থ হলো রিজিকদাতা। যে ব্যক্তিটি ঈমান লাভ করেছে সে আল্লাহ্কে রিজিকদাতা হিসেবেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে। উক্ত ব্যক্তির চলনে ও বলনে তার এ বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি প্রস্ফুটিত হবে। মহান আল্লাহ্ পাক সামষ্টিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবেও আমাদেরকে এককভাবে রিজিক দিয়ে থাকেন। সুতরাং প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত রিজিকদাতাও একমাত্র আল্লাহ্।
কোন মানুষ যখনই এ বিষয়ে ঈমান আনবে যে, তার রিজিকের ব্যবস্থা করার সামর্থ পৃথিবীর কোন শক্তিরই নেই; সে আল্লাহ্ পাকের আনুগত্যের ব্যাপারে এই অজুহাতে শিথীলতা প্রদর্শন করবে না যে, তার রিজিকের জন্য অপর কোন মানুষের উপর সে নির্ভরশীল। সে রিজিকের জন্য আল্লাহ্র অবাধ্য কোন শক্তির সহযোগী হতে পারবে না। এমনকি এ বিশ্বাসও তার মনে থাকবে না যে, আল্লাহ্্র বিধান লঙ্ঘনকারী কোন কর্তৃপক্ষ তার রিজিক বৃদ্ধিতে সামান্যতম অবদান রাখতে পারে বা কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত রিজিক বৃদ্ধি করতে পারে। সুতরাং চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির স্বার্থে সে কখনওই আল্লাহ্র আনুগত্যের ব্যাপারে আপোষ করবে না। আর যখনই সে এ বিষয়ে আপোষ করল মনে করতে হবে তার ঈমানের দূর্বলতাই সে আপোষের প্রেরণার মূল উৎস।
অতএব সুদ সংশ্লিষ্ট মানুষের আচরণে প্রমাণ করে সে আল্লাহ্কে রাজ্জাক বা রিজিকদাতা হিসেবে মানতে নারাজ।
সামি’উ এবং বাসির
আল্লাহ্ পাকের এ দুটি নামের প্রথমটির অর্থ সর্বশ্রোতা এবং দ্বিতীয়টির অর্থ সর্বদ্রষ্টা বা সূক্ষ্মদর্শী, সবজান্তা ইত্যাদি। আল্লাহ্ পাকের এ দুটি নাম দ্বারা প্রকাশ পায় মহান আল্লাহ্ পাক জগতের সকল স্থানের ক্ষুদ্র-বৃহৎ, প্রকাশ্য এবং গোপনীয় সবকিছু শোনেন এবং দেখেন। এমনকি মানুষের মনের গহীন কোনের চিন্তা ও পরিকল্পনাও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। যারা এ বিষয়টি বিশ্বাস করে আল্লাহ্পাকের শক্তি ও কঠোরতা সম্পর্কেও অবগত আছেন।
স্বাভাবিক কারণেই আল্লাহ্ পাকের সামনে তাদের দ্বারা আল্লাহ্ নিষিদ্ধ কোন কাজ সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। যদি তারা আল্লাহ্ নিষিদ্ধ সুদের মত কোন কাজে জড়িত থাকেন তবে বুঝতে হবে আল্লাহ্্র সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাদের মনে সংশয় রয়েছে তাদের ঈমানের দাবী কেবলই মৌখিক ও আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ। বাস্তবতঃ তারা যথাযথ ঈমানদার নয়।
ক্কাহ্হার, মুনতাকিম, দার
এখানে আল্লাহ্ পাকের তিনটি নাম উল্লেখিত হয়েছে যার প্রথমটির অর্থ হলো প্রভাবশালী, শক্তিশালী, দমনকারী ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং তৃতীয়টির অর্থ হলো অত্যন্ত ক্লেশদাতা, আযাবদাতা।
এখানে আল্লাহ্ পাকের এ তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ্ পাক তাঁর অবাধ্যদের বিষয়ে প্রতিশোধ গ্রহণকারী এবং তিনি প্রতিশোধ গ্রহণে নিশ্চিত সক্ষম ও শক্তিমান। সুতরাং যারা আল্লাহ্ পাকের অবাধ্যতায় লিপ্ত আল্লাহ্ পাক তাদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। আর তিনি তাদেরকে অত্যন্ত ক্লেশ বা আযাব দিবেন। এ আযাব পৃথিবীর কোন আযাবের সাথেই তুলনাযোগ্য নয়। কেননা দুনিয়ার আযাব সর্ব্বোচ্চ মৃত্যু পর্যন্ত।
তারপর দুনিয়ার আর কোন শাস্তিই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। অপরদিকে পরকালের আযাব অনন্ত, অসীম এবং তার কঠোরতাও অকল্পনীয়। অতএব যারা আল্লাহ্্র আইন লঙ্ঘন করে, সুদ সংশ্লিষ্ট হয় তারা এবং তাদের সমর্থনকারী ও সহযোগীরা আল্লাহ্্র শাস্তিতে পতিত হবে। এ অবস্থায় কোন ঈমানদার ব্যক্তির পক্ষে মানুষের শাস্তির ভয়ে বা রিজিকের ভয়ে তাদের আনুগত্য করে আল্লাহ্্র আযাবে পতিত হওয়াকে গ্রহণ করে নেবে না। প্রয়োজনে কষ্ট স্বীকার করে আল্লাহ্্র সীমাহীন শাস্তি হতে মুক্তি লাভ করে জান্নাত লাভের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হবে।
অতএব যারা এ পৃথিবীতে প্রাচুর্য লাভের জন্য আল্লাহ্্র আইনের পরিবর্তে সুদী অর্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিবে তারা মূলতঃ আল্লাহ্্র শাস্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার মতই ধৃষ্টতা দেখায়। তারা প্রকৃত ঈমানদার নয়।
পরকালের উপর ঈমান
একজন মানুষকে আল্লাহ্ পাকের উপর ঈমান আনার সাথে সাথে পরকালের উপর ঈমান আনতে হবে। পরকালই হলো মানুষের জীবনের সকল কর্মের কেন্দ্রবিন্দু। পরকালের উপর বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মুসলমানদের জীবনধারা আবর্তিত।
পরকালের জীবনই অনন্ত, সীমাহীন জীবন। মহান আল্লাহ্ পাক পরকালের প্রতি বিশ্বাসের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বলেন Ñ
“এবং যারা পরকালকে বিশ্বাস করবে না, তাদের জন্য রয়েছে পরকালের ভয়াবহ শাস্তি। ” Ñ সূরা বনী ইসরাঈল ঃ আয়াত ১০
মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে হাকীমে মানুষকে পরকালের সাথে বহু আয়াতের মাধ্যমে পরিচিত করে তুলেছেন। যেমন ঃ
“তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক শ্লাঘা ও ধনে জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার উপমা বৃষ্টি, যা দিয়ে উৎপন্ন শস্যসম্ভার কৃষকদের চমৎকৃত করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়।
ফলে তুমি তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। অবশেষে তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহ্্র ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ছাড়া কিছুই নয়। ” Ñ সূরা হাদীদ ঃ আয়াত ২০
অপর আয়াতে বলা হয়েছে Ñ
“শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন।
অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দণ্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে। পৃথিবী তার পালনকর্তার নূরে উদ্ভাসিত হবে, আমলনামা স্থাপন করা হবে, পয়গম্বরগণ ও সাক্ষীগণকে আনা হবে এবং সকলের মধ্যে ন্যায় বিচার করা হবে Ñ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। প্রত্যেকে যা করেছে তার পূর্ণ প্রতিফল দেয়া হবে। তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ সম্যক অবগত। কাফিরদেরকে জাহান্নামের দিকে দলে দলে হাঁকিয়ে নেয়া হবে।
তারা যখন সেখানে পৌঁছবে, তখন তার দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বর আসেনি যারা তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করতো এবং সতর্ক করতো এ দিনের সাক্ষাতের ব্যাপারে ? তারা বলবে, হ্যাঁ, কিন্তু কাফিরদের প্রতি শাস্তির হুকুম বাস্তবায়িত হয়েছে। বলা হবে তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্য। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল। যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করত তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌঁছাবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম।
তোমরা সুখে থাক। অতঃপর সদাসর্বদা বসবাসের জন্যে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর । তারা বলবে, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্্র, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী করেছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। আমলকারীদের পুরস্কার কতই না চমৎকার।
” Ñ সূরা যুমার ঃ আয়াত ৬৮ -৭৪
পবিত্র কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত আয়াতসমূহ হতে আখিরাতের যে চিত্র পাওয়া যায় তা হলো, আল্লাহ্্র নির্ধারিত কোন একটি বিশেষ সময়ে আল্লাহ্্র আদেশে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। যার ফলে এ পৃথিবীর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর পুনরায় আল্লাহ্্র নির্দেশে আরো একটি ফুঁক দেয়া হলে সকল মানুষই পুনরুজ্জীবিত হবে এবং সমবেত হবে। তখন আল্লাহ্পাক তাদের কৃতকর্মের বিচার করবেন এবং বিচারের সময় সকল সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করে পূর্ণ ন্যায় বিচার করা হবে । পৃথিবীতে যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে অর্থাৎ যারা ঈমান আনেনি অথবা ঈমান আনার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও মুনাফেকী করেছে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, যেখানে তারা চিরদিন থেকে সীমাহীন দূর্ভোগ আস্বাদন করবে এবং যারা ঈমানদার এ দুনিয়াতে আল্লাহ্্র হুকুম-আহকাম যথাযথভাবে পালন করেছে, শিরক থেকে, খোদাদ্রোহীতা থেকে বিরত ছিল তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে এবং আল্লাহ্্র সীমাহীন নিয়ামত ভোগ করবে এবং মহাসম্মানিত হবে।
সুতরাং যারা প্রকৃতই ঈমান এনেছে তারা পরকালের বিষয়ে আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাদেরকে যা কিছু অবগত করেছেন তার সবকিছুই আন্তরিকতার সাথে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবেন। স্বাভাবিক কারণেই তারা জাহান্নামের ভয়ে ভীত থাকবেন, ফলে তারা ইসলাম নিষিদ্ধ সুদ সংশ্লিষ্ট হয়ে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা লঙ্গন করবেন না এবং মহান আল্লাহ্ পাকের প্রতিশ্র“ত নিয়ামত জান্নাতের প্রত্যাশায় শত কষ্ট স্বীকার করে হলেও সুদ বর্জন করবে। পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় আল্লাহ্্র বিধি-বিধান অমান্য করে সুদ সংশ্লিষ্ট হয় তারা অবশ্যই পরকালকে অস্বীকার করে। যেমন ঃ মহান আল্লাহ্ পাক কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেছেনÑ
“আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচার দিবসকে মিথ্যা বলে (অস্বীকার করে) ? সে সেই ব্যক্তি, যে এতিমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। ” Ñ সূরা মাউন ঃ আয়াত ১-৩
উপরোক্ত আয়াত হতে আমরা বুঝতে পারি, যারা পরকালকে অস্বীকার করে বা মিথ্যা মনে করে কেবল তারাই আল্লাহ্্র বিধি-বিধান লঙ্ঘন করতে পারে।
সুতরাং আল্লাহ্ পাকের বাণী অনুসারে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যারা আল্লাহ্্র অসন্তুষ্টির কারণ ঘটতে পারে এরূপ কাজ করে বা আল্লাহ্্র নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে তারা ঈমান আনার ঘোষণা দিলেও মূলতঃ পরকালের বিষয়ে ঈমান আনেনি। বিষয়টি একটি বাস্তব উদাহরনের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যায়। “কেউ তার এমন একটি ঘর বা হলরুম পাহারা দেয়ার জন্য ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য একজন দারোয়ান নিয়োগ করল যেখানে উন্নত ও লোভনীয় খাদ্য-সামগ্রী, স্বর্ণ, মণি-মুক্তা ও সহজে বহনযোগ্য বহু মূল্যবান রতœ রয়েছে। দারোয়ানকে এ শর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যে, তাকে একটি নির্দিষ্ট সময় বা একমাস পর্যন্ত এ রুমটি পাহারা দিতে হবে। এ সময়ে তাকে প্রত্যহ মাত্র দুবার খাদ্য ও পানীয় দেয়া হবে।
সে উক্ত রুমে রক্ষিত কোন খাদ্য ও সম্পদ স্পর্শ করতে পারবে না। যদি চুক্তি লঙ্ঘন করে বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত এ সকল দ্রব্যের কোনটি ভোগ করে বা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে তবে হাত ও পা কেটে দেয়া হবে। অপরদিকে সে যদি সফলতার সাথে তার পাহারাকার্য উক্ত নির্দিষ্ট মেয়াদে পূর্ণ করতে পারে তবে তাকে উক্ত খাদ্যসামগ্রী ও সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দেয়া হবে। আর তাকে আরও জানিয়ে দেয়া হলো তার গতিবিধি রেকর্ড করে রাখার জন্য একটি স্বয়ংক্রীয় ক্যামেরা সেখানে স্থাপন করা আছে যা সে কোনভাবেই ফাঁকি দিতে সক্ষম নয়। ”
বর্ণিত অবস্থায় উক্ত দারোয়ানের ভূমিকা কি হবে তা তার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করবে।
সে যদি বিশ্বাস করে প্রকৃতপক্ষেই তার প্রতিটি মুহূর্তের অবস্থা রেকর্ড হচ্ছে এবং তার নিয়োগকর্তা তা সরাসরি যন্ত্রের সাহায্যে দেখছে এবং কোন কিছুই স্পর্শ না করলে তাকে মেয়াদান্তে অর্ধেক দিয়ে দেয়া হবে তবে সে অবশ্যই শত খাদ্য কষ্টে থাকা সত্ত্বেও কোন কিছুই স্পর্শ করবে না। কিন্তু সে যদি মনে করে নিয়োগকর্তার দেয়া তথ্য মোটেও সঠিক নয়, ক্যামেরা নামের কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই, মেয়াদান্তে তাকে কিছুই দেয়া হবে না এবং নিয়োগকর্তা কিছুই আঁচ করতে পারবে না, কেবলমাত্র তাকে দিয়ে ঠিকঠাক মতো পাহারা দেয়ানোর জন্যই মিথ্যা প্রতিশ্র“তি দিয়েছে তবে সে অর্ধভুক্ত না থেকে খাদ্য কিছুটা হলেও ভক্ষণ করতে পারে এবং যথাসম্ভব মণি-মুক্তা আত্মসাৎ করতে পারে। অতএব যদি সে এ ধরনের আত্মসাৎমূলক কাজ করে তবে মনে করতে হবে সে তার নিয়োগকর্তার প্রতিশ্র“তি বিশ্বাস করেনি। আর তাই বলা যায় যারা আল্লাহ্্র বিধি-বিধান বাস্তবে অনুসরণ করছে না অর্থাৎ সুদ সংশ্লিষ্ট হচ্ছে তাদের ঈমানের মধ্যেই ত্র“টি রয়েছে।
এখন আমরা সুদখোর, সুদদাতা ও এ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়ে কুরআনের ঘোষনা জানব।
সূরা বাকারার ২৭৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ পাক বলেন ঃ
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর আর তোমাদের যে সুদ লোকদের নিকট পাওনা রয়েছে, তা ছেড়ে দাও, যদি বাস্তবিকই তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। যদি এরূপ না কর তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে। ”
এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর ঈমানদার বান্দাদেরকে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন বাস্তবিকই যদি তারা ঈমানদার হয়ে থাকে তবে যেন সুদ ছেড়ে দেয়। সুতরাং আল্লাহর এ নির্দেশানুসারে যদি কেউ সুদ ছেড়ে না দেয় তবে সে প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার নয়।
এ আয়াতে আরও বলা হয়েছে, যে সুদ ছেড়ে দেবে না তার সাথে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে।
অপরাপর আয়াতে সুদখোরদের ব্যাপারে আরও ভয়াবহ সতর্ক বাণী রয়েছে। তাদেরকে নিশ্চিত জাহান্নামের অধিবাসী হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছে, যে জাহান্নামে রয়েছে অকল্পনীয় উত্তাপময় আগুন, বিষধর সাপ, খাদ্য হিসেবে রয়েছে কণ্টকযুক্ত যাক্কুম গাছ, ফুটন্ত পানি, রক্ত ও ক্ষত নিঃসৃত পুঁজ। দুনিয়াতেও সুদের কুফলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। সুতরাং এত কিছু জানার পরও যারা সুদ খায় ও দেয় তারা নিজেদেরকে ঈমানদার মনে করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। আর ঈমানহীন কোন মানুষ মুসলমান হতে পারে না, তাদেরকে বলা হয় মুনাফিক।
কেননা, মানুষ তার নিকট ভবিষ্যতেও বিশাল ক্ষতির বিনিময়ে বর্তমানে সামান্য সুখ বা সুবিধা গ্রহণে রাজি হয় না। যেমন ঃ কোথাও মারাত্মক বিষ মিশ্রিত সুদর্শন ও লোভনীয় খাবার সজ্জিত করা আছে। একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি তা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করল আর এমন সময় অপর ব্যক্তি তাকে জানিয়ে দিল এ খাবারে মারাত্মক বিষ মিশ্রিত রয়েছে। আস্বাদন করামাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। এ অবস্থায় যদি ঐ ব্যক্তি সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্বাস করে তবে ক্ষুধা সহ্য করে সে খাবার ত্যাগ করবে।
আর তার খাবার গ্রহণের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঐ সংবাদের কারণে তা গ্রহণ না করার দ্বারাই প্রমাণ হয় যে, সে উক্ত সংবাদ বিশ্বাস করেছে। অপরদিকে সে যদি উক্ত খাবার গ্রহণ করে তবে তাতেই প্রমাণিত হবে সে সংবাদদাতার সংবাদ বিশ্বাস করেনি। সে উক্ত সংবাদদাতার উপর বিশ্বাস আনেনি অর্থাৎ বিশ্বাসী নয়।
তেমনিভাবে মহান আল্লাহ্ পাক সুদ না খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে উক্ত নির্দেশ অমান্য করার যে পরিণতি ঘোষণা করেছেন, কোন ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার হলে উক্ত ঘোষণার পর আল্লাহর নির্দেশানুসারে সুদ থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে সুদ সংশ্লিষ্ট হওয়া তার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। তথাপিও যদি কোন ব্যক্তি কোন না কোন অজুহাত দাঁড় করিয়ে সুদ সংশ্লিষ্ট হয় তবে তা-ই প্রমাণ করে যে সে আল্লাহ্, আল্লাহর প্রতিশ্র“তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে বিশ্বাসী বা ঈমানদার নয়।
রাসূল সা. এর হাদীস হতে জানা যায় সুদের দাতা, গ্রহীতা ও সাক্ষী বা সহযোগীদের মর্যাদা সমান।
সুদ সংশ্লিষ্টদের পরকালীন অবস্থা
সুদ গ্রহীতা, দাতা ও সাক্ষীদের পরকালীন অবস্থা কি দাঁড়াবে তা আলোচনার পূর্বে পরকাল সম্পর্কে প্রাথমিক আলোচনা করা সঙ্গত। ঈমান যে সকল বিষয়ের প্রতি আনতে হবে তার মধ্যে অন্যতম মৌলিক বিষয় হলো পরকাল। পরকালের উপর বিশ্বাস থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে মানুষের জীবনের প্রতিটি কর্মে, আচার-আচরণে, স্বভাব-চরিত্রে, বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ হল পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, সে যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত না হয় ভবিষ্যত ফলাফল হিসাব করে কাজ করে, সে তার মেধা ও শ্রম ব্যয় করে তার একটি বিনিময়, একটি ফলাফল আশা করে।
যে কাজে সে বেশী বিনিময় পাবে, বেশী ভাল ফলাফল পাবে সে সেই কাজেই নিজের মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে চায়। এটি মানুষের একটি সাধারণ প্রবণতা। মানুষ ধার্মিক সাজে আবার ধার্মিক হয়, দানবীর সাজে আবার দানবীর হয় এবং সৎ লোক সাজে আবার কেউ সৎ লোক হয়। দু’জনের উদ্দেশ্যগত একটি মিল রয়েছে তবে লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য হলো আকাশ জমিন। দু’জনেই তার এ আচরণের দ্বারা কিছু সুবিধা পেতে, ভবিষ্যতে কিছু লাভ করতে চায়।
এ দিক থেকে দু’জনের উদ্দেশ্য এক। আর পার্থক্য হল, যে সাজ গ্রহণ করে তার লক্ষ্য হল দুনিয়া আর যে প্রকৃতই উক্ত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে তার লক্ষ্য হল আখিরাত বা পরকাল। যে ব্যক্তি ধার্মিকতা, দানশীলতা, সততার সাজ গ্রহণ করে সে মনে করে এর দ্বারা দুনিয়াতে তার সম্মান, ব্যবসায়িক উন্নতি, অর্থনৈতিক লেনদেনের বিশ্বস্ততা, সামাজিক সুদৃঢ় অবস্থানসহ বহু সুবিধা অর্জিত হবে। আর তাই সে এসব কিছুর প্র্যাকটিস করে থাকে। তারা পরকালের হিসাব খুব কমই করে থাকে।
তবে তারা যে দ্বৈত সুবিধা পেতে চায় না এমনও নয়। তারা এর দ্বারা পরকালীন কিছু সুবিধাও আশা করে থাকে, যদিও দ্বৈত উদ্দেশ্যের ইবাদত আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের মানুষের বৈশিষ্ট্য হল তারা সমাজের লোক চক্ষুর অন্তরালে ভিন্নরূপ ধারণ করে এবং দুটি বিকল্পের মধ্যে যেটি গ্রহণ করলে পৃথিবীতে সুবিধা পাওয়া যাবে তাই গ্রহণ করে থাকে। আর নীতিগত দিক থেকে অনৈতিক হলে তা বৈধ করার বিষয়ে বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের মুসলমানগণ ঈমানদার হওয়ার দাবীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা পরকালের প্রতি পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসী নয়।
আর যারা ধার্মিকতার পথ অবলম্বন করে, সততা অর্জন করে, ইসলামের বিধি-নিষেধ আন্তরিকতার সাথে পরিপালন করে তাদের লক্ষ্য হল পরকাল বা আখিরাত। দুনিয়ার সুযোগ সুবিধা, তথাকথিত অনৈতিক মান-সম্মান তাদের কাছে মূখ্য নয়, একমাত্র পরকালকে আবর্তন করেই তাদের সকল কাজ সম্পাদিত হয়। তারা লোক চক্ষুর অন্তরালেও একই নীতি অবলম্বন করে। নিজের সুবিধার জন্য যেমন অনৈতিক বিষয় গ্রহণ করার অজুহাত খোঁজে না তেমনি অসুবিধার কারণে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে না।
এ দু’শ্রেণীর লোকের মধ্যে প্রথমে উল্লেখিত শ্রেণীর লোক দুনিয়াকে বেশী প্রাধান্য দেয়ার কারণে বিভিন্ন অজুহাতে সুদের লেনদেন হতে সাময়িক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে।
আর অপর পক্ষের লোকজনের কাছে পরকাল মূখ্য হওয়ায় তারা সর্বাবস্থায় সুদের লেনদেন হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
মনে রাখতে হবে সুদের লেনদেনের একটি অবশ্যম্ভাবী পরিণাম অবশ্যই পরকালে ভোগ করতে হবে। কোন ব্যক্তি তা না জানার কারণেই সুদ গ্রহণ করুক বা দেশের পরিস্থিতি, আর্থিক সমস্যা, সামাজিক অবস্থা যে কোন অজুহাতেই সুদের লেনদেন হোক না কেন তার পরিণাম হতে বাঁচার কোন সুযোগ থাকবে না। কোন মানুষ তার পথ সংক্ষিপ্ত করার অজুহাতে না জানার কারণে বা জোর-জবরদস্তির ফলেও যদি চোরাবালিতে পা রাখে তার তলিয়ে যাওয়া যেমন নিশ্চিত তেমন না জানার কারণে হোক বা পরিস্থিতির অজুহাতে হোক কোন ব্যক্তি সুদের লেনদেনের সাথে জড়িয়ে পড়লে তারও পরিণাম ভোগ করা নিশ্চিত। কেননা এ সকল অজুহাত পরিণাম পরিবর্তনে সক্ষম নয়।
সুদের দাতা-গ্রহীতা, লেখক ও সাক্ষীদেরকে যে পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে তার চিত্র কুরআন ও হাদীস হতে পাওয়া যায়। আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখিত কুরআনের আয়াত ও হাদীস হতে জানতে পারি;
যারা সুদ খায় তারা নিশ্চিতরূপে জাহান্নামী হবে এবং তথায় চিরকাল থাকবে। মহান আল্লাহ্ এ বিষয়ে এমন কোন সুযোগ রাখেন নাই যে এই এই পরিস্থিতিতে সুদ খেলে তাকে কিছুটা রেহাই দেয়া হবে। বরং তার জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিতরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহান্নাম একটা অদৃশ্য বিষয়।
কিন্তু মহান আল্লাহ্ পবিত্র কালামে হাকীমে জাহান্নামের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যেমন ঃ
“যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে তাদের অচিরেই আমি জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে দেব, অতঃপর (পুড়ে যখন) তাদের দেহের চামড়া গলে যাবে তখন আমি তার বদলে নতুন চামড়া বানিয়ে দেবো, যাতে করে তারা আযাব ভোগ করতে পারে। ”
Ñআল-কুরআন ঃ সূরা ৪ ; আয়াত ৫৬
“অতঃপর যারা হবে হতভাগ্য পাপী তারা থাকবে (জাহান্নামের) আগুনে, সেখানে তাদের জন্য থাকবে (আযাবের ভয়াবহতা) চিৎকার ও (যন্ত্রণার ভয়াল) আর্তনাদ। ” Ñআল-কুরআন ঃ১১ ; ১০৬
“একটু পেছনেই রয়েছে জাহান্নাম, (সেখানে) তাকে গলিত পুঁজ পান করানো হবে। সে অতি কষ্টে তা গলধঃকরণ করতে চাইবে, কিন্তু গলধঃকরণ করা তার পক্ষে কোনমতেই সম্ভব হবে না।
(উপরন্তু) চারদিক থেকে তার উপর মৃত্যু আসবে, কিন্তু সে কোনমতেই মরবে না, বরং তার পেছনে (একের পর এক) ভয়ংকর আযাব আসতেই থাকবে। ” Ñ আল-কুরআন; ১৪ ঃ ১৬Ñ১৭
“(হে নবী) তুমি বল, এই সত্য (দ্বীন) তোমার মালিকের পক্ষ থেকে এসেছে, সুতরাং যার ইচ্ছা সে (এর উপর) ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে (তাকে) অস্বীকার করুক, আমি তো এই (অস্বীকারকারী) জালেমদের জন্য এমন এক আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি, যার আওতা তাদের পুরোপুরিই পরিবেষ্টন করে রাখবে। যখন তারা (পানির জন্য) ফরিয়াদ করতে থাকবে, তখন এমন এক গলিত ধাতুর মতো পানীয় দ্বারা তাদের ফরিয়াদের জবাব দেয়া হবে যা তাদের সমগ্র মুখমণ্ডলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে, কি ভীষণ (হবে সে) পানীয়, আর কি নিকৃষ্ট হবে তাদের আশ্রয়ের স্থানটি। ”
Ñ আল-কুরআন; ১৮ ঃ ২৯
“অতঃপর এদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ তায়ালাকে অস্বীকার করে তাদের (পরানোর) জন্য আগুনের পোশাক কেটে রাখা হয়েছে, শুধু তাই নয়, তাদের মাথার ওপর সেদিন প্রচণ্ড গরম পানি ঢেলে দেয়া হবে। তার ফলে যা কিছু তাদের পেটের ভেতর আছে তা সব এবং চামড়াগুলো সব গলে যাবে।
তাদের (শাস্তির) জন্য সেখানে আরো থাকবে লোহার গদা। যখনই তারা (দোযখের) তীব্র যন্ত্রণায় (অস্থীর হয়ে) তার থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইবে তখনই তাদের পুনরায় (এই বলে) ধাক্কা দিয়ে তাতে ঠেলে দেয়া হবে, জ্বলনের প্রচণ্ড যন্ত্রণা আজ তোমরা আস্বাদন করো। Ñ আল-কুরআন ; ২২ ঃ ১৯Ñ২২
“অবশ্যই (জাহান্নামে) জাক্কুম (নামের) গাছ থাকবে। (তা হবে) গুনাহ্গারদের খাদ্য, তা গলিত তামার মত পেটের ভিতর ফুটতে থাকবে, তা যেন ফুটন্ত গরম পানি। ধরো একে অতঃপর হেঁচড়ে জাহান্নামের মধ্যস্থলের দিকে নিয়ে যাও, অতঃপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও।
(তাকে বলা হবে আযাবের) স্বাদ আস্বাদন করো। তুমি (না ছিলে) একজন শক্তিশালী ও অভিজাত মানুষ। ” Ñ আল-কুরআন ; ৪৪ ঃ ৪৩Ñ৪৯
“(তাদের অবস্থান হবে জাহান্নামের) উত্তপ্ত বাতাস ও ফুটন্ত পানিতে এবং (ঘন) কালো রঙের ধূঁয়ার ছায়ায় Ñ শীতল নয়, আরামদায়কও হবে না। ”
Ñ আল-কুরআন ; ৫৬ ঃ ৪২Ñ৪৪
“না, সে (জাহান্নাম) হচ্ছে একটি প্রজ্জ্বলিত আগুনের লেলিহান শিখা, যা চামড়া ও তার আভ্যন্তরীণ মাংসগুলোকে খুলে বের করে দেবে, (সেদিন) সে (আগুন) এমন সব লোকদের ডাকবে যারা সত্যের প্রতি অনীহা দেখিয়ে তার থেকে ফিরে এসেছিল। ” Ñ আল-কুরআন; ৭০ ঃ ১৫Ñ১৭
অতএব যারা সুদ খায়, সুদ দেয় ও সুদের চুক্তি লিখে ও সাক্ষ্য দেয় তাদের প্রত্যেককেই উপরোক্ত করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে।
রাসূল আকরাম সা. সুদখোরদের বিষয়ে আরও বলেছেন Ñ
সামুরা ইব্ন জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবী সা. বলেছেন ঃ আজ রাতে আমি স্বপ্নে দু’জন লোককে দেখলাম। তারা আমার নিকট এসে আমাকে নিয়ে একটি পবিত্র ভূমিতে গেল। আমরা চলতে চলতে একটি রক্ত নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। নদীর মধ্যখ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।